শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি, বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি by নিশাত সুলতানা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা কার্যক্রমের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এটা অনেকেই বিশ্বাস করেন যে মাতৃভাষায় জ্ঞানার্জন ছাড়া শিক্ষার পরিপূর্ণতা লাভ করা প্রায় অসম্ভব। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছিলেন,
'আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন।' তাই বাংলা ভাষাই বাঙালিদের শেষ আশ্রয়। বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে বাংলা ভাষায় শুদ্ধ উচ্চারণকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রান্তিক যোগ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়েরর্ স্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পরও আমরা কয়জনই বা শুদ্ধ বাংলায় শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করি! আমার তো মনে হয় বাংলাদেশের মোট জনগণের পাঁচ শতাংশও শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে জানেন না বা বলেন না। ভাষায় আঞ্চলিকতার প্রভাব থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আঞ্চলিক ভাষাগুলো প্রকৃতপক্ষে আমাদের বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাই ভাষাগুলো আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সম্পদ। তবে আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার ও চর্চা সম্পর্কে সচেতনতা খুবই জরুরি। অবাক হই তখন, যখন দেখি তথাকথিত ফ্যাশন সচেতন কিছু ছেলেমেয়ে সচেতনভাবে শুদ্ধ বাংলাকে এড়িয়ে চলছে, কারণে-অকারণে তারা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করছে। এতেই যেন তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাংলাভাষায় আনাড়িপনার কথা জানানোর মধ্যেই যেন তাদের কৃতিত্ব। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই বাংলাদেশের এফ এম রেডিওগুলো এ ধারার প্রবর্তনে বিশেষ গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এর পাশাপাশি ছিল স্বনামধন্য কিছু নাট্যকারের অবদান। পরবর্তীকালে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা ও সরকারি হস্তক্ষেপে এই চর্চার লাগাম কিছুটা টেনে ধরা গেলেও মেকি উচ্চারণে পূর্ণ সেই ধারাটি বিপুলভাবে জনপ্রিয়তা পায় তরুণ প্রজন্মের কাছে। লজ্জার বিষয় এই যে, আমাদের দেশে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে অলিখিতভাবে এ ধারার চর্চা হচ্ছে আর তরুণ প্রজন্ম বিপুল আগ্রহে ধারাটি রপ্ত করছে। অফিস-আদালতেও ইদানীং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইংরেজি ধাঁচে ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলার কিম্ভূতকিমাকার নতুন এই ধারা। ভয় হয় তখন যখন দেখি এভাবে কথা বলা মানুষরা অন্যদের চোখে এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছেও বাড়তি কদর পাচ্ছেন। নিজের ভাষা না জানা বা শুদ্ধভাবে না বলতে পারার মধ্যে কী মাহাত্ম্য থাকতে পারে তা আমার কাছে মোটেই বোধগম্য নয়। দু-একটি বাস্তব উদাহরণ দিই। দেশের স্বনামধন্য একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকাকালীন সুযোগ হয়েছিল এ বিষয়ে আমার ছাত্র-ছাত্রীদের মতামত জানার। প্রায় সবাই আমাকে জানিয়েছিল তারা নাকি কথা বলার এই নতুন ধারার পক্ষে। কারণ হিসেবে তারা আমাকে জানিয়েছিল এই রীতি খুব আধুনিক, এখানে উচ্চারণের নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতা নেই। জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কী মনে করো এই ধারা দীর্ঘস্থায়ী হবে? তারা খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমাকে বলেছিল, 'অবশ্যই'। কারণ তারা নাকি তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই ভাষা পৌঁছে দেবে। সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো এক সভায় আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, আমার এক সহকর্মীকে যিনি হঠাৎই ইংরেজি ও বিকৃত বাংলা উচ্চারণ মিশিয়ে সেই অদ্ভুত ভাষায় কোনো একটি বিষয় উপস্থাপন করছেন। তার হঠাৎ এ পরিবর্তন আমাকে চিন্তিত করে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পাস করে আসার সুবাদে তার সঙ্গে আমার বেশ সখ্য ছিল। কারণ জিজ্ঞেস করায় সে আমাকে উত্তর দিল, 'দোস্ত, শুদ্ধ বাংলায় কথা বললে কেউ পাত্তা দেয় না। ইংরেজি স্টাইলে ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বললে সবাই পাত্তা দেয়। তাই অনেক কষ্টে কায়দাটা রপ্ত করেছি।' হায়রে আমার দেশ! হায় আমার বাংলা ভাষা! একটি ভাষাকে কৃত্রিম বা অশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করার মধ্যে কী মাহাত্ম্য থাকতে পারে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। তাই আমি বিশ্বাস করি, অশুদ্ধ বাংলায় কথা বলা কখনই আভিজাত্যের মাপকাঠি হতে পারে না। মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে বা বলতে না পারার মধ্যে কোনো গৌরব নেই, গৌরব থাকতে পারে না; বরং এতে রয়েছে লজ্জা আর অপারগতার গ্লানি। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক স্যার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথা, যিনি একদিন শ্রেণীকক্ষে পাঠদানকালে আমাদের বলেছিলেন, 'যে ব্যক্তি একটি ভাষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ তার কখনোই অন্য একটি ভাষা থেকে শব্দ ধার করে ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না।' অন্যদিকে আমি দেখি চাকরিযুদ্ধে প্রায় সর্বত্রই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার প্রমাণ যেই হারে নেওয়া হয় বাংলা ভাষায় তা নেওয়া হয় না। মৌখিক পরীক্ষাগুলো অধিকাংশই হয় ইংরেজিতে এবং সেখানে প্রাধান্য দেওয়া হয় তাকেই যিনি কিনা ইংরেজিতে পারঙ্গম। ইংরেজিতে পারঙ্গম সেই ব্যক্তিটি আদৌ শুদ্ধ ভাষায় বাংলা বলতে কিংবা লিখতে পারেন কি না এ বিষয়ে কাউকে মাথা ঘামাতে দেখি না। অথচ কর্মী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় দক্ষতা অন্যতম বড় একটি মানদণ্ড হওয়া উচিত। তাই আজ সময় হয়েছে আরেকবার ভাবার। আমরা যখন বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখছি তখন নিজেদের উদাসীনতার কারণে আমাদের নিজেদের ভাষাই আজ হুমকির মুখে। কারণ আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যারা কিনা বাংলা ভাষাকে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবে তারা নিজেরাই আজ ভাষা নিয়ে বিভ্রান্ত। তাই আসুন আমরা শুদ্ধ বাংলা জানি, শুদ্ধ বাংলার চর্চা করি, শুদ্ধ বাংলায় শুদ্ধ উচ্চারণে পরিষ্কারভাবে কথা বলি। অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া যে এই বাংলা ভাষা! একে আমরা দূষিত হতে দিতে পারি না। বাংলা ভাষা ব্যবহারে তাই হতে হবে আরো যত্নবান। নতুবা অশুদ্ধ উচ্চারণে দূষিত ভাষা পৌঁছে যাবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। আমরা সেটা হতে দিতে পারি না।
লেখক : উন্নয়নকর্মী
লেখক : উন্নয়নকর্মী
No comments