আবারও প্রশ্নপত্র ফাঁস-হোতাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে

আবারও প্রশ্নপত্র ফাঁসের কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে ৩৩তম বিসিএস লিখিত (বাধ্যতামূলক) পরীক্ষা স্থগিত করেছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। পিএসসি অবশ্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা স্বীকার করেনি; শুধু অনিবার্য কারণের কথা উল্লেখ করেছে।


কিন্তু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, কয়েক দিন ধরেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে ব্যাপক গুঞ্জন ছিল। দু-তিন লাখ টাকায় প্রশ্নপত্রের সেট বিক্রি করা হচ্ছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর আমরা তো জানি, বাংলাদেশে যা রটে তার কিছুটা হলেও ঘটে। আমাদের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে। এর আগেও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে এবং কারণ উল্লেখসহ প্রতিকারের উপায় সম্পর্কেও সুপারিশ করেছে। তার পরও বিসিএসের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কিভাবে- সেটাই আমাদের প্রশ্ন। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রকেও ফাঁস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না?
২০১০ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারি বিজি প্রেসের ডজনখানেক কর্মচারীসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিজি প্রেস থেকে ট্রাঙ্কভর্তি টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল। সে সময় মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি বিজি প্রেসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পিএসসির কর্মকর্তা ও শিক্ষকসহ মোট ১১ জনকে সরাসরি দায়ী করেছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এর সঙ্গে একটি 'মূল অপরাধচক্র' জড়িত রয়েছে। 'সেই চক্রটিকে শনাক্ত না করা গেলে এ ধরনের অপরাধ আবার ঘটানো হবে' বলে মন্তব্যও করা হয়েছিল। তখন মূল চক্রটিকে শনাক্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের প্রতি কমিটি অনুরোধ রেখেছিল। কিন্তু সেই শক্তিশালী অপরাধচক্রটিকে শনাক্ত করা এবং বিচারের আওতায় আনা গেছে কি? যায়নি যে তার প্রমাণ এই আবার বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। বিজি প্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে উল্লেখ করে সেই তদন্ত কমিটি বিজি প্রেসের ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার দুর্বলতাকেও দায়ী করেছিল। বিজি প্রেসের নিরাপত্তা বাড়ানো, প্রশ্নপত্রের একাধিক সেট করাসহ কমিটি মোট ১৫ দফা সুপারিশ করেছিল।
সেই সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে কি? হয়নি। আর সে কারণেই আবারও প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই কলঙ্কজনক ঘটনা। কেন বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কলঙ্কের কালিমা লেপন করা হচ্ছে জাতির মুখে! কেন মূল হোতারা আড়ালেই থেকে যায়। তদন্ত কমিটির ৮৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের মধ্যেই এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। কমিটির মতে, ২০০৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে আসছে এবং এর মাধ্যমে 'একটি মহল অঢেল ধনসম্পত্তির মালিক' হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই অঢেল ধনসম্পত্তির মালিক হওয়া এই মহলটির অসীম প্রভাব-প্রতিপত্তিও রয়েছে। রাঘব বোয়ালদের সেই প্রভাবের কাছে সংশ্লিষ্টদের সব প্রচেষ্টাই হার মেনে যায়। ফলে কোনো কমিটির কোনো সুপারিশই যথার্থ অগ্রগতি লাভ করে না কিংবা বাস্তবায়িত হয় না। কেবল কিছু চুনোপুঁটি ধরা পড়ে এবং তাদের শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে একধরনের 'আইওয়াশ' করা হয়।
আমরা চাই, বিসিএসের মতো একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় যেন আর কখনো প্রশ্ন ফাঁস না হয়, যেকোনো ধরনের অনিয়ম বা পক্ষপাত না হয়। কারণ এ পরীক্ষার মাধ্যমেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের অভিষেক ঘটে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের অপসংস্কৃতি থেকে যেন বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়। এ পরীক্ষায় যদি মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উপযুক্ত প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে, তাহলেই কেবল রাষ্ট্রীয় প্রশাসন গতিশীল হতে পারে, প্রশাসনের সক্ষমতা বাড়তে পারে। আমাদের দুর্ভাগ্য, অতীতে এর বহু ব্যত্যয় ঘটেছে। ভবিষ্যতে এই ব্যত্যয় রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে- এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.