হলমার্কের এমডি তানভীর গ্রেপ্তার

নানা কৌশল অবলম্বন করেও গ্রেপ্তার এড়াতে পারলেন না হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ। সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় গতকাল রবিবার রাতে মিরপুর এলাকা থেকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) একটি দল তাঁকে গ্রেপ্তার করে।


র‌্যাবের অভিযানে ধরা পড়েছে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার অন্য এক আসামি তানভীরের ভায়রা তুষার আহমেদ। তাঁদের হেফাজত থেকে চারটি গুলিভর্তি একটি পিস্তল, পাঁচটি ব্ল্যাকবেরি মোবাইল ফোন, দুই লাখ ৮৭ হাজার টাকা জব্দ করা হয়েছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল আহসান কালের কণ্ঠকে জানান, মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে অভিযান চালিয়ে তানভীর মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। শনিবার রাত থেকেই তাঁকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছিল। গ্রেপ্তারের পর মামলার অন্য আসামিদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
রাত সোয়া ৯টার দিকে তানভীরের আইনজীবী ফৌজিয়া ইয়াসমিন মুক্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, কম্পানির বস র‌্যাবের জালে বন্দি হয়ে পড়েছেন। যেকোনো মুহূর্তে র‌্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে। এর কিছুক্ষণ পরই গ্রেপ্তারের সংবাদ পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সাভারে র‌্যাব অভিযান চালানোর পর একজন কর্মচারীর মাধ্যমে তানভীর ও তাঁর ভায়রা তুষার পালিয়ে মিরপুর এলাকায় চলে আসেন। অবস্থান নেন পল্লবী থানাধীন ৬ নম্বর সেকশনের ৮ নম্বর সড়কের একটি বাসায়। শামসুদ্দীন তোহা নামে এক ব্যক্তির বাসার চার তলায় আত্মগোপন করেন তিনি। সারাদিন সেখান থেকে বের হননি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেছেন আইনজীবীসহ অন্যদের সঙ্গে। রাতে র‌্যাব সদস্যরা দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ওই বাসায় অভিযান চালান। একটি তালাবদ্ধ ঘরে তানভীরকে পাওয়া যায়।
ভবনের নিরাপত্তাকর্মী হায়দারের স্ত্রী তানিয়া জানান, চার তলার ফ্ল্যাটটিতে মালিক তোহার শ্যালক পাভেল স্ত্রীসহ বসবাস করেন। ঢাকা ব্যাংকের কর্মকর্তা পাভেল গতকাল অফিস থেকে ফিরে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে যান। এর পর পরই সেখানে র‌্যাবের লোক পৌঁছায়।
তানভীর ও তুষারকে আটকের কিছুক্ষণ পর সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমকে অভিযান সম্পর্কে জানান র‌্যাবের কর্মকর্তারা। এর পরেই তানভীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব-৪-এর কার্যালয়ে নেওয়া হয়। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল।
র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাভারের বাংলোতে অবস্থানকালে তানভীর গ্রেপ্তার হলে শ্রমিকদের মাধ্যমে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন তানভীর। কারখানায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে এবং মাইকিং করে এলাকাবাসীকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীদের ওপর চড়াও হওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। গণপিটুনি দেওয়ার মতো পরিকল্পনার বিষয়টিও জিজ্ঞাসাবাদে তানভীর স্বীকার করেছেন।
এর আগে শনিবার গভীর রাত থেকে র‌্যাব ঢাকা, সাভারসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। রাত আড়াইটা থেকে গতকাল ভোর ৬টা পর্যন্ত র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-৪ ও পুলিশ সাভারে অবস্থিত হলমার্কের কারখানায় তানভীরের সন্ধানে অভিযান চালায়। মূলত তানভীরের পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পর্কে তথ্য পেয়েই গভীর রাতে অভিযানে নামে র‌্যাব।
র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান জিয়াউল আহসান কালের কণ্ঠকে গতকাল বিকেলে বলেন, তানভীরসহ অভিযুক্তদের খোঁজে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় অভিযুক্ত অন্যান্যের ওপরও নজরদারি রয়েছে।
সন্ধ্যায় সাভার মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অভিযান বিষয়ে বলেন, হলমার্ক কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারে কোনো পরোয়ানা না পেলেও তাঁদের খোঁজা হচ্ছে। র‌্যাবের টিম এসেছিল তাঁদের আটক করতে। পুলিশ তাঁদের সহযোগিতা করেছে।
র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, নানাভাবে নিশ্চিত তথ্য ছিল, তানভীর শনিবার রাতে কারখানার ভেতরে অবস্থিত বাংলোয় অবস্থান করছেন। কিন্তু র‌্যাবের টিম সেখানে পৌঁছার আগেই পাশের গ্রামের দিকে কোথাও আত্মগোপন করেন তিনি। কয়েক শ আনসার সদস্যের পাহারায় থাকা কারখানাটিতে অভিযানের সময় ঢুকতে গিয়েও র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। গভীর রাতে বাতি নিভিয়ে পুরো এলাকা অন্ধকার করে রাখা হয়। ভোর ৬টা পর্যন্ত র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৪-এর একটি দল কারখানায় ঢুকে বিভিন্ন কক্ষে তল্লাশি চালানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে।
র‌্যাব-৪-এর সহকারী পুলিশ সুপার তানভীর আহমদ জানান, তানভীরের খোঁজে কারখানার ভেতরে বাংলোতে গেলে তা খুলতে বিলম্ব করা হয়। কয়েকজন তরুণী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললেও দরজা খুলতে অপারগতা জানায়। পরে দরজা ভেঙে র‌্যাব সদস্যরা ভেতরে ঢুকে তল্লাশি চালান। তরুণীরা জানায়, তানভীর সেখান থেকে আগেই সরে পড়েছেন।
র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বর্ণনা অনুসারে কারখানার ভেতরে অবস্থিত বাসভবনটিতে প্রচুর বিলাসসামগ্রী রয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরাল। কারখানাটির শ্রমিক-কর্মচারীরা জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব কর্মকর্তাদের নানাভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। বেশির ভাগই দাবি করে, তারা কারখানাটিতে নতুন।
এরপর চলে ভিন্ন মাধ্যমে অনুসন্ধান। গতকাল সন্ধ্যায় র‌্যাব তানভীরের অবস্থান নিশ্চিত হয়েই মিরপুর অঞ্চলে অভিযান শুরু করে। এ ক্ষেত্রে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা চরম গোপনীয়তা ও সতর্কতা অবলম্বন করে। তানভীর ও তুষারকে আজ রমনা থানায় হস্তান্তর করা হবে বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা ১১ মামলায় তানভীর মাহমুদসহ আসামিরা আত্মগোপন করেছেন বলে সংস্থার কর্মকর্তারা দাবি করেছেন। আগে তাঁদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা গেলেও বর্তমানে প্রত্যেকে নম্বর বদল করে ফেলেছেন। এমনকি তাঁরা আগের ঠিকানায়ও নেই।
তানভীর ও তুষারের গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব ও গোয়েন্দাদের অনুসন্ধান তালিকায় রয়েছেন হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীরের স্ত্রী ও হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার সাবেক ডিজিএম এ কে এম আজিজুর রহমানসহ ২৫ জন।

No comments

Powered by Blogger.