নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ by এ এম এম শওকত আলী
চার মে কালের কণ্ঠে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরকার কর্তৃক মূল্য নিয়ন্ত্রণের সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সরকার একটি আইনি আদেশ (এসআরও) রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে শিগগিরই জারি করবে। এ আদেশে প্রায় ১৭টি নতুন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য অন্তর্ভুক্ত হবে। এর মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা এবং লবণসহ আরো কিছু পণ্য।
এ-সংক্রান্ত আইন পর্যালোচনা করে বলা যায় যে ১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণের আইন জারি হয়েছিল। একই আইন এখনো বিদ্যমান। এ আইনের আওতায় সরকারকে আইনে উল্লিখিত তালিকায় যেকোনো পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আলোচ্য আইনি আদেশ জারি করার বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন। সংবাদটির মতে, বর্তমান আইনি আদেশের মূল লক্ষ্য হবে মশলাজাতীয় পণ্যের নিয়ন্ত্রণ। এসব পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে। অনেকের ধারণা, এর ফলে অ্যাগ্রো প্রসেসিং শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
জানা যায়, আইনি আদেশের বলে সব ধরনের মশলাজাত পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রিত হবে। বলা বাহুল্য যে এ ধরনের পণ্য উৎপাদন করতে ইতিমধ্যে একাধিক অ্যাগ্রো প্রসেসিং শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর সব কয়টি বেসরকারি মালিকানাধীন। সরকারি কার্য সম্পাদন বিধি অনুযায়ী সব ধরনের নীতি বা আইন চূড়ান্ত করার আগে সে বিষয়ে জনগণের মতামত গ্রহণ করা হয়। সাধারণত খসড়া নীতি বা আইন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করে অনধিক ১৫ দিনের মধ্যে সবাইকে মতামত প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এই রীতি অনুসৃত হয়েছে কি না জানা নেই।
সব মশলাজাত পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থা ছোট-বড় আকারের প্যাকেটে বিপণন করে থাকে। ফলে শহরবাসী চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ী এ পণ্য ব্যবহার করে ঘরে হরেক রকমের রান্না করে থাকে। তাদের জন্য এটা সুবিধাজনক। মশলা বাটার জন্য আলাদা সময় ও অর্থ ব্যয় বহনের ঝামেলা নেই। অভিযোগ করা হয়েছে, মাত্র ১২ গ্রাম ওজনের মশলার প্যাকেট বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৫ টাকায়। পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুক্তি হলো, তারা একাধিকবার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মূল্য সহনীয় করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের মতে, পাঁচ শতাংশ লাভ করলেই যথেষ্ট। পাঁচ শতাংশ লাভের যে হিসাব মন্ত্রণালয় ধার্য করেছে, তার ভিত্তি কী তা অজানা। সংবাদে বলা হয়েছে, মশলাজাত পণ্যের ব্যবসায় মুনাফা অত্যধিক। এ কারণেই বহু বেসরকারি সংস্থা এ পণ্য তৈরি ও বিপণনে লিপ্ত। ধারণা করা যায়, এ ধরনের মূল্যায়ন অনেকটাই একপেশে। একই শিল্পে বড় ধরনের বিনিয়োগ তখনই হয়, যখন সংশ্লিষ্ট পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, আশির দশকে মাত্র একটি বা দুইটি গুঁড়া মসলাজাত পণ্যের উৎপাদক ছিল। তখন চাহিদাও ছিল নগণ্য। তখন এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ পাওয়াও দুরূহ ছিল। ব্যাংক কর্মকর্তারা এসব পণ্যের ঊর্ধ্বগামী চাহিদার বিষয়েও সন্দিহান ছিলেন। ভোক্তারাও গুঁড়া মসলার ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন না। নগরজীবনের এ দৃশ্যপট নব্বইয়ের দশকে পাল্টে গেছে। তারা সবাই এখন ভীষণ ব্যস্ত। এ ব্যস্ততার মূল কারণ বাসা থেকে কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য অত্যধিক সময়ের বাধ্যবাধকতা। কখন বাটা মসলার লোক আসবে, মসলা বাটতে কত সময় লাগবে, দৈনন্দিন রান্নার জন্য এ সময় তাদের এখন নেই। সবাই চায় ঝটপট রান্না।
নব্বইয়ের দশকে শিল্পনীতির মাধ্যমে অ্যাগ্রো প্রসেসিং ও অ্যাগ্রো বিজনেস খাতকে অধিকতর উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার এ খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। পরবর্তী বছরের সব শিল্পনীতিতে এ বিধান এখনো অপরিবর্তিত। এ দৃষ্টিকোণে বিচার করলে বলা সম্ভব যে প্রস্তাবিত মূল্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও শিল্পনীতি পরস্পরবিরোধী। একে অপরের সম্পূরক নয়। ফলে ব্যবসায়ী মহলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। কমে যাবে বিনিয়োগ এবং প্রতিযোগিতামূলক বিপণনব্যবস্থা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত আইনের শিরোনাম এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট ১৯৫৬। এ আইনে দুই ডজনেরও অধিক পণ্যের একটি তালিকা বিদ্যমান। উদ্দেশ্য, সরকার ইচ্ছা করলে আইনের তালিকাভুক্ত যেকোনো পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতাবান। বাস্তবে পরবর্তী পর্যায়ে সরকার প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগে বিরত থাকে। তবে সামান্য কয়েকটি পণ্যের মূল্য সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। যেমন রাসায়নিক সার। এ ধরনের সার উৎপাদন নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাই করত। কিছু সারের চাহিদা সরকার আমদানির মাধ্যমে পূরণ করত। যেমন- টিএসপি ও পটাশ। বর্তমানে ইউরিয়া সারসহ টিএসপি ও পটাশ সারের আমদানি সরকারি ও বেসরকারি খাত করে। তবে মূল্য নির্ধারণ করে সরকার।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে সরকার আমদানি মূল্য ও নির্ধারিত মূল্যের ব্যবধান মেটানোর জন্য বেসরকারি খাতকে ভর্তুকি প্রদানের প্রথা প্রবর্তন করে। এখনো এ প্রথা বিদ্যমান। এর মূল লক্ষ্য দুইটি। এক. কৃষকরা যাতে সহনীয় মূল্যে সার কিনে ব্যবহার করতে পারে। দুই. উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতে অংশীদারিত্ব যাতে নিশ্চিত হয়। এ প্রথা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিককালে এ নীতি ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখার বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য অর্থমন্ত্রী কিছুটা বিপরীতধর্মী অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, কৃষি খাতের ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণ করা হবে। কোনটা সঠিক তা নিশ্চিতভাবে জানা যাবে আগামী বাজেট অধিবেশনে।
সার্বিকভাবে বলা সম্ভব যে সরকার আংশিক বাজার নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী। এও বলা সম্ভব যে মসলাজাত পণ্যের প্রস্তাবিত মূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ অনেকটা ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়ার মতো। এ উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না ব্যর্থ হবে- এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য ফিরে দেখা জরুরি। ১৯৭২-পরবর্তী সময়ে বাজারমূল্য স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে সরকার টিসিবি প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, এ উদ্যোগ সফল হয়নি। জন্মের পরবর্তী সময়ে টিসিবি ক্রমান্বয়ে একটি নির্জীব প্রতিষ্ঠান হয়। ২০০৯ সাল থেকেই শোনা গিয়েছিল, সরকার টিসিবিকে পুনরুজ্জীবিত করে সক্রিয় করে তুলবে। এ চেষ্টাও ব্যর্থ।
এ কথাও অনস্বীকার্য যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সরকারেরই দায়িত্ব। একমাত্র চাল ও গমের ক্ষেত্রেই সরকার প্রতিবছরই খোলাবাজারে খাদ্যশস্য সহনীয় মূল্যে সরবরাহ করে থাকে। যার পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। এ সত্ত্ব্বেও এ প্রতীকী প্রথা অব্যাহত রাখার সপক্ষে যুক্তি একটাই- নিম্ন আয়ের জনমানুষ কিছুটা হলেও উপকৃত হয়। তবে এ কথাও সত্য, প্রস্তাবিত উদ্যোগ বাজারে অধিক সরবরাহের মাধ্যমে মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার কোনো ব্যবস্থা নয়। এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য, আইন অর্থাৎ দণ্ড প্রদানের মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। লক্ষণীয় যে সরকার ও বিশেষজ্ঞরা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের বাজার নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত ১২টি আইন প্রয়োগ নব্বইয়ের দশক থেকেই খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে বন্ধ রেখেছে। বিদ্যমান অবস্থাও তাই।
এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে প্রস্তাবিত উদ্যোগ গ্রহণের আগে বাজারে এর প্রভাব কী হবে তা ঠিকমতো বিচার-বিবেচনা না করেই করা হচ্ছে। অতীত অভিজ্ঞতা- এ ধরনের উদ্যোগের জন্য সুফলের তুলনায় কুফলই হয়েছে অধিকতর। জোর করে আইন প্রয়োগের ফলে বাজার থেকে পণ্য উধাও হয়ে গেছে। কারণ ব্যবসায়ীরা হয়েছেন ভীতসন্ত্রস্ত।
প্রস্তাবিত উদ্যোগের সম্ভাব্য কুফল অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা সম্ভব। এ ধরনের পণ্যের সরবরাহ চাহিদা মোতাবেক না হওয়ারই আশঙ্কা। এ ছাড়া রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় এর কুপ্রভাব। যেসব বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মসলাজাত পণ্যের উৎপাদক, তারা প্রায় সবাই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে। তারা কি ঋণ সময়মতো শোধ করতে সক্ষম হবে? ব্যাংকের গ্রাহকদের অর্থাৎ অর্থ জমাদানকারী ব্যক্তিদের অর্থ ফিরে পাওয়া বা সময়মতো সুদ পাওয়ার আশাও ক্ষীণ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরো বলা যায় যে কাঁচামাল হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত মসলা বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অনেক মসলাই আমদানি করতে হয়। আমদানি-ব্যয় পরিশোধিত হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। মূল্য নির্ধারণের আগে এ বিষয়টিও ভেবে দেখা প্রয়োজন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
জানা যায়, আইনি আদেশের বলে সব ধরনের মশলাজাত পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রিত হবে। বলা বাহুল্য যে এ ধরনের পণ্য উৎপাদন করতে ইতিমধ্যে একাধিক অ্যাগ্রো প্রসেসিং শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর সব কয়টি বেসরকারি মালিকানাধীন। সরকারি কার্য সম্পাদন বিধি অনুযায়ী সব ধরনের নীতি বা আইন চূড়ান্ত করার আগে সে বিষয়ে জনগণের মতামত গ্রহণ করা হয়। সাধারণত খসড়া নীতি বা আইন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করে অনধিক ১৫ দিনের মধ্যে সবাইকে মতামত প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এই রীতি অনুসৃত হয়েছে কি না জানা নেই।
সব মশলাজাত পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থা ছোট-বড় আকারের প্যাকেটে বিপণন করে থাকে। ফলে শহরবাসী চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ী এ পণ্য ব্যবহার করে ঘরে হরেক রকমের রান্না করে থাকে। তাদের জন্য এটা সুবিধাজনক। মশলা বাটার জন্য আলাদা সময় ও অর্থ ব্যয় বহনের ঝামেলা নেই। অভিযোগ করা হয়েছে, মাত্র ১২ গ্রাম ওজনের মশলার প্যাকেট বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৫ টাকায়। পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুক্তি হলো, তারা একাধিকবার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মূল্য সহনীয় করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের মতে, পাঁচ শতাংশ লাভ করলেই যথেষ্ট। পাঁচ শতাংশ লাভের যে হিসাব মন্ত্রণালয় ধার্য করেছে, তার ভিত্তি কী তা অজানা। সংবাদে বলা হয়েছে, মশলাজাত পণ্যের ব্যবসায় মুনাফা অত্যধিক। এ কারণেই বহু বেসরকারি সংস্থা এ পণ্য তৈরি ও বিপণনে লিপ্ত। ধারণা করা যায়, এ ধরনের মূল্যায়ন অনেকটাই একপেশে। একই শিল্পে বড় ধরনের বিনিয়োগ তখনই হয়, যখন সংশ্লিষ্ট পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, আশির দশকে মাত্র একটি বা দুইটি গুঁড়া মসলাজাত পণ্যের উৎপাদক ছিল। তখন চাহিদাও ছিল নগণ্য। তখন এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ পাওয়াও দুরূহ ছিল। ব্যাংক কর্মকর্তারা এসব পণ্যের ঊর্ধ্বগামী চাহিদার বিষয়েও সন্দিহান ছিলেন। ভোক্তারাও গুঁড়া মসলার ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন না। নগরজীবনের এ দৃশ্যপট নব্বইয়ের দশকে পাল্টে গেছে। তারা সবাই এখন ভীষণ ব্যস্ত। এ ব্যস্ততার মূল কারণ বাসা থেকে কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য অত্যধিক সময়ের বাধ্যবাধকতা। কখন বাটা মসলার লোক আসবে, মসলা বাটতে কত সময় লাগবে, দৈনন্দিন রান্নার জন্য এ সময় তাদের এখন নেই। সবাই চায় ঝটপট রান্না।
নব্বইয়ের দশকে শিল্পনীতির মাধ্যমে অ্যাগ্রো প্রসেসিং ও অ্যাগ্রো বিজনেস খাতকে অধিকতর উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার এ খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। পরবর্তী বছরের সব শিল্পনীতিতে এ বিধান এখনো অপরিবর্তিত। এ দৃষ্টিকোণে বিচার করলে বলা সম্ভব যে প্রস্তাবিত মূল্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও শিল্পনীতি পরস্পরবিরোধী। একে অপরের সম্পূরক নয়। ফলে ব্যবসায়ী মহলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। কমে যাবে বিনিয়োগ এবং প্রতিযোগিতামূলক বিপণনব্যবস্থা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত আইনের শিরোনাম এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট ১৯৫৬। এ আইনে দুই ডজনেরও অধিক পণ্যের একটি তালিকা বিদ্যমান। উদ্দেশ্য, সরকার ইচ্ছা করলে আইনের তালিকাভুক্ত যেকোনো পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতাবান। বাস্তবে পরবর্তী পর্যায়ে সরকার প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগে বিরত থাকে। তবে সামান্য কয়েকটি পণ্যের মূল্য সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। যেমন রাসায়নিক সার। এ ধরনের সার উৎপাদন নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাই করত। কিছু সারের চাহিদা সরকার আমদানির মাধ্যমে পূরণ করত। যেমন- টিএসপি ও পটাশ। বর্তমানে ইউরিয়া সারসহ টিএসপি ও পটাশ সারের আমদানি সরকারি ও বেসরকারি খাত করে। তবে মূল্য নির্ধারণ করে সরকার।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে সরকার আমদানি মূল্য ও নির্ধারিত মূল্যের ব্যবধান মেটানোর জন্য বেসরকারি খাতকে ভর্তুকি প্রদানের প্রথা প্রবর্তন করে। এখনো এ প্রথা বিদ্যমান। এর মূল লক্ষ্য দুইটি। এক. কৃষকরা যাতে সহনীয় মূল্যে সার কিনে ব্যবহার করতে পারে। দুই. উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতে অংশীদারিত্ব যাতে নিশ্চিত হয়। এ প্রথা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিককালে এ নীতি ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখার বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য অর্থমন্ত্রী কিছুটা বিপরীতধর্মী অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, কৃষি খাতের ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণ করা হবে। কোনটা সঠিক তা নিশ্চিতভাবে জানা যাবে আগামী বাজেট অধিবেশনে।
সার্বিকভাবে বলা সম্ভব যে সরকার আংশিক বাজার নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী। এও বলা সম্ভব যে মসলাজাত পণ্যের প্রস্তাবিত মূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ অনেকটা ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়ার মতো। এ উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না ব্যর্থ হবে- এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য ফিরে দেখা জরুরি। ১৯৭২-পরবর্তী সময়ে বাজারমূল্য স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে সরকার টিসিবি প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, এ উদ্যোগ সফল হয়নি। জন্মের পরবর্তী সময়ে টিসিবি ক্রমান্বয়ে একটি নির্জীব প্রতিষ্ঠান হয়। ২০০৯ সাল থেকেই শোনা গিয়েছিল, সরকার টিসিবিকে পুনরুজ্জীবিত করে সক্রিয় করে তুলবে। এ চেষ্টাও ব্যর্থ।
এ কথাও অনস্বীকার্য যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সরকারেরই দায়িত্ব। একমাত্র চাল ও গমের ক্ষেত্রেই সরকার প্রতিবছরই খোলাবাজারে খাদ্যশস্য সহনীয় মূল্যে সরবরাহ করে থাকে। যার পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। এ সত্ত্ব্বেও এ প্রতীকী প্রথা অব্যাহত রাখার সপক্ষে যুক্তি একটাই- নিম্ন আয়ের জনমানুষ কিছুটা হলেও উপকৃত হয়। তবে এ কথাও সত্য, প্রস্তাবিত উদ্যোগ বাজারে অধিক সরবরাহের মাধ্যমে মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার কোনো ব্যবস্থা নয়। এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য, আইন অর্থাৎ দণ্ড প্রদানের মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। লক্ষণীয় যে সরকার ও বিশেষজ্ঞরা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের বাজার নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত ১২টি আইন প্রয়োগ নব্বইয়ের দশক থেকেই খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে বন্ধ রেখেছে। বিদ্যমান অবস্থাও তাই।
এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে প্রস্তাবিত উদ্যোগ গ্রহণের আগে বাজারে এর প্রভাব কী হবে তা ঠিকমতো বিচার-বিবেচনা না করেই করা হচ্ছে। অতীত অভিজ্ঞতা- এ ধরনের উদ্যোগের জন্য সুফলের তুলনায় কুফলই হয়েছে অধিকতর। জোর করে আইন প্রয়োগের ফলে বাজার থেকে পণ্য উধাও হয়ে গেছে। কারণ ব্যবসায়ীরা হয়েছেন ভীতসন্ত্রস্ত।
প্রস্তাবিত উদ্যোগের সম্ভাব্য কুফল অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা সম্ভব। এ ধরনের পণ্যের সরবরাহ চাহিদা মোতাবেক না হওয়ারই আশঙ্কা। এ ছাড়া রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় এর কুপ্রভাব। যেসব বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মসলাজাত পণ্যের উৎপাদক, তারা প্রায় সবাই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে। তারা কি ঋণ সময়মতো শোধ করতে সক্ষম হবে? ব্যাংকের গ্রাহকদের অর্থাৎ অর্থ জমাদানকারী ব্যক্তিদের অর্থ ফিরে পাওয়া বা সময়মতো সুদ পাওয়ার আশাও ক্ষীণ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরো বলা যায় যে কাঁচামাল হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত মসলা বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অনেক মসলাই আমদানি করতে হয়। আমদানি-ব্যয় পরিশোধিত হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। মূল্য নির্ধারণের আগে এ বিষয়টিও ভেবে দেখা প্রয়োজন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments