সাম্প্রতিক-নিখিলের পা এবং কানামাছি ভোঁ ভোঁ... by শাকিল ফারুক

নিখিল ভদ্র আর কোনো দিন নিজের পায়ে দাঁড়াবেন না। কোনো মরা বিকেলে বা রাত গভীরে তাঁকে দুই পায়ে টুক টুক করে হেঁটে অফিসে ঢুকতে বা বের হতে দেখা যাবে না আর কখনো। ঘাতক বাস চিরদিনের জন্য কেড়ে নিয়েছে এই মানুষটির ডান পা। যখন এই লেখা লিখছি, নিখিল তখন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সর্বশেষ তথ্য মোতাবেক, তাঁর বাম পায়ের অবস্থাও গুরুতর। নিখিল কালের কণ্ঠের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। আলাদা বিভাগের কর্মী হওয়ায় তাঁর সঙ্গে আমার


জানাশোনা কম। কিন্তু তিনি যে কেবল নামে নন, আক্ষরিক অর্থেই একজন নিপাট ভদ্র মানুষ, এ তথ্য বোধ করি কারো অজানা নেই। অজানা থাকার কথা নয় সেই বিভীষিকাময় সকালটির কথাও। গত বুধবার সকাল ৯টায় মোহাম্মদপুর থেকে বিআরটিসি বাসে প্রেসক্লাবের সামনে এলেন নিখিল। বাসচালক নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রী না নামিয়ে বাস থামিয়ে দিল ডিভাইডারের পাশেই। নিখিল সেখানে নেমে প্রেসক্লাবের দিকে পা বাড়ালেন। পেছন থেকে আসা বিআরটিসির আরেকটি বাস তাঁকে ধাক্কা দিল। রাস্তায় পড়ে গেলেন নিখিল। ডান পা চলে গেল চাকার নিচে। বাসচালক সোহেল রানার সেদিকে হুঁশ নেই। সে বাস চালিয়ে দিল নিখিলের পায়ের ওপর দিয়েই। ডান পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল নিখিলের শরীর থেকে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। ওলটপালট হয়ে গেল একটি জীবন। এই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আরো অনেক জীবন হয়ে যাবে এলোমেলো। এই একটি দুর্ঘটনা সারা জীবন কান্নার সুর হয়ে বাজবে নিখিলের স্বজনদের হৃদয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, নিখিলের চিকিৎসার ভার বহন করবে সরকার। প্রয়োজনে তাঁকে বিদেশে পাঠানো হবে উন্নত চিকিৎসার জন্য। তা না হয় হলো, কিন্তু নিখিলের জন্য যে কান্না, তার দাম কিভাবে শোধ করবে সরকার?
ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরকার যেকোনো দুর্ঘটনার দায় এড়াতে চায়। কিন্তু নিখিলের চিকিৎসা করাতে সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্যয় করা হবে, সেটা তো নিখিলেরই অর্থ, সাধারণ মানুষের অর্থ। চালকের ভুলের খেসারত নিখিল বা নিখিলের মতো সাধারণ মানুষ কেন দেবে? বিআরটিসির মতো প্রতিষ্ঠানে এমন বাসচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যে ট্রাফিক আইন মানে না। এটা তো সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য হওয়া উচিত।
তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের শোকের জল শুকায়নি এখনো। মিরসরাইয়ের সেই ট্র্যাজেডি তো কোনো দিন ভোলার নয়। আর এবার নিখিল। গত কয়েক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার হার এবং ক্ষতি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে অনেক। কিন্তু এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। দেশে যেন সড়ক দুর্ঘটনার মচ্ছব শুরু হয়েছে। দেশের সব প্রান্তে নিয়মিত ঘটছে দুর্ঘটনা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চালকের ভুলের মাসুল গুনতে হচ্ছে নিরীহ মানুষকে। নিভে যাচ্ছে কত জীবনপ্রদীপ।
বারবার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে দেশ, কিন্তু লাভ হয়নি। কেন হয়নি? কার স্বার্থে হয়নি? স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চেয়ে পথে নেমেছে সাধারণ মানুষ। তাদের চাওয়া পূরণ হয়নি। হবে কিভাবে? শর্ষেতেই যদি ভূত থাকে, তাহলে কোন কচু হবে! শাজাহান খানদের মতো নির্দিষ্ট শ্রেণী-গোত্রের মন্ত্রীরা তো বারবার ব্যাহত করবেন যেকোনো উদ্যোগ। তাহলে সরকার কি নিশ্চিন্তে পথে চলার নিরাপত্তাটুকুও দিতে পারবে না সাধারণ মানুষকে? সরকারের পক্ষ থেকে চালকদের প্রশিক্ষিত করার কিংবা ট্রাফিক আইন জোরদার করার উদ্যোগ নিতে কি খুব ঝামেলা? কঠোরভাবে তা পালনের বিধিও কি করার ক্ষমতা নেই সরকারের? আছে তো বটেই। কিন্তু সব কিছু হবে তখন, যখন সরকার সত্যি সত্যিই চাইবে। ঠুনকো রাজনৈতিক বা ক্ষুদ্র স্বার্থ নয়, বিবেচনায় আনতে হবে সমগ্র জাতির বৃহৎ স্বার্থকে। নইলে তারেক, মিশুক কিংবা আমাদের নিখিলদের তালিকা শুধু দীর্ঘই হবে। নিখিলদা, আপনার জন্য সমবেদনা এবং শুভ কামনা।

বিএনপির কানামাছি ভোঁ ভোঁ!
একজন শিল্পী মঞ্চে গাইছেন। মঞ্চের সামনে অনেক মানুষের ভিড়। সাদেক বলল, নিশ্চয়ই খুব জনপ্রিয় শিল্পী। সোহেল জিজ্ঞেস করল, বুঝলি কী করে? দেখছিস না, কত্তো মানুষ। যার এত্তো ভক্ত, সে তো বিরাট শিল্পী। সাদেক আর সোহেল তারপর ভিড়ের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজনের কাছে শিল্পীর পরিচয় জানার চেষ্টা করে দেখল, বেশির ভাগ লোক শিল্পীর নামটাও জানে না! মূলকথা : ভিড়ের প্রতিটি মুখই ভক্তের মুখ নয়!
বিএনপির শীর্ষ নেতারাও হয়তো কথাটা বুঝতে পেরেছেন। বিএনপির রোডমার্চ-সমাবেশে প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে বটে, কিন্তু তাই বলে সবাই যে বিএনপির সঙ্গে_এমনটা ভাবার কারণ এবং উপায় কোনোটাই হাতে নেই। বর্তমান সরকার বহু বিতর্কিত এবং সমালোচিত কর্ম সম্পন্ন করেছে। এ জন্য আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হয়তো কমেছে, কিন্তু বিএনপির বাড়েনি। কয়েক দিন আগে এক টকশো বক্তার দেওয়া তথ্য মতে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৭০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। বিএনপির প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পরও ৭০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি মানে, এই বিরাট জনসাধারণ বিএনপিকে হিসাবের বাইরে রাখতেও দ্বিধা করেন না! এ তথ্য বিএনপি আরো আগেই জেনেছে। আর জানার পর দেশের প্রধান বিরোধী দলের কেমন যেন বেহাল অবস্থা। নয়া নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিএনপিকে। বিএনপি বলেছে, রাষ্ট্রপতিকে তারা জানাবে, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচন নয়। আদালতের রায় মোতাবেক, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বলে এখন আর কিছু নেই। এর পরও বিএনপি আওয়ামীবিরোধিতার জের ধরে এই এক সুরেই গেয়ে চলেছে। আবার গানের ফাঁকে ফাঁকে তারা নির্বাচন কমিশনকে বলেছে, তাদের কার্যালয়ে পরীক্ষার জন্য একটি ইভিএম মেশিন পাঠাতে। স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির এমন উদ্ভট আবদার প্রত্যাখ্যান করেছে ইসি।
নির্বাচন নিয়ে ভাবছে বিএনপি, আবার সরকার পতনের সেই পুরনো খেলাও এখনো শেষ হয়নি। আগামী ৭ ও ৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যখন এই ঘোষণা দিচ্ছেন, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তখন বলছেন, বিএনপি নাকি সংসদে যেতে চায়, কিন্তু সরকার পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিএনপিকে সংসদে নেওয়ার জন্য কেমন পরিবেশ প্রয়োজন? শুরু থেকেই সংসদে না গিয়ে পরিবেশ নেই বলে দাবি করে আসছে বিএনপি। কিন্তু সংসদ সদস্যপদ বাঁচাতে ঠিকই সংসদে হাজিরা দিয়ে এসেছেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। তখন কি পরিবেশ ঠিক হয়ে গিয়েছিল? বিএনপি নেতাদের কাছে এর ব্যাখ্যা কী? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে যেসব কথা বলছে বিএনপি, তা সরাসরি বিরোধী না হলেও বিচারব্যবস্থাকে ব্যাহতই করছে বটে। জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক স্বার্থে রক্ষা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির বিরোধিতা করে বিএনপি আখেরে ক্ষতিটা করছে তাদেরই_এটা কি বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বোধগম্য হচ্ছে না? বিএনপি এখন কানামাছি খেলার মতো চোখে কাপড় বেঁধে নেমেছে রাস্তায়। ভোঁ ভোঁ করে এলোপাতাড়ি হাতড়ে বেড়াচ্ছে এদিক-সেদিক। সর্বশেষ চারদলীয় জোটকে আরো বৃহৎ করার পরিকল্পনাও চলছে। তবে এসবে কি লাভ হবে কোনো? বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্লেষকদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে এই কলামের লেখায় আগেও বহুবার বলা হয়েছে, বিএনপিকে সব কিছুর জন্য তাদের প্রতি মানুষের হারিয়ে যাওয়ার আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। আবারও সেই একই পরামর্শ রইল।

'আনপ্রেডিক্টেবল' এরশাদ
সাবেক রাষ্ট্রনায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামের আগে এবং পরে নানা রকম আপত্তিকর বিশেষণ বহু আগে থেকেই জড়িয়ে আছে। বিশেষণের খাতায় এবার 'আনপ্রেডিক্টেবল' শব্দটিও যোগ করার সময় এসেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বহু নাটকীয়তার পর জোট বাঁধলেন এরশাদ। শেখ হাসিনাকে ছোট বোন হিসেবে আখ্যায়িত করলেন, নির্বাচনে গেলেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হলো না। অমনি শুরু হলো এরশাদের ছটফটানি। আবার মহাজোটের আশ্বাসে চুপ।
কিছুদিন ধরে আবারও খেপাটে হয়ে উঠেছেন এরশাদ; এবং তাঁর জাতীয় পার্টিও খেপে উঠেছে। মহাসমাবেশ করছেন বিভিন্ন এলাকায়। হাজার হাজার মানুষের সামনে ঘোষণা দিচ্ছেন, আগামীতে জাতীয় পার্টি একাই নির্বাচনে যাবে। এরশাদ হ্যান করবেন, ত্যান করবেন। এই ঘোষণা দেওয়ার পর এক সপ্তাহও কাটেনি। ভোল পাল্টে গেছে এরশাদের। গত ২৮ ডিসেম্বর এক বৈঠক শেষে আবারও মহাজোটের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টিকে নিয়ে। মহাজোটের গণমিছিলেও অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাহলে আগে ওগুলো বলেছিলেন কেন? বিশ্ব বেহায়া আর কাকে বলে! বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কিছু বিষয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। এখন থেকে আর কোনো দূরত্ব থাকবে না। যেসব বিষয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলো যে কেবলই ক্ষমতাকেন্দ্রিক, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। আর এর মাধ্যমে আরো একবার স্পষ্ট, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য মানুষের সেবা নয়, ক্ষমতা। স্রেফ ক্ষমতা!

No comments

Powered by Blogger.