আন্তর্জাতিক-বিশ্ব আলোড়িত ২০১১-এর ছয় পরিস্থিতি!

ছর শেষে একবার পেছন ফিরে তাকানো আসলে নিজেদের কৃতকর্মের ওপরই দৃষ্টি দেওয়া! নিজ দেশ থেকে বিদেশ-বিভুঁই_বিশ্বব্যাপী যেখানেই ঘটনা-দুর্ঘটনা যা-ই ঘটুক, ভৌগোলিক দূরত্ব এবং রাজনৈতিক বিভেদ বিবেচনায়ও তা আমাদের সবার জীবনেই অল্প-বিস্তর প্রভাব ফেলে। আরব বসন্তের হাওয়ায় স্বৈরাচারের প্রাসাদ ভেঙে পড়া যেমন আমাদের উৎফুল্ল করে, তেমনি মানবিক বিপর্যয়ের শিকার জাপানিদের দুর্দশাও আমাদের বেদনাহত করে।


কিছু ইতিবাচক ঘটনা যেমন আমাদের আশাবাদী করে তোলে, তেমনি বিশ্ব নেতৃত্বের অনেক পদক্ষেপ আবার নিরাশার অন্ধকার কাটতে দেয় না বিশ্বের। নতুন বছরের শুরুতে গেল বছরের তেমনই ছয়টি ঘটনা-দুর্ঘটনার ওপর দৃকপাত করেছেন শ্রাবণ সরকার

আরব বসন্ত!
কী প্রাচ্যে, কী প্রতীচ্যে, উত্তরে কিংবা দক্ষিণে পৃথিবী নামক এ গ্রহের সব প্রান্তেই প্রাকৃতিক ঋতুবৈচিত্র্য ছাপিয়ে গেল বছরে বিরাজমান ছিল শুধুই 'বসন্ত'! এই বসন্তের নাম 'আরব বসন্ত'। গত বছর তো বটেই, সাম্প্রতিক বিশ্ব-ইতিহাসের সবচেয়ে অঘটনঘটনপটিয়সী ঘটনাটির নাম আরব বসন্ত বা 'যূথিবিপ্লব' এবং স্বমহিমায় তা এখনো বিরাজিত এই বিশ্বে! এই বসন্তবিপ্লব তথা স্বতঃস্ফূর্ত মানব জাগরণের ধাক্কা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে স্বৈরশাসকদের মসনদ টালমাটাল করে দেয়। তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার গদি আঁকড়ে পড়ে থাকা একনায়করা শতভাগ ধরাশায়ী হন। কেবল ক্ষমতার রাশ ছেড়ে দিয়েই নয়, প্রাণ দিয়েও মূল্য চুকাতে হয়েছে তাঁদের একজন_লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে। ইয়েমেন, সিরিয়া, এমনকি জর্দানেও সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার। এর ঢেউ লেগেছে বাহরাইন-মরক্কোতেও। তবে 'আরব বসন্ত' কোথাও কোথাও সামাজিক বিপ্লবের চেহারায় আবির্ভূত হলেও ক্ষেত্রবিশেষে তা পেছন থেকে কলকাঠি নাড়া 'রেজিম চেইঞ্জ' বলেই প্রতিভাত হয়েছে। লড়াই, রক্ত ও ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বের পরিবর্তনের স্রোত প্রবহমান।

'অকিউপাই ওয়াল স্ট্রিট'
তৃণমূল থেকেও দানা বাঁধা আন্দোলন 'পরিপূর্ণ' আন্দোলনের মতোই আচরণ করে। 'আরব বসন্ত' তারই প্রমাণ। যোগ্য নেতৃত্ব এবং সুসংগঠিত শক্তিই একমাত্র আন্দোলনের গর্ভ নয়, এমনকি কোনো পূর্বাভাস ছাড়াও আপাত নিস্তরঙ্গ জনসমুদ্রে সুনামির ঢেউ জাগতে পারে, জোরসে আছড়ে পড়তে পারে মসনদের বালুতটে! আবার সুনির্দিষ্ট দাবি-দাওয়া ছাড়াও মানুষ রাস্তায় নামে_মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো' (অকিউপাই ওয়াল স্ট্রিট) আন্দোলন তারই সাক্ষ্য দেয়। বস্তুত বিক্ষোভকারীরা তালিকা করে দাবি-দাওয়ার ফিরিস্তি তুলে ধরেনি, পেশ করেনি গাদাগুচ্ছের অভিযোগ। আন্দোলনের লক্ষ্যও হয়তো সুনির্দিষ্ট নয়, তবে তার বার্তা পরিষ্কার। বিক্ষোভকারীরা নিজেদের '৯৯ শতাংশ জনগণ' বলে দাবি করছে। তাদের বক্তব্য, বাকি ১ শতাংশ মানুষ দেশের সিংহভাগ সম্পদের মালিকানায় রয়েছে। এক হিসাবে, এই ১ শতাংশ ধনাঢ্য শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮ শতাংশ সম্পদ। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এক কোটি ৭২ লাখ পরিবার অর্থাৎ প্রায় প্রতি সাতটি পরিবারের একটির খাদ্য নিরাপত্তা নেই। অর্থাৎ, সমাজে ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলা বৈষম্যই 'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো' আন্দোলনের প্রাণভোমরা।
আরব বসন্তের জাগরণ থেকে অনুপ্রাণিত এবং তৃণমূল থেকে মাথা তোলা এই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। মাত্র কয়েক ডজন মানুষের শুরু করা এই আন্দোলন কার্যত দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। তাও মাত্র মাসখানেকের মধ্যে।

বিন লাদেন বধ
পাকিস্তানের মাটিতে মার্কিন গোপন সেনা অভিযানে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে গত বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। এক দশক আগে 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে' যুদ্ধ ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এখনো তা চলমান। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্রের টুইন টাওয়ারসহ যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি স্থানে একযোগে আত্মঘাতী হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এই হামলার ষড়যন্ত্রী হিসেবে সৌদি বংশোদ্ভূত বিন লাদেনকে সাব্যস্ত করে মার্কিন প্রশাসন। এর পর থেকে হন্যে হয়ে তাঁকে খোঁজা হচ্ছিল। অবশেষে গত ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি বাড়িতে গোপনে অভিযান চালিয়ে বিন লাদেনকে হত্যা করে মার্কিন সেনার একটি চৌকস দল। তবে_তাঁকে জীবিত অবস্থায় পাকড়াও না করে 'পরিকল্পিতভাবে হত্যা' করায় অনেক প্রশ্নেরই উত্তর অজানা রয়ে গেল বিশ্ববাসীর সামনে।


ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট
গত বছর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে গোটা ইউরোপ। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একক মুদ্রার কার্যকারিতার ব্যাপারটি রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। একক মুদ্রার দেশগুলোকে বাঁচাতে হাত বাড়িয়ে দেয় ফ্রান্স ও জার্মানি। তবে তাদের সেই প্রচেষ্টা খুব একটা কাজে লাগেনি। বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা কাঁধ থেকে নামাতে ব্যয় সংকোচনের বিল বা প্যাকেজ পরিকল্পনা নিতে বাধ্য হয় গ্রিস ও ইতালি। ইইউর পরামর্শ এবং দেখানো এই পথে হেঁটেও কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তাদের। সরকারিভাবে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণের ফলে রীতিমতো গণবিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় দেশ দুটির সরকারকে। গ্রিসে শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও, ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়ে সারা দেশ। প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপান্দ্রুউ পদত্যাগে বাধ্য হন। একই ঘটনা ঘটে ইতালিতেও। বিরোধিতার মুখে দেশটির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনিকেও বেছে নিতে হয় ইস্তফার পথ।


দক্ষিণ সুদানের মাথা তোলা
'সাদা' বিশ্ব থেকে অনেক দূরের এক 'কালো' মহাদেশের নাম আফ্রিকা। কৃষ্ণকায় এই আফ্রিকার ইতিহাসও যেন কৃষ্ণবর্ণ। আফ্রিকার ইতিহাস মানেই নিপীড়িতের গল্প, হাহাকারের কাহিনী, বঞ্চনার আখ্যান! এত সব 'কালো'র মধ্যে আফ্রিকায় এক 'ধলো' অধ্যায়ের শুভ সূচনা হয়েছে গত বছর! বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলেছে সুদানের দক্ষিণাঞ্চল_৯ জুলাই ২০১১ তারিখে। নবীনতম এই রাষ্ট্রটি জাতিসংঘ স্বীকৃত ১৯৩তম দেশ, যা পরিচিত হয়েছে 'গণপ্রজাতন্ত্রী দক্ষিণ সুদান' নামে। আফ্রিকা মহাদেশের ৫৪তম সদস্য রাষ্ট্রের মর্যাদায় অভিষিক্ত খ্রিস্টানপ্রধান এই দক্ষিণ সুদান। দেশটির আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে আফ্রিকা এবং আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ সুদান হয়েছে দ্বিখণ্ডিত। মুসলিমপ্রধান উত্তর অংশ 'সুদান' নামেই নিজেদের পরিচিতি জারি রেখেছে।


জাপানে ভূমিকম্প
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুুর্বিপাক কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। সময়ে-অসময়ে নানা কারণেই প্রকৃতি বৈরী হয়ে উঠতে পারে। 'কিছু' মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রকৃতির ওপর তার অপরিণামদর্শী হস্তক্ষেপও এসব বিপর্যয়ের বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত ইদানীং। যদিও জানমাল দিয়ে তার খেসারত দিতে হয় 'বহু' মানুষকে। গত বছর পৃথিবীর বুকে আঘাত হানা দুর্যোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল জাপানের ভূমিকম্প ও সুনামি। ১১ মার্চ রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে রীতিমতো লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দেশটি। লহমায় প্রাণ চলে যায় ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষের। ভূমিকম্প-পরবর্তী সুনামি বয়ে আনে সত্যিকার অর্থেই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। সুনামির আঘাতে ফুকুশিমায় পরমাণুকেন্দ্রের চুলি্ল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেখা দেয় পরমাণু বিপর্যয়। এর সুদূরপ্রসারী মারাত্মক প্রভাব মোকাবিলা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.