হামহাম জলপ্রপাত by মুমিত আল রশিদ
শান্ত-নিবিড় সবুজ বেলাভূমির এক বিস্তৃত ভেলা ভানুগাছির কুরমাটিলার কলাবনপাড়ার ছোট্ট গ্রাম। সেখানকার সহজ-সরল মানুষ, দিগন্তজোড়া চা বাগান, বিস্তীর্ণ বৃক্ষঘেরা এক অপরূপ অরণ্যরাজি, উঁচু-নিচু পাহাড় ও টিলা এবং পাহাড়ি ছড়া জায়গাটির প্রতি আকৃষ্ট হতে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করে। এই অতি মনোরম দৃশ্যাবলির অভূতপূর্ব জায়গাটি হলো মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের কুরমাটিলা বনবিটের কলাবনপাড়া এলাকা।
আর এ কুরমাটিলা বনবিট থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে গহিন অরণ্যে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ১৬০ ফুট উচ্চতা নিয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এই মুহূর্তে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ত্রিপুরা সীমান্তের কোলঘেঁষে গহিন অরণ্যের হামহাম জলপ্রপাত। স্থানীয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হাম্মাম ঝরনা নামে, আবার কেউ কেউ সিতাপ (এ অঞ্চলের প্রাচীন রাজা) ঝরনা নামেও ডাকেন। প্রায় এক বছর আগে এই ঝরনার সন্ধান পান বাইরের দুনিয়ার লোকজন। কিন্তু ৮ কিলোমিটার দূরের কুরমাটিলার অধিবাসীরা ছোটবেলা থেকেই এই ঝরনা থেকে জল পড়ার শোঁ শোঁ শব্দ শুনতেন আর প্রতিদিনই কুরমাটিলা বাজারে অবস্থিত বিডিআর ফাঁড়িতে গিয়ে আরজি জানাতেন, যেন এই ঝরনাটি সম্বন্ধে সরকারকে অবহিত করা হয়। এমনকি স্থানীয় অধিবাসীদেরও সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না।
কুরমাটিলার কলাবনপাড়ার শাহাজীবাজার থেকে ছবিলালকে গাইড হিসেবে সঙ্গে নিলাম। প্রথম বিপদ উপলব্ধি করলাম কিছুদূর এগিয়ে টিলার মাঝামাঝি অংশে দুটি পিচ্ছিল বাঁশ অতিক্রম করতে গিয়ে, যে অংশটির নিচে প্রায় ১৫ ফুট পরিমাণ গভীর খাদ (এ রকম প্রায় ৮-১০টি পথ অতিক্রম করি)। কিছুদূর হাঁটার পরে প্রায় ২০ ফুট নিচে পিচ্ছিল পথ বেয়ে খাড়া হয়ে নেমে পড়ি হাঁটুসমান জলের পাহাড়ি ছড়ার মধ্যে। গাইড ছড়ার একপাশ দিয়ে হাঁটতে বলল, কেননা মাঝের অংশে কোমর পরিমাণ জল। ছড়ার মধ্যে বাঁশ ফেলে সাবধানে হাঁটতে থাকি। পায়ের তলায় হরেকরকম বাঁশের কঞ্চি, শামুক, ঝিনুক ও ধারালো পাথরের স্পর্শ অনুভব করি। এবার সামনে আরও গভীর জল, তাই পাহাড়ি ছড়া থেকে ১০ ফুট উঁচু শুকনো জায়গায় উঠতে হবে পিচ্ছিল পথ বেয়ে। পাহাড়ি লতাগুল্ম ও স্থানীয় অধিবাসীদের বেঁধে দেওয়া বাঁশের সাহায্য নিয়ে অতিকষ্টে উপরে উঠে এলাম। সাবধানে পথ চলছি, একটু অসতর্ক হলে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। প্রায় সোয়া একঘণ্টা হেঁটে মোকামটিলার পাদদেশে সীতাপুকুরের শীতল ছায়ায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসে পড়ি। দূরের নির্জন অরণ্য থেকে পাখির সুমধুর কলরব ভেসে আসছে কখনওবা শোনা যাবে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের ডাক। মোকামটিলার কেন্দ্রস্থলে মোকাম পীরের একটি অদৃশ্য মাজার রয়েছে, কয়েকজন টিলার পাদদেশে নির্দিষ্ট স্থানে কিছু টাকা রেখে দিল। গহিন অরণ্যের একটি টিলা থেকে ঝরনার পানি সীতাপুকুরে কলকল-ছলছল শব্দে গড়িয়ে পড়ছে। ছবিলালের কাছে শুনলাম এই সীতাপুকুরে দুই ব্যক্তির নির্মম মৃত্যুর কথা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ৭০ ফুট উঁচু মোকামটিলায় ওঠার প্রস্তুতি নিলাম। হামহাম ঝরনা যাওয়ার পথে সবচেয়ে কঠিন, কষ্টকর ও অত্যন্ত দুর্গম এই মোকামটিলা, এটি সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিল। বাঁশের গোড়া ধরে মোকামটিলার উপরে উঠে সবাই ১০ মিনিট বিশ্রাম নিলাম। ৪৫ মিনিটে মোকামটিলা পার হয়ে আবার পাহাড়ি ছড়ার মধ্য দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম, পথের দু'পাশে পাথরের বিশাল আস্তর আর উপরে বড় বড় বৃক্ষরাজি পাহাড়ি ছড়াকে এমনভাবে ঢেকে দিয়েছে, মনে হলো আমরা যেই পথ দিয়ে হাঁটছি সেখানে কখনোই সূর্যের আলো পেঁৗছে না, ভরদুপুরেও মনে হলো সন্ধ্যার আনাগোনা। ১ কিলোমিটার দূর থেকে জলপ্রপাতের পানি পড়ার ঝিরঝির শব্দ শুনতে পাচ্ছি আর শিহরিত হচ্ছি। হঠাৎ লতাপাতা, বড় বড় বৃক্ষরাজি ও বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো রোমাঞ্চকর নয়নাভিরাম জলপ্রপাত হামহাম। বিধাতা যেন নিজ হাতে পাহাড় ও অরণ্যঘেরা দুর্গম এলাকাটিকে অপার সৌন্দর্য দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন। শীতকালীন সময়ে পানির প্রবাহ কম থাকায় খুব বেশি আফসোস হলো না কারোরই। কেননা যাত্রাপথের অদ্ভুত বুনো সৌন্দর্যে সবাই বিমোহিত ছিলাম। হাঁটার মাঝেও যে হরেকরকম সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকতে পারে এবং চিত্তবিনোদনের সব উপাদান যেখানে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যায়, সেখানে হামহামের শীতকালীন প্রবহমান ধারা দেখে প্রকৃতিপ্রেমীদের খুব বেশি মনোকষ্ট না হওয়ারই কথা। ১৬০ ফুট উঁচু জলপ্রপাতটি মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত থেকে প্রায় ৩ গুণ চওড়া। বর্ষাকালীন সময়ে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) জলপ্রপাতটি তার ভেতরে লুকানো সব সৌন্দর্যের ডানা মেলে ধরে এ কথা আমাদের গাইড না বললেও আমাদের বুঝতে কারোরই বাকি রইল না। ছবিলালের কাছ থেকে জানলাম, হামহাম থেকে আরও ২ কিলোমিটার দূরে ত্রিপুরা সীমান্তে এর চেয়েও ৩ গুণ চওড়া আরও একটি জলপ্রপাত রয়েছে। যার অবস্থান ত্রিপুরায় কিন্তু পানির প্রবাহ বাংলাদেশে। বিএসএফ ঘণ্টা দুয়েকের অনুমতি দেয় সেটি দেখার।
প্রশাসনের করণীয় : জলপ্রপাতটির নিচে গিয়ে মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। আমরা সব ভালো জিনিসকে খুব সহজে নষ্ট করে ফেলতে পারি সেখানে তার কিছু উৎকৃষ্ট নিদর্শন দেখলাম। পর্যটকদের ফেলে রাখা উচ্ছিষ্ট, চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেট, কলার খোসা, পানির বোতল ঝরনার পানিকে প্রতিনিয়ত নোংরা করছে। যেখান থেকে ঝরনাটি খুব সুন্দরভাবে দেখা যায় সেখানকার একটি টিলা কেটে ফেলা হচ্ছে। জানা গেল, এখানে দোকান হবে। প্রশাসন এদিকে দৃষ্টি দিক। এ ছাড়া জেনেছি প্রশাসনের লোকজন পর্যটকদের হামহামে যাওয়া সহজতর করার জন্য বনের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক তৈরি করবে, তার মানে প্রকৃতির বুকে কুড়াল মারা হবে, ধ্বংস করা হবে বিশালাকার বন, টিলা ও পাহাড়ি ছড়ার স্বাভাবিক বিকাশ ও প্রবহমান ধারা। বনের বুক চিড়ে যান্ত্রিক দানবের হুঙ্কারে তটস্থ থাকবে নিরীহ জীবজন্তু। হয়তোবা এভাবেই ধ্বংস হবে একটি অভয়ারণ্য। আমরা জানি সরকারি কাজ মানে টেন্ডার, আর টেন্ডার মানে হচ্ছে ১০টি বৃক্ষের বদলে ১০০টি বৃক্ষ নিধন। যেখানে জড়িত থাকে বিশাল অঙ্কের আর্থিক মুনাফা। গুটিকতক মানুষের আর্থিক সুবিধাটাই হবে মুখ্য। এখনও যাদের ঘুম ভাঙে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে পাখপাখালির কলতানে, দূর-দূরান্ত থেকে ভেসে আসা জীবজন্তুর বিচিত্র ডাকে, জলপ্রপাত থেকে পানি পড়ার রিমঝিম শব্দে। এখনও যারা বনকে আগলে রেখেছে যক্ষের ধন হিসেবে। সেসব পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবিকার দিকটি বিবেচনা করে প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, বিশালাকার বনটির স্বাভাবিক বিকাশ বজায় রেখে পাহাড়ি উঁচুনিচু পথগুলোতে কাঠের সিঁড়ি দেওয়া হোক এবং বাঁশের পিচ্ছিল পথগুলোতে ছোট ছোট স্টিল/কাঠের ব্রিজ নির্মাণ করা হোক। তাহলে প্রকৃতিপ্রেমী ও দর্শনার্থীরা প্রকৃতির নির্মল পরিবেশকে দু'চোখ ভরে উপভোগ করতে পারবেন এবং পথের দূরত্বও অনেকাংশে কমে আসবে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, প্রকৃতির অপূর্ব দানকে এভাবে যেন বিনষ্ট করা না হয়। এ ছাড়া কলাবনপাড়ার শাহাজীবাজারে পর্যটকদের রাতযাপনের জন্য হোটেল ও মোটেল করা যেতে পারে। ফলে দেখা যাবে সবাই ভোরের সি্নগ্ধতা ও মাধুর্যতা অবলোকন করতে করতে স্বল্পসময়ে হামহাম পেঁৗছে যাবেন। প্রশাসনের কাছে আবারও জোর অনুরোধ থাকবে অনুগ্রহ করে শতবর্ষী জামরুল, চিকরাশি, বিজন বৃক্ষসহ বিরল প্রজাতির বৃক্ষরাজি ও ডলু, মুলি, মিরতাঙ্গা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এবং নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণীদের অভয়াশ্রমকে এভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করবেন না। কেননা এতে করে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, ছোট-বড় বিভিন্ন জাতের বানর, বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক, মেছোবাঘ, ভাল্লুক ইত্যাদি বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকছেই। সচেতন বুদ্ধিজীবী মহল, পরিবেশবাদী সংগঠন ও মিডিয়ার সব সংবাদকর্মীকে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সরকারের উচ্চমহলকে অবগত করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।
মুমিত আল রশিদ :শিক্ষক ও রোভার লিডার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mumit2020@gmail.com
No comments