আসুন আমরা শিকড়ের সন্ধান করি-সুশাসন by এম আবদুল হাফিজ

থচ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সহনশীল মূল্য তো ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী ইশতেহারেই ছিল। প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ তো দূরের কথা, ক্ষমতার দণ্ড যাদের হাতে তারা তো এখন থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরোক্ষ প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে আপামর জনসাধারণের ভোটে মহাজোট চারদলীয় জোটের দুঃশাসনের বদৌলতে আশাতীত সাফল্য পেয়েছিল, সেই সাধারণ জনগণ আজ ক্ষমতাসীনদের কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। বিগত জুনের শুরুতে যখন দেশ ছাড়ি


তখনই দেশের বর্তমান মহাজোট সরকারের নির্বাচনোত্তর 'মহানুভবতার' খোলস খুলে পড়েছে। বিরোধী দল বিএনপি দ্রব্যমূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, দেশ শাসনে অনিয়ম এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও মামলা-হামলার বিরুদ্ধে যৎসামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই আওয়ামীদের মুখোশ খুলে গেছে। যাবেই না-বা কেন? বিএনপিও তো বিগত দেশ শাসনের সময়ে একই আচরণ করেছিল। ইটটি মারলে পাটকেল খাওয়া তো আমাদের রাজনীতির সর্বজনীন রীতি। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে যদিও-বা কখনও মিষ্টি বাক্যবিনিময় হয়, 'ট্রিট ফর ট্যাটে'র এই কালচক্রটি পূর্ণ হবেই।
সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই দীর্ঘ সময়েও কোথাও কোনো পরিবর্তনের চিহ্ন নেই। আগের একই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃশ্যপট এখনও অক্ষত আছে। সেই বহুল পরিচিত দুর্বিষহ জীবন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দুর্বোধ্য কারণে আগের মতোই মহার্ঘ, যদিও এর বোধগম্য কোনো কারণ নেই। কেননা আগের মতোই এখনও বাম্পার ফলনের কথা শুনে আসছি। দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়েছে। দেশের অংশবিশেষে প্রচণ্ড শীতে বিপর্যস্ত মানুষের একটুখানি 'ওম' তো দূরের কথা, কোনো উষ্ণ সংবাদও নেই। কেউ কি কখনও শুনেছে যে দুর্নীতির আশঙ্কায় দাতা সংস্থারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কোথাও? কেউ কি কখনও শুনেছে যে একই বছরে পাঁচ-পাঁচবার জ্বালানির মূল্য বেড়েছে? তবু আরও যে বাড়বে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। মূল্যবৃদ্ধিজনিত ডেমাক্লিসের তরবারি সর্বক্ষণ ঝুলছে আমাদের ঘাড়ের ওপর।
অথচ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সহনশীল মূল্য তো ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী ইশতেহারেই ছিল। প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ তো দূরের কথা, ক্ষমতার দণ্ড যাদের হাতে তারা তো এখন থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরোক্ষ প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে আপামর জনসাধারণের ভোটে মহাজোট চারদলীয় জোটের দুঃশাসনের বদৌলতে আশাতীত সাফল্য পেয়েছিল, সেই সাধারণ জনগণ আজ ক্ষমতাসীনদের কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত। এককালের দরিদ্রবান্ধব বামঘেঁষা আওয়ামী লীগ, যার নেতৃত্বে মহাজোট গঠিত, সেই দলটির আনুকূল্যে তৈরি কিছু কোটিপতি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী-রাজনীতিক, অনুগত সংবাদপত্র এবং বন্দনা বিশারদ স্বঘোষিত বিশিষ্টজন ও সুশীল সমাজ সদস্য সমন্বয়ে গঠিত একটি এলিট শ্রেণী এখন দেশ চালায়। তারা আর মুজিব কোট পরে না, তাদের চাই ডিজাইনার সুট।
দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আগেই জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। যেমন_ রাস্তাঘাট, যানবাহন এবং রেলপথ ও রেলের বগি, আমি নিশ্চিত যে সরকারের ল্যাপটপে হয়তো একটি ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা আছে, কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই। স্তাবকরা হয়তো এখনই আমাকে বিশ্ব নিন্দুকের আখ্যা দেবে, কিন্তু সত্য কখনও কি আদৌ কোনো নিন্দাবাদ!
দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু যে হারে দফায় দফায় এর মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে তার বোঝা বহন করার তিক্ততাও তো কম নয়। আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিতে দলীয় ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যেন সংযত থাকেন। বাকিতে কেউ সন্তুষ্ট হয় না। সবাই সবকিছু নগদে চায়, কেননা আমরা তো বর্তমানের মধ্যে বাস করি। ঝোলানো কলা-মুলার দিকে আমরা আর কতকাল তাকিয়ে থাকব? আমরা সবাই একটি নশ্বর জীবন নিয়ে এসেছি। আমরা কি অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারি?
বর্তমানের মুদ্র্রামান, বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স, মুদ্রাস্ফীতি সংকট পুষে রাখলে তা বাড়তেই থাকবে। তার জন্য মহাজোটের সুশাসন দরকার, যা তাদের শাসনামলের তিন বছরেও আসেনি। আসবে যে তারও কোনো চিহ্ন নেই। এরই মধ্যে ঠিক চারদলীয় জোট সরকারের আদলে সরকার নানামুখী পরিকল্পনায় মেতে উঠেছে। আমি বছরখানেক আগে যুগান্তরে 'বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে আমার যে বক্তব্য ছিল তারই পুনরাবৃত্তি করে বলব, বক্রপথে কিছুই আয়ত্তে আনা যায় না_ না জনমত, না রাজনীতির কোনো ইতিবাচক পরিণতি। শেষ পর্যন্ত এক-এগারো জাতীয় কিছু একটা ঘটে যায়। খুবই দুঃখজনক যে, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি রহিত করা হয়েছে। যেন মগের মুল্লুুক! যেটা আমার অনুকূলে তা বহাল থাকবে, যা প্রতিকূলে তার শিরশ্ছেদ হবে! যারা সরকারে থাকে তাদের যে কোনো পদক্ষেপের বৈধতা দিতে রয়েছে দেশময় স্তাবকগোষ্ঠী, উচ্চ আদালত এবং ক্ষমতার জোর। অথচ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগের তোলপাড়েই এসেছিল। কমনওয়েলথ মহাসচিবের দূতিয়ালিতে অস্ট্রেলিয়া থেকে স্যার নিনিয়ান এসেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে বিতর্ক চলেছিল। স্যার নিনিয়ানের ব্যর্থতার পর স্মরণ করা যেতে পারে যে 'জনতার মঞ্চ' হয়েছিল। আমি ভারতীয় এবং পাকিস্তানি কিছু বিশ্লেষককে এই ব্যবস্থার প্রশংসা করতে দেখেছি। হঠাৎ করে আওয়ামীরা কি ফেরেশতা হয়ে গেল যে, তাদেরই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে? তুঘলকি কারবার আর কি!
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী একটি আধিপত্যবাদী দেশ। মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের কারণে ভারতের জন্য বঙ্গবন্ধুর কিছু দুর্বলতা ছিল। কিন্তু তার জীবনকালে কোনো সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে তিনি সেই ভারতের আধিপত্যবাদকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। পরবর্তী সরকারগুলো বিশেষ করে জিয়ার আমলে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক শামসুল হক তার কূটকৌশলে কোনো তিক্ততা ছাড়াই ভারতীয় আধিপত্যবাদকে ঠেকিয়ে ভারতের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। সে সময় ভারত বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ত্রুটি করত না।
এমনকি বিগত মেয়াদে আওয়ামী লীগও পানিচুক্তি ছাড়াও সীমান্তে আগ্রাসন ঠেকাতে বড়ইবাড়ী বা রৌমারীতে সীমান্তযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু ট্রানজিট, এশীয় মহাসড়ক ও বন্দরের অবমুক্তির স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখন কী হলো? ভারতীয় আধিপত্যবাদ বলে যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে তার ক্লেদ আজ বাংলাদেশজুড়ে। মানুষ যখন শীতে কষ্ট পায়, আইন-শৃঙ্খলার অভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, জঠর পূর্ণ করে খেতে পারে না, তখন তাকিয়ে দেখুন এপার বাংলা ওপার বাংলার নামে রবীন্দ্র সুরের ধারায়, নৃত্যে এবং আমদানিকৃত ভারতীয় চলচ্চিত্রের মচ্ছবে এ দেশ সয়লাব।
ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে, কিন্তু আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না যে, ভারত ও বাংলাদেশের বাঙালি অভিন্ন জাতি। সময় এসেছে, যখন আমাদের শিকড়ের সন্ধান করতেই হবে। তাহলেই আমরা মিথ্যা মরীচিকার পেছনে ছোটা থেকে বিরত হবো।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও
কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.