পাঠ্যপুস্তক উৎসব-সদিচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব
তৃতীয়বারের মতো সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হলো 'পাঠ্যপুস্তক উৎসব'। দুই-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা বাদ দিলে নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন বই হাতে পেয়েছে দেশের তিন কোটির বেশি শিক্ষার্থী। অন্য সবকিছু বাদ দিলেও ২২ কোটির বেশি বই মুদ্রণ, পরিবহন ও বিতরণের কৃতিত্বই যে বিশাল, অতিশয় নিন্দুকও তা স্বীকার করবেন। ঝকঝকে বই হাতে শিক্ষার্থীর অম্লান হাসিতে যেন ঝিকমিক করে উঠেছিল শীতার্ত জনপদগুলো। তৃতীয় বিশ্বের কয়টি দেশ শিক্ষাক্ষেত্রে এমন
সাফল্য দেখাতে পেরেছে বিবেচনার বিষয়। আমাদের মনে আছে, বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর যখন মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণের ঘোষণা দিয়েছিল, তখন এর সম্ভাব্যতা নিয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ, কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বই বিনামূল্যে বিতরণ নিয়েই অব্যবস্থাপনার অন্ত ছিল না। নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে বছরের প্রথম থেকে বই পেঁৗছানো ছিল যেন দুর্লঙ্ঘ দেয়াল। সন্তানের পড়াশোনার স্বার্থে কালোবাজার থেকে বই কেনার তিক্ত অভিজ্ঞতা এখনও নিশ্চয়ই অভিভাবকরা বিস্মৃত হয়ে যাননি। প্রাথমিক স্তরে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি বড় অংশ কোনোকালেই বিনামূল্যের বই পেত না। এখন যেভাবে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকেও বিনামূল্যের বই বিতরণ হচ্ছে, তিন বছর আগেও তা ছিল নেহাত তাত্তি্বক আলোচনার বিষয়। বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে ই-বুকের প্রসারের কথা বলেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। কমবেশি দুই কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দেশের সরকারপ্রধান এমন আশাবাদ ব্যক্ত করতেই পারেন। সীমিত পরিসরে হলেও ইতিমধ্যে ই-পাঠ্যপুস্তকের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। কেবল বই বিতরণের আওতা বাড়ানো নয়, সময়মতো পেঁৗছানোর চ্যালেঞ্জও সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। মুদ্রণ আদেশ, কাগজ সরবরাহ, কালোবাজারি প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে যে কায়েমি চক্র গড়ে উঠেছিল, তা দৃশ্যত ভেঙে গেছে। এই সাফল্যের কৃতিত্ব বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী পেতেই পারেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎপরতাও স্মরণযোগ্য। সংশ্লিষ্ট অন্যরা যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাও সাধুবাদযোগ্য। আরও আশার কথা হচ্ছে, গত তিন বছরে বিনামূল্যে বই বিতরণ ব্যবস্থায় ধারাবাহিক উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। প্রথম বছর খানিকটা দেরি হয়েছিল; বিপুল আয়োজনে সেটা অস্বাভাবিক নয়। এবার একেবারে প্রথম দিনই শিক্ষার্থীরা হাত ভরে নিয়ে ঘরে ফিরেছে। প্রত্যন্ত কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম দিন বই বিতরণ সম্পন্ন না হওয়ার যেসব খবর কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে এসেছে, সেটাকে 'পরিসংখ্যানগত তারতম্য' হিসেবেই ধরে নেওয়া উচিত। অবশ্য সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলে একদিন আগেই সেসব বিদ্যালয়ে বই পেঁৗছানো সম্ভব। আমরা আশা করি, এই সামান্য ত্রুটিও আগামী বছর সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে এ কথাও মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, বিনামূল্যে বই বিতরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রশাসনের দিকে উদ্যোগ ও দক্ষতায় ঘাটতি নেই। এখন অভিভাবকদেরও আন্তরিকতা দেখানোর সময় এসেছে। তাহলেই বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম সত্যিকার অর্থেই বছরের প্রথম দিনের সর্বজনীন উৎসব হয়ে উঠবে। সদিচ্ছা থাকলে যে সবই সম্ভব, তিন বছরের সাফল্যের মধ্য দিয়ে তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।
No comments