যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি by আরিফ জেবতিক

মাত্র কয়েক দিন আগে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া নতুন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আমার অভিবাদন নিন। যখন আপনাকে এই চিঠি লিখছি, তখন আমাদের হৃদয় রক্তাক্ত, আমাদের চোখ অশ্রুতে ভরা, আমার পাঁজর বেদনায় নীল। কারণ আমি যখন আপনাকে এই চিঠি লিখছি, তখন আমার সহকর্মী নিখিল ভদ্র চিরতরে পঙ্গু হয়ে এক অনিশ্চিত জীবনের অপেক্ষায়। ২৮ ডিসেম্বরের ওই দিনে প্রেসক্লাবের ওই বাস থেকে নিখিলের পরিবর্তে আমিও নামতে পারতাম, আমার পাও
হাঁটু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারত সরকারের ঘাতক বাস। আসলে ইদানীং আমরা যারা প্রতিদিন ঘর থেকে বের হই, তারা কেউই আর ঘরে ফিরে যেতে পারব, এমন আশা নিয়ে বের হই না। আমাদের ডেস্ক ভরে ওঠে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শত শত নিখিলের খবরে, তাদের কারো পা বিচ্ছিন্ন হয়েছে, কারো হাত বিচ্ছিন্ন হয়েছে, আর অধিকাংশই রাস্তার কালো পিচে লাল রক্তস্নান করে চিরতরে চলে গেছে নিজের মা-বাবা, স্ত্রী-স্বামী-সন্তানকে অসহায় করে দিয়ে। এর সব খবর আমরা ছাপতে পারি না, প্রতিদিন একই ধরনের খবরের স্তূপ দেখতে দেখতে বোধহীন হয়ে পড়ছি। আমাদের সংবাদপত্রের স্বল্প পরিসরে এত এত দুর্ঘটনার খবর সব ছাপতে গেলে দেশের আর কোনো খবর প্রকাশেরই স্থান সংকুলান হবে না। সুতরাং আমরা অভ্যস্ত এসব দুঃসংবাদে এবং হয়তো অপেক্ষায়ও থাকি কোনো একদিন এসব দুর্ঘটনার কোনো একটির শিকার আমিও হয়ে পড়ব নির্ঘাত। আমরা এ দেশের সাধারণ মানুষরা এভাবেই প্রতিটি দিন ঘরের বাইরে ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে পথ চলি, আপনারা তার খবরও পান না।
তবু এই ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের পক্ষ থেকে আপনাকে এই চিঠি লেখার সাহস দেখাচ্ছি, কারণ অন্তত আপনাকে আমি রাজপথে দেখেছি, আমি জানি এই রাস্তার মানুষরাই যে আপনার শেকড়, সে কথা আপনি এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাননি। আপনার পূর্বসূরিকে চিঠি লিখে সময়ের অপচয় আমি করতে যাইনি কোনো দিন, কারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় এত বোধহীন সদা হাস্যোজ্জল যোগাযোগমন্ত্রী বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে দুজন আসেননি, কামনা করি ভবিষ্যতে যেন কোনো দিন না আসেন। আপনার পূর্বসূরি আর তাঁর সদা সঙ্গী আরেক মন্ত্রী, যিনি নৌপরিবহনের চেয়ে সড়ক পরিবহনের প্রতিই বেশি আগ্রহী, তাঁদের গুণ্ডামি মার্কা কথা শুনে আমরা দাঁতে দাঁত পিষেছি শুধু। আমরা দেখেছি নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ মানুষ আর তাদের প্রতিনিধিদের কিভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। দেখেছি আপনারই দলের সংসদ সদস্য তারানা হালিম কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে সদা সোচ্চার ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিকে প্রকাশ্যে এই ঢাকা শহরে কিভাবে এই মন্ত্রীদের গুণ্ডারা লাঞ্ছিত করেছে। আমরা সব দেখেছি আর অপেক্ষায় থেকেছি। আমরা জানি, পাঁচটা বছর আপনাদের, কিন্তু একটা দিন আমাদের। যদি তত দিন বেঁচে থাকি তাহলে ছোট্ট অন্ধকার ঘরে ব্যালট দিয়ে এই দাঁতালো হাসির দাঁতভাঙা জবাব আমরা একদিন দিয়ে আসব।
কিন্তু এর আগেই আপনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। শুনেছি, চ্যালেঞ্জ নিয়েই আপনি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। আমি এই সাহসের প্রশংসা করি। কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে, যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আপনার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ পদ্মা সেতু কিংবা মেট্রোরেল নয়। যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আপনার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। এ জন্য বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজন পড়ে না, বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার প্রয়োজন নেই। ঢাকা আর দেশের বাকি অংশের সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে দিস্তা দিস্তা কাগজের গবেষণা আপনার দপ্তরে উইপোকাদের পুষ্টি জোগাচ্ছে, সেগুলো আপাতত সেখানেই থাকুক।

প্রিয় যোগাযোগমন্ত্রী,
আপনি ছোট ছোট কিছু লক্ষ্য স্থির করুন। ছোট লক্ষ্য অর্জন করা সহজ, একেকটা ধাপে একটু করে এগিয়ে যাওয়া সুবিধাজনক। আপনি শুধু এটুকু নিশ্চিত করুন যে সব বাস শুধু স্টপেজেই থামবে এবং অবশ্যই পুরোপুরি থামবে। থামার ভান করে চলতে থাকবে না। আর আপনি নিশ্চিত করুন যে বাসগুলো পরস্পরকে পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকবে না। প্রয়োজনে এক রুটের সব বাসকে একই ম্যানেজমেন্টের অধীনে নিয়ে আসুন। এ কাজটা সহজ, বিদেশে অসংখ্য দেশে এ রকম আছে। সব বাস এক কম্পানির অধীনে হলে সেগুলোর আয় সমানভাবে ভাগ করে লভ্যাংশ বিলি করা হবে, তখন বাসগুলো আর বেশি যাত্রী তোলার জন্য তাড়াহুড়ো করবে না। এই একটি পদক্ষেপই পথের নিরাপত্তা অনেকখানি বাড়িয়ে দিতে পারে। আপনি আরেকটু নিশ্চিত করুন যে মহাসড়কে ছোট ও ধীরগতির তথাকথিত হস্তশিল্পের গাড়িগুলো চলবে না, তাহলেই মহাসড়কের অনেক কাজ হয়ে যাবে। আর গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করারও কিছু নেই আমাদের, আসলেই এই গাড়িচালকরা কোনো প্রশিক্ষণ পায়নি।
আমি জানি, রাস্তায় নেমে পড়া এই গাড়িচালকদের প্রশিক্ষণ শিবিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসাটা মধ্যবিত্ত চিন্তার বিলাসিতা হয়তো, বাস্তবে এখন সম্ভব তা নয়। সে ক্ষেত্রে আপনি কি এই চালকদের সচেতন করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেবেন? কয়েকটি জনসচেতনতামূলক তথ্যচিত্র তৈরি করে কি দেশের বড় বড় বাস-ট্রাক টার্মিনালে প্রদর্শন করা যায়? তথ্যচিত্রগুলো বিটিভি আর দেশের সিনেমা হলগুলোতে বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রদর্শন করলে কেমন হয়? বাসগুলোতে কি জনসচেতনতামূলক আকর্ষণীয় পোস্টার আর স্টিকার বিতরণ করা খুব বেশি ব্যয়সাধ্য?
প্রিয় মন্ত্রী, আমি জানি এসব ছোট ছোট উদ্যোগের কোনোটাই দুঃসাধ্য নয়। শুধু প্রয়োজন সাহসী উদ্যোগ, সাধারণ মানুষের প্রতি একটু মমতা। বিএনপি এর আগে বাজারের ব্যাগ হিসেবে পলিথিন নিষিদ্ধ করে দেখিয়েছে যে মানুষের সমর্থন আছে এ রকম কিছু থামিয়ে দিতে খুব কষ্ট করতে হয় না, বরং এ কাজের জন্য মানুষ সরকারকে মনে রাখে।
আপনি সরকারের মধ্য মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েছেন। আসুন সময়কে তার দৈর্ঘ্য দিয়ে নয়, তীব্রতা দিয়ে বিচার করি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আপনি এগিয়ে আসবেন, এই সময়ের মাঝে আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনার কিছুটা হলেও উন্নতি হবে_এমন আশা করি।
মেয়াদ শেষে আপনি কিভাবে স্মরিত হবেন, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আপনার। আমরা শুধু আপনার আর আমাদের জন্য মঙ্গল কামনা করছি।
ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.