আপিল বিভাগে মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি by ওয়াকিল আহমেদ হিরন

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বর্তমানে সন্তোষজনক হারে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। অতীতের তুলনায় মামলা নিষ্পত্তির গতি অত্যন্ত শ্লথ। মূল আপিলের নিষ্পত্তির পরিবর্তে হাইকোর্টের দেওয়া অধিকাংশ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ নিষ্পত্তিতে আপিল বিভাগকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এতে মূল আপিলের সংখ্যা কোনোভাবেই কমছে না। স্তূপ আকারে জমা হচ্ছে বিচারাধীন আপিলের ফাইল। দিন দিন বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি।


যথাসময়ে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিচারপ্রার্থীরা সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সময়মতো আপিল শুনানি না হওয়ায় আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার শিক্ষক আবু বক্কর সিদ্দিকী। জাল সার্টিফিকেটের কারণে তাকে প্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরে তিনি তার বরখাস্তের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করেন। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে মামলার চূড়ান্ত রায় তার পক্ষে গেলেও প্রতিপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করে। দু'বছর ধরে ওই মামলার শুনানি হচ্ছে না। ফলে শিক্ষক আবু
বক্কর স্বপদে বহাল হতে পারছেন না।
বংশাল এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আরজু মিয়া প্রায় ২ কোটি টাকার চেক ডিজঅনার হওয়ার অভিযোগে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত রায় পাওয়ার পর বিবাদী পক্ষ রিভিউ আবেদন করে। সেই আবেদনটি যথাসময়ে শুনানি না হওয়ায় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আরজু মিয়া। এ ধরনের শত শত দেওয়ানি ও রিট মামলা এবং অনেক রিভিউ আবেদনের শুনানি দীর্ঘদিন না হওয়ায় বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না।
জানা গেছে, বর্তমানে আপিল বিভাগে রিট, ফৌজদারি-দেওয়ানিসহ ১১ হাজার আপিল মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে কয়েকশ' রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) মামলা রয়েছে। আপিল বিভাগে যেসব মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে তার অধিকাংশই হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ বা চেম্বার আদালতের দেওয়া সিদ্ধান্ত। অন্তর্বর্তীকালীন মামলা নিষ্পত্তি করতেই অধিকাংশ সময় ব্যয় হচ্ছে আপিল বিভাগের। সে ক্ষেত্রে চূড়ান্ত আপিলের শুনানির বিষয়টি আসছে অনেক পরে। অনেক বিচারপ্রার্থী দিনের পর দিন মামলা শুনানি করার জন্য আইনজীবীর পেছনে ঘুরছেন। আইনজীবীরা ওই সব মামলা শুনানির জন্য দৈনন্দিন কার্যতালিকায় ওঠাতে আপিল বিভাগে একের পর এক আবেদন জানিয়ে স্লিপ দিচ্ছেন। কিন্তু আপিল বিভাগ অনেক স্লিপ গ্রহণ করলেও পরে মামলা শুনানির তালিকায় তা আসছে না। এতে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন আইনজীবীরা। অনেক আইনজীবী জানিয়েছেন, ২০০১, ২০০২ সালের অগণিত মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন। অনেক মামলার সাক্ষী বা বাদীকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
অধিকাংশ আইনজীবীর অভিযোগ, নিকট অতীতে আপিল বিভাগে যে হারে মামলা নিষ্পত্তি হতো, বর্তমান সময়ে সেভাবে হচ্ছে না। আগে আপিল বিভাগে ৫ জন বিচারপতি ছিলেন। সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি রুহুল আমিন ও ফজলুল করিমের সময়ে আপিল বিভাগে পৃথক বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল। সে সময় প্রতি মাসে অনেক মামলা নিষ্পত্তি হতো। এখন আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতিসহ ৮ জন বিচারপতি থাকায় সে তুলনায় মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। তাদের দাবি, অচিরেই আপিল বিভাগে পৃথক দুটি বেঞ্চ গঠন করা হলে এসব আপিল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হতে পারে। তারা বলেন, বর্তমানে আপিল বিভাগে ৮ জন বিচারপতি রয়েছেন। একটি বেঞ্চে ৫ জন এবং অপর বেঞ্চে ৩ জন দিয়ে বেঞ্চ গঠন করা হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে আপিল মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব।
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, বিচারপ্রার্থীদের শেষ আশ্রয়স্থল আপিল বিভাগ। সেখানে দ্রুত নিষ্পত্তি না হয়ে বছরের পর বছর মামলা পড়ে থাকায় কার্যত বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা, যা রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের জন্য ব্যর্থতার শামিল। অবিলম্বে একাধিক বেঞ্চ গঠন করা হলে কিছুটা হলেও সমস্যা সমাধানের পথ উন্মুক্ত হবে।
আপিল বিভাগে নিয়মিত মামলা পরিচালনাকারী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল সমকালকে বলেন, অতীতে যে সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি হতো, বর্তমানে সেভাবে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। তিনি বলেন, হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো শুনানিতে অগ্রাধিকার পাওয়ায় আপিল মামলাগুলোর শুনানি হচ্ছে না। তিনি এ সমস্যা সমাধানে আপিল বিভাগে অবিলম্বে একাধিক বেঞ্চ গঠন করা উচিত বলে মনে করেন।
রিভিউ মামলা :আপিল বিভাগে শত শত রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ২০০৯, ২০১০, ২০১১ সালের অগণিত রিভিউ মামলা বিচারাধীন। কোনো রিভিউ মামলা আইনজীবীরা বারবার আবেদন করার পরও শুনানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছেন না আদালত।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার একেএম শামসুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আপিল বিভাগে ক্রমানুসারে মামলা শুনানি হয়। এখানে জনস্বার্থ, দেওয়ানি, মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে। জনগুরুত্বসম্পন্ন কোনো মামলা সংশ্লিষ্ট দৈনন্দিন কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ম্যানশন করা হলে মামলার গুরুত্ব অনুযায়ী সেগুলো আপিল বিভাগে শুনানি হয়ে থাকে।

No comments

Powered by Blogger.