ঢাকা সিটি করপোরেশনঃ আজকের হরতাল সমর্থন করছি by সৈয়দ আবুল মকসুদ, শাহ্দীন মালিক, পিয়াস করিম, নূরুল কবীর, আসিফ নজরুল
আমরা আজকের হরতাল সমর্থন করছি। বিএনপি অতীতে কিছু হরতাল করেছে ক্ষমতার রাজনীতির লক্ষ্যে কিংবা বাড়ি রক্ষা বা দুর্নীতির মামলার প্রতিবাদে। অতীতে আওয়ামী লীগও এমন কিছু হরতাল করেছে, যেখানে গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থের বিষয়টি ছিল মুখ্য। গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থে জাতির জীবনযাত্রা জিম্মি করা কোনো সচেতন নাগরিকের পক্ষে সমর্থনীয় নয়। আমরা সেসব হরতাল সমর্থন করিনি।
কিন্তু বিএনপির আজকের হরতাল ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগের বিরুদ্ধে। ঢাকা ভাগ অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও গণস্বার্থবিরোধী। এই হরতাল যদি হয় শুধু ঢাকা ভাগের প্রতিবাদে, আমরা তাতে সমর্থন করছি।
হরতাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছে, গণতন্ত্র অর্জনেও। অতীতে কিছু হরতাল গণমানুষের অধিকার ও স্বার্থকে তুলে ধরেছে। কিছু হরতাল আবার মানুষের অসীম দুর্গতি ও জাতির বিপর্যয়ের কারণ হয়েছে। জনমতের প্রকাশের পদ্ধতি হিসেবে হরতাল কর্মসূচি তাই যৌক্তিক, সুচিন্তিত ও অত্যন্ত পরিমিতভাবে দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। অন্য কোনোভাবে জনমত বা জনগণের রায় জানানোর সুযোগ না থাকলে হরতাল হতে পারে বিকল্প কর্মসূচি। ঢাকা ভাগের প্রতিবাদে আহূত হরতালকে সেভাবে দেখার কারণ রয়েছে।
বর্তমান সরকার চার শ বছরের পুরোনো ঢাকা ভাগ করতে সময় নিয়েছে মাত্র চার মিনিট। জনজীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে এমন এই সিদ্ধান্তটি নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কোনো জনমত যাচাই করেনি। সংসদ, জোট, দল এমনকি ঢাকার সাংসদ বা নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিমত জানতে চায়নি। বিএনপি বা অন্য কোনো দলও এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেনি। এখন অন্য কোনো উপায় বা সুযোগ না থাকায় অবশেষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন তাই জনগণের মতামত জানানোর অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা বিরোধী দলকে আহ্বান জানাব এই হরতাল পালনে জনগণকে বাধ্য করার মতো কোনো উগ্র কাজ করা থেকে বিরত থাকতে। সরকারকে আহ্বান করব হরতাল কর্মসূচি দমনে নিপীড়ন-নির্যাতন না চালাতে এবং অসাংবিধানিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে মানুষকে শাস্তি প্রদান না করতে। সরকারের কাছে আরও অনুরোধ করব হরতালকে ‘পরিবেশের জন্য ভালো’ এমন হালকাভাবে না দেখে এর মাধ্যমে প্রতিফলিত জনমতকে বোঝার চেষ্টা করতে।
সরকারের ঢাকা ভাগের সিদ্ধান্ত আমরা বিরোধিতা করছি এর বৈধতার প্রশ্নে এবং এর অগণতান্ত্রিকতার কারণে। ঢাকা ভাগের সিদ্ধান্ত সংবিধানের লঙ্ঘন কি না সেটি ভেবে দেখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী এবং ১ অনুচ্ছেদ অনুসারে বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। অষ্টম সংশোধনী মামলার রায় অনুসারে হাইকোর্টকে ভাগ করা ছিল রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিকতার লঙ্ঘন। ঢাকা ভাগের সিদ্ধান্ত একই মানদণ্ডে সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী বলে মনে করার কারণ রয়েছে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সব পর্যায়ে এবং ৫৯ অনুচ্ছেদে নির্দিষ্টভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বের কথা বলা হয়েছে। ঢাকা ভাগ করে পুনরায় নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত নগর প্রশাসনের দায়িত্ব অনির্বাচিত প্রশাসকের হাতে প্রদান সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন হয়েছে।
সরকার যেভাবে ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করেছে তা গণতান্ত্রিক রীতিনীতিরও পরিপন্থী। ঢাকার বিভাজন শুধু করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, করপোরেশনের সেবাভোগী, ঢাকা শহরের প্রায় দেড় কোটি মানুষকে প্রভাবিত করবে না, ঢাকাকেন্দ্রিক সারা দেশের মানুষকেও নানাভাবে প্রভাবিত করবে। অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে সরকারের উচিত ছিল অন্তত ঢাকাবাসীর মতামত গ্রহণ করা। ঢাকার সাংসদ, বিভিন্ন দলের নগর কমিটি, নগর প্রশাসনের নির্বাচিত ব্যক্তিরা এবং ঢাকাবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে এই দায়িত্ব পালন করা যেত। সর্বোপরি বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সংসদের অধিবেশনে এবং স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করারও অবকাশ ছিল। দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ, নগরবিদ, রাজনৈতিক নেতা এ বিষয়ে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং সাধারণ মানুষের একাংশ সংবাদপত্রভিত্তিক বিভিন্ন জরিপে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছেন। সরকার কয়েক মিনিটে ঢাকা ভাগের প্রক্রিয়ায় শুধু ইতিমধ্যে প্রকাশিত জনমতকে উপেক্ষা করেনি, আরও বৃহত্তর পরিসরে জনমত গ্রহণের দায়িত্ব পালনেও অনীহ থেকেছে। ঢাকাকে বিভক্ত করা যেহেতু বর্তমান সরকারের নির্বাচনী কর্মসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তাই এ বিষয়ে ব্যাপক জনগণের সম্মতি আছে কি না তা অবশ্যই জানার প্রয়োজন ছিল। এসব দায়িত্ব পালন না করে সরকার অগণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে এবং সুশাসনের ক্ষেত্রে খারাপ নজির স্থাপন করেছে বলে আমরা মনে করি।
ঢাকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের প্রকৃত সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এবং সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত নগর সরকার কাঠামো তৈরির মধ্যে। অতীতে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত মেয়র মো. হানিফ এবং সাম্প্রতিককালে বিএনপি থেকে নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এ ধরনের নগর সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করেছিলেন। উন্নত বিশ্বে এবং প্রতিবেশী কিছু রাষ্ট্রে এভাবেই রাজধানী শহরকে বিকশিত, উন্নত এবং সময়োপযোগী করা হয়েছে। কিন্তু অতীতের বিএনপি সরকারের মতো বর্তমান সরকারও শক্তিশালী ও স্বাধীন নগর সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি উপেক্ষা করেছে।
বর্তমান সরকার নগর প্রশাসনকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে বরং নজিরবিহীনভাবে একে বিভক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার যদি যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণ দিয়ে ঢাকা ভাগের তুলনামূলক সুবিধা সম্পর্কে জনগণকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হতো এবং এর পরে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে তা এখনকার মতো সমালোচিত হতো না। সরকার তা না করে সামান্য কিছু ফাঁকা আশ্বাসবাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে ঢাকা ভাগের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। সরকার দাবি করছে যে ঢাকা ভাগ হলে নাগরিক-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ঢাকাবাসীকে যাতায়াত, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন নাগরিক-সুবিধা প্রদানের দায়িত্ব যেসব প্রতিষ্ঠানের, তাদের কারও ওপরই ঢাকা সিটি করপোরেশনের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। এ অবস্থায় সরকারের এ ধরনের দাবির কোনো সারবত্তা আছে বলে আমরা মনে করি না।
ঢাকা ভাগের কারণে বরং নগর প্রশাসনের বাড়তি অবকাঠামো নির্মাণ, জনবল নিয়োগ ও দৈনন্দিন অফিস কার্যক্রম পরিচালনার বাড়তি খরচসহ বিপুল অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হবে। দেশের অর্থনৈতিক সংকটকালে এটি তাই রাষ্ট্রীয় অর্থের নিদারুণ অপচয় হবে কি না সরকার তা ভেবে দেখেছে বলে আমাদের মনে হয়নি। যে জনগণের দেওয়া অর্থ থেকে এসব খরচ জোগানো হবে, তারা বিশ্বাসযোগ্য কোনো সুবিধা ছাড়া এতে কেন রাজি হবে সে প্রশ্নও বিবেচনা করা হয়নি। ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ ও সম্মতি ছাড়া তাঁদের ওপর বাড়তি ব্যয় ও বিড়ম্বনার বোঝা একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়া শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, এটি একই সঙ্গে অনৈতিক বলে আমরা মনে করি।
সরকার যখন জনগণকে উপেক্ষা করবে, জনস্বার্থকে বিবেচনায় নেবে না, জনগণের অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহারের দায়িত্ব পালন করবে না, তখন জনগণের প্রতিবাদ ছাড়া গত্যন্তর নেই। জনগণের প্রতিবাদের এই অধিকার সংবিধানই প্রদান করেছে। আজকের হরতালকে বিএনপির প্রতি সমর্থন নয়, বরং সরকারের অগণতান্ত্রিক, অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তের প্রতি প্রতিবাদ জানানোর একটি সুযোগ হিসেবে দেখছি আমরা।
জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে এই হরতাল পালনের অনুরোধ জানাচ্ছি। হরতালকালে জনগণের জীবন, সম্পত্তি ও নিরাপত্তার অধিকার যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে দায়িত্ব পালনে আমরা সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিরোধী দলসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলকে আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখকেরা সদ্য গঠিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
আমরা বিরোধী দলকে আহ্বান জানাব এই হরতাল পালনে জনগণকে বাধ্য করার মতো কোনো উগ্র কাজ করা থেকে বিরত থাকতে। সরকারকে আহ্বান করব হরতাল কর্মসূচি দমনে নিপীড়ন-নির্যাতন না চালাতে এবং অসাংবিধানিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে মানুষকে শাস্তি প্রদান না করতে। সরকারের কাছে আরও অনুরোধ করব হরতালকে ‘পরিবেশের জন্য ভালো’ এমন হালকাভাবে না দেখে এর মাধ্যমে প্রতিফলিত জনমতকে বোঝার চেষ্টা করতে।
সরকারের ঢাকা ভাগের সিদ্ধান্ত আমরা বিরোধিতা করছি এর বৈধতার প্রশ্নে এবং এর অগণতান্ত্রিকতার কারণে। ঢাকা ভাগের সিদ্ধান্ত সংবিধানের লঙ্ঘন কি না সেটি ভেবে দেখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী এবং ১ অনুচ্ছেদ অনুসারে বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। অষ্টম সংশোধনী মামলার রায় অনুসারে হাইকোর্টকে ভাগ করা ছিল রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিকতার লঙ্ঘন। ঢাকা ভাগের সিদ্ধান্ত একই মানদণ্ডে সংবিধানের ১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী বলে মনে করার কারণ রয়েছে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সব পর্যায়ে এবং ৫৯ অনুচ্ছেদে নির্দিষ্টভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বের কথা বলা হয়েছে। ঢাকা ভাগ করে পুনরায় নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত নগর প্রশাসনের দায়িত্ব অনির্বাচিত প্রশাসকের হাতে প্রদান সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন হয়েছে।
সরকার যেভাবে ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করেছে তা গণতান্ত্রিক রীতিনীতিরও পরিপন্থী। ঢাকার বিভাজন শুধু করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, করপোরেশনের সেবাভোগী, ঢাকা শহরের প্রায় দেড় কোটি মানুষকে প্রভাবিত করবে না, ঢাকাকেন্দ্রিক সারা দেশের মানুষকেও নানাভাবে প্রভাবিত করবে। অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে সরকারের উচিত ছিল অন্তত ঢাকাবাসীর মতামত গ্রহণ করা। ঢাকার সাংসদ, বিভিন্ন দলের নগর কমিটি, নগর প্রশাসনের নির্বাচিত ব্যক্তিরা এবং ঢাকাবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে এই দায়িত্ব পালন করা যেত। সর্বোপরি বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সংসদের অধিবেশনে এবং স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করারও অবকাশ ছিল। দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ, নগরবিদ, রাজনৈতিক নেতা এ বিষয়ে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং সাধারণ মানুষের একাংশ সংবাদপত্রভিত্তিক বিভিন্ন জরিপে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছেন। সরকার কয়েক মিনিটে ঢাকা ভাগের প্রক্রিয়ায় শুধু ইতিমধ্যে প্রকাশিত জনমতকে উপেক্ষা করেনি, আরও বৃহত্তর পরিসরে জনমত গ্রহণের দায়িত্ব পালনেও অনীহ থেকেছে। ঢাকাকে বিভক্ত করা যেহেতু বর্তমান সরকারের নির্বাচনী কর্মসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তাই এ বিষয়ে ব্যাপক জনগণের সম্মতি আছে কি না তা অবশ্যই জানার প্রয়োজন ছিল। এসব দায়িত্ব পালন না করে সরকার অগণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে এবং সুশাসনের ক্ষেত্রে খারাপ নজির স্থাপন করেছে বলে আমরা মনে করি।
ঢাকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের প্রকৃত সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এবং সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত নগর সরকার কাঠামো তৈরির মধ্যে। অতীতে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত মেয়র মো. হানিফ এবং সাম্প্রতিককালে বিএনপি থেকে নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এ ধরনের নগর সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করেছিলেন। উন্নত বিশ্বে এবং প্রতিবেশী কিছু রাষ্ট্রে এভাবেই রাজধানী শহরকে বিকশিত, উন্নত এবং সময়োপযোগী করা হয়েছে। কিন্তু অতীতের বিএনপি সরকারের মতো বর্তমান সরকারও শক্তিশালী ও স্বাধীন নগর সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি উপেক্ষা করেছে।
বর্তমান সরকার নগর প্রশাসনকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে বরং নজিরবিহীনভাবে একে বিভক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার যদি যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণ দিয়ে ঢাকা ভাগের তুলনামূলক সুবিধা সম্পর্কে জনগণকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হতো এবং এর পরে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে তা এখনকার মতো সমালোচিত হতো না। সরকার তা না করে সামান্য কিছু ফাঁকা আশ্বাসবাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে ঢাকা ভাগের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। সরকার দাবি করছে যে ঢাকা ভাগ হলে নাগরিক-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ঢাকাবাসীকে যাতায়াত, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন নাগরিক-সুবিধা প্রদানের দায়িত্ব যেসব প্রতিষ্ঠানের, তাদের কারও ওপরই ঢাকা সিটি করপোরেশনের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। এ অবস্থায় সরকারের এ ধরনের দাবির কোনো সারবত্তা আছে বলে আমরা মনে করি না।
ঢাকা ভাগের কারণে বরং নগর প্রশাসনের বাড়তি অবকাঠামো নির্মাণ, জনবল নিয়োগ ও দৈনন্দিন অফিস কার্যক্রম পরিচালনার বাড়তি খরচসহ বিপুল অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হবে। দেশের অর্থনৈতিক সংকটকালে এটি তাই রাষ্ট্রীয় অর্থের নিদারুণ অপচয় হবে কি না সরকার তা ভেবে দেখেছে বলে আমাদের মনে হয়নি। যে জনগণের দেওয়া অর্থ থেকে এসব খরচ জোগানো হবে, তারা বিশ্বাসযোগ্য কোনো সুবিধা ছাড়া এতে কেন রাজি হবে সে প্রশ্নও বিবেচনা করা হয়নি। ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ ও সম্মতি ছাড়া তাঁদের ওপর বাড়তি ব্যয় ও বিড়ম্বনার বোঝা একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়া শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, এটি একই সঙ্গে অনৈতিক বলে আমরা মনে করি।
সরকার যখন জনগণকে উপেক্ষা করবে, জনস্বার্থকে বিবেচনায় নেবে না, জনগণের অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহারের দায়িত্ব পালন করবে না, তখন জনগণের প্রতিবাদ ছাড়া গত্যন্তর নেই। জনগণের প্রতিবাদের এই অধিকার সংবিধানই প্রদান করেছে। আজকের হরতালকে বিএনপির প্রতি সমর্থন নয়, বরং সরকারের অগণতান্ত্রিক, অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তের প্রতি প্রতিবাদ জানানোর একটি সুযোগ হিসেবে দেখছি আমরা।
জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে এই হরতাল পালনের অনুরোধ জানাচ্ছি। হরতালকালে জনগণের জীবন, সম্পত্তি ও নিরাপত্তার অধিকার যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে দায়িত্ব পালনে আমরা সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিরোধী দলসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলকে আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখকেরা সদ্য গঠিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
No comments