পদ্মা সেতু নির্মাণ বেসরকারি খাতে-আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য

দ্মা সেতু নির্মাণে আর বিশ্বব্যাংকের মুখাপেক্ষী থাকতে চাচ্ছে না সরকার। বহুল আলোচিত এ সেতু নির্মাণের দায়িত্ব বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। গতকাল শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা জানান। বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলো বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের দিকে না তািকয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া হবে।


এরই মধ্যে কয়েকজন বেসরকারি উদ্যোক্তা এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীরা টোলের মাধ্যমে সেতু নির্মাণের টাকা তুলে নেবে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি জেলা পরিষদে দ্রুত প্রশাসক নিয়োগের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে নেতারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জনমত সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বাম ঘরানার দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত হন। পাশাপাশি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে তৃণমূল আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজানো এবং সপ্তাহে দুই দিন তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যোগ দেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে মাইনাস করতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া ধানের ন্যায্য পাওনা না পাওয়ার জন্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর এবং গাড়িভাড়া বৃদ্ধির জন্য যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কড়া সমালোচনা করা হয়।
সূত্র জানায়, কৃষিমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বিপুল ঘোষ। তিনি বলেন, ধান-পাট উৎপাদনে কৃষকের যে খরচ হচ্ছে তা তুলতে পারছে না কৃষক। অন্যদিকে গাড়িভাড়া বাড়েনি বলে যোগাযোগমন্ত্রী বিবৃতি দিলেও গাড়িভাড়া বেড়েছে। তিনি নিজের উদাহরণ টেনে বলেন, 'আমি আগে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় আসতাম ১৮০ টাকা দিয়ে। কিন্তু এবার আসলাম ২২০ টাকা দিয়ে।
আমি নিজেই ভুক্তভোগী, তাহলে যোগাযোগমন্ত্রী কী করেন?' গত তিন বছরে সৈয়দ আবুল হোসেন কী ব্যবস্থা নিয়েছেন তা জানতে চান তিনি।
কৃষক ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না_বিপুল ঘোষের এমন মন্তব্যের বিরোধিতা করেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, 'ধান উৎপাদনে কৃষকের কোনো লোকসান নেই।' এর পরিপ্রেক্ষিতে বিপুল ঘোষ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, 'আমি নিজে কৃষক হয়ে আপনাকে বুঝিয়ে দেব কিভাবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'
বৈঠকে শেখ হাসিনা জেলা পরিষদে দ্রুত প্রশাসক নিয়োগের কথা জানান। তিনি বলেন, 'নির্বাচনের আগে কিছু লোককে আমি মনোনয়ন দিতে পারিনি। তাঁদের কথা দিয়েছিলাম, ক্ষমতায় গেলে তাঁদের ব্যাপারটা দেখব। জেলা পরিষদে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হবে।'
বৈঠকে যুদ্ধাপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তি এবং বাম দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
সূত্র জানায়, বৈঠকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, দেশে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে মাইনাস করার একটা ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি ব্যারিস্টার রফিকুল হক এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে সদ্য গঠিত নাগরিক কমিটিকে ইঙ্গিত করে বলেন, এই নাগরিক সমাজ সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে গঠিত হয়েছে।
সৈয়দ আশরাফ বলেন, এক-এগারোর শক্তি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে আছে কিছু মিডিয়া। তিনি এসব মিডিয়াকে আয়ত্তে আনতে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'এটা আওয়ামী লীগের শেষ সুযোগ এবং এবারে বিচার করতে না পারলে আর কোনো দিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে না। বয়সের কারণে মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধাপরাধীরা হয়তো আর বেশি দিন বেঁচে থাকবে না। কিন্তু মানবতাবিরোধীদের বিচার না হলে যুদ্ধাপরাধের কলঙ্ক জাতিকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।'
বৈঠকে শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের সংগঠনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, 'সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে হবে। নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে।' এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর আসন্ন মিয়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়া সফর শেষে জেলা এবং উপজেলা ইউনিটের নেতাদের সঙ্গে সপ্তাহে এক বা দুই দিন মতবিনিময় করবেন বলে জানান।
কয়েকজন নেতা জানান, বৈঠকে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রে সরকার ও আওয়ামী লীগের সমালোচনা নিয়ে কথা বলেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুর রহমান। তিনি বলেন, 'কিছু টিভি এবং পত্রিকার মালিককে দেখি প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি। দেখলে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক খুব ভালো। কিন্তু তাঁদের পত্রিকা ও টিভিতে সমালোচনা হয় সবচেয়ে বেশি। এতে সরকার বিপদে পড়ছে।' এ ব্যাপারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন।
সূত্র জানায়, এ ছাড়া বৈঠকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের শোভাযাত্রা নিয়ে কথা বলেন মহানগরের দুই নেতা এম এ আজিজ এবং মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তাঁরা বিজয় দিবসের শোভাযাত্রা ১৬ তারিখে না করে ১৭ বা ১৮ তারিখে করার প্রস্তাব দেন। তবে পরবর্তী সময়ে তা ১৬ ডিসেম্বরেই করার সিদ্ধান্ত হয়।
'আওয়ামী লীগের ভুল ছিল' : বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানান। গতবার যখন সাদেক হোসেন খোকা মেয়র নির্বাচিত হন তখন আওয়ামী লীগের নির্বাচন বর্জন করা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলেও মন্তব্য করেন সৈয়দ আশরাফ।
ডিসিসি বিভক্তি ও এ ইস্যুতে ডাকা হরতালকে 'অযৌক্তিক' আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। অরাজনৈতিক নির্বাচনে অংশ না নিলে বিরোধী দলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আজ-কালের মধ্যেই দুই সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রশাসক হিসেবে রাজনীতিবিদ নন, আমলারাই নিয়োগ পাবেন। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের দুই অংশের নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে রবিবার নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে সৈয়দ আশরাফ বলেন, এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় রয়েছে। তবে রাজনৈতিক গতিধারার ওপর ভিত্তি করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে ভবিষ্যতে কী হবে?
দেশের বৃহত্তর আরো ১৯ জেলাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হবে মন্তব্য করে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্যই এটা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.