বাম্পার ফলন : সরকারের জন্য শাঁখের করাত by এ এম এম শওকত আলী
বাম্পার ফলনে কৃষকরা সাধারণত খুশি হয়। তবে এ বছর বাম্পার ফলন কৃষকদের জন্য সর্বনাশের কারণ হয়েছে। উৎপাদন খরচের তুলনায় কৃষকরা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, এবার আমন ধানের মণপ্রতি দাম ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা মাত্র। গতবার এর দাম ছিল ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি ১৪ টাকা। মণপ্রতি হবে ৫৬০ টাকা। অর্থাৎ উৎপাদন খরচ নিয়ে কৃষকের হাতে বাড়তি আয় খুব বেশি
থাকবে না। এটাই দুঃখের কারণ। কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি নারী সংগঠন প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে গত ২০ নভেম্বর। এদের দাবি, সরকারি সংগ্রহ মূল্য বৃদ্ধি করে কৃষকরা যাতে লাভবান হয় তা নিশ্চিত করতেই হবে। এবার আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতিমধ্যে বপনকৃত ধানের ৪০ শতাংশ কাটাও হয়েছে। অথচ সরকার এখন পর্যন্ত সংগ্রহ শুরু করেনি। কৃষকরা জানে না সরকারি সংগ্রহ মূল্য কত টাকা। সংগ্রহ মূল্য সময়মতো ঘোষণা করলে তার প্রভাব অবশ্যই বাজারে দৃশ্যমান হয়। কৃষকরাও আগ্রহী হয়। এর ফলে বেসরকারি মিলারদের সঙ্গে দর কষাকষিও তাদের জন্য সহজতর হয়। বাম্পার ফলনের বিষয়টি কৃষিমন্ত্রী শাঁখের করাত হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কারণ এক কূল রক্ষা করলে আরেক কূল রক্ষা করা যায় না। কৃষকরা চায় উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য। অন্যদিকে ভোক্তার কাম্য হলো কম মূল্য। এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা দুরূহ। বিদ্যমান কৃষি ও খাদ্য নীতিতে দুই পক্ষেরই স্বার্থ সংরক্ষণ করার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এটা কোনো সময়ই রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কৃষকদের ক্ষেত্রে বলা যায়, সরকার যদি খাদ্যের সংগ্রহ মূল্য বৃদ্ধি করে, তাহলেও এর সুফল কৃষকরা ভোগ করতে সক্ষম হবে না। কারণ খাদ্য সংগ্রহ নীতিতে ধান ও চাল সংগ্রহের নির্দেশনা থাকলেও খাদ্য অধিদপ্তর সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে না। সংগ্রহের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায়ও ধানের চেয়ে চালের পরিমাণই বেশি হয়। কারণ চালকল মালিকরাই খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে নির্ধারিত মূল্যে চাল বিক্রি করে।
খাদ্য অধিদপ্তর সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ কেন করে না, তার কারণ একাধিক। এক. এক কোটিরও বেশি কৃষকের কাছে পেঁৗছানো এ দপ্তরের জন্য সম্ভব নয়। লোকবল নেই। দুই. লোকবলের জোগান দিলেও অন্য সমস্যা রয়েছে। ধান শুকাতে হবে, যাতে নির্ধারিত আর্দ্রতা রক্ষা করা সম্ভব হয়। সে ব্যবস্থা এ অধিদপ্তরের নেই। এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য চালকল মালিকরাই একমাত্র উৎস। কৃষকরা অবশ্য ধান কাটার পর এটাকে শুকানোর চেষ্টা করে। এ কারণেই দেখা যায় মহাসড়কের ওপর ধান শুকানোর চেষ্টা। অতি নগণ্য সংখ্যক বড় কৃষকের বাড়িতেও এটা করা হয়ে থাকে। চাহিদার তুলনায় তার পরিমাণ হবে অতি অল্প। তিন. ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের উদ্বৃত্ত শস্যের পরিমাণও কম। খাদ্য অধিদপ্তর এ কারণেই চালকল মালিকদের ৫০০ টন বা তার বেশি পরিমাণ চাল ক্রয় করে থাকে। সংগ্রহ ব্যবস্থাপনার জন্য এ পদ্ধতি অনেকাংশে ঝামেলামুক্ত। চার. ধান বা চাল বিক্রি করার জন্য নিকটস্থ খাদ্যগুদামে কৃষকদের যেতে হয়। এটি কৃষকদের অনুকূলে নয়। যেতে হবে অন্তত উপজেলা সদরে। আবার সব উপজেলায় খাদ্যগুদাম নেই। পাঁচ. অতীতে সাময়িক ক্রয়কেন্দ্র উপজেলার নিম্ন পর্যায়েও খোলা হয়েছিল। এ ব্যবস্থা সফল হয়নি। সাময়িক ক্রয়কেন্দ্র থেকে নিকটস্থ মূল খাদ্যগুদামে সংগৃহীত শস্য পাঠাতে হবে। বাস্তব অবস্থা সরকারি নীতিনির্ধারকরা কোনো সময়ই জনগণকে জ্ঞাত করে না। ভয় হলো, এতে জনগণ বিক্ষুব্ধ হবে। তারা জোর গলায় বলে, কৃষকদের কাছ থেকেই সরাসরি ধান নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করা হবে। বাস্তবতা জানা সত্ত্বেও তারা এসব কথা বলতে দ্বিধা করে না। এর সঙ্গে জড়িত অন্য একটি বাস্তবতা। তা হলো চালকল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করে কি কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব? এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। একটি নেতিবাচক, অন্যটি কিছুটা হলেও ইতিবাচক। এ বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেশি-বিদেশি গবেষকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। স্বল্পসংখ্যক দেশি গবেষক যুক্তি দিয়ে থাকেন, সংগ্রহ মূল্য সম্পর্কে সরকারি ঘোষণা কিছুটা হলেও বাজারে প্রভাব রাখতে সক্ষম। অন্যদিকে এ ঘোষণার ফলে ধান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কৃষকদের দরকষাকষির একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। যারা নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করে, তারা এটাও বলে থাকে, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না করার জন্য সরকারি সংগ্রহ কাঠামো বিলুপ্তির দাবি রাখে। এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব হলো, এ যুক্তিও সঠিক নয়। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়ার প্রায় সব দেশেই সরকারি পর্যায়ে সংগ্রহ ব্যবস্থা বিরাজমান। রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণেই এটা করা হয়। রাজনৈতিক যুক্তি হলো, সরকার কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আন্তরিক। এটা বোঝাতে হবে। এর সঙ্গে যোগ করা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্যও এর প্রয়োজন রয়েছে। সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য মজুদ থাকলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী দুর্গত এলাকায় পেঁৗছানো সম্ভব। এর সঙ্গে যোগ করা যায় বহু বছর ধরে প্রচলিত খাদ্যভিত্তিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচি। এর মধ্যে টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও বিনা মূল্যে দুর্গত মানুষের কাছে খাদ্য বিতরণ বা গ্র্যাটুলিয়াস রিলিফ (জিআর)। এই দুই পদ্ধতি ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তন করা হয়। মূলত ত্রাণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গেই এরা যুক্ত ছিল। এখনো আছে। তবে ষাট বা সত্তরের দশকের সময় প্রবর্তিত হয় কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা কাবিখা। সাম্প্রতিক গবেষণায় নিশ্চিত করা হয়েছে, সরকারি খাদ্যগুদামের ৭৪ শতাংশ এ উৎস থেকেই মেটানো হয়।
বাম্পার ফলনের জন্য স্বভাবতই বাজারে চাল সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। সরবরাহ বৃদ্ধি পেলেই দাম কমতে থাকে। ভোক্তারা খুশি হয়। পক্ষান্তরে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ হয়। মিডিয়ায় কয়েক দিন ধরে বলা হচ্ছে, এ বছর আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। এর আগে বোরো ফসলের ফলনও তাই ছিল। কিন্তু বাজারে দাম কমেনি। ভোক্তারাও হতাশ। কিছু সংবাদপত্রে চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এর পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতার উল্লেখ করা হয়েছে। খাদ্য ও পুষ্টি গবেষণা সংস্থার গবেষণার উদৃ্লতিও এর সঙ্গে দেওয়া হয়েছে। অভিমত হলো, মূল্য বৃদ্ধির জন্য মানুষ যতটুকু প্রয়োজন, তার তুলনায় কম খাচ্ছে। সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, এবার আর সরকারকে চাল আমদানি করতে হবে না। বাম্পার ফলন হওয়ার কারণেই তিনি এ কথা বলেছেন। তবে বাম্পার ফলন হলেই যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে, এমন কোনো কথা নেই। সময়ে সময়ে সরকারি নীতিনির্ধারকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার কারণেই এটা হয়েছে। বলা হয়, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১৪.৮০ লাখ টন চাল ও গম মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ১২ লাখ চার হাজার টন চাল এবং দুই লাখ ৭৬ হাজার টন গম। কিন্তু এর প্রভাব বাজারে দৃশ্যমান নয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারেও মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি ভারত খাদ্যশস্য রপ্তানির ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছে। এর প্রভাবও বাজারে নেই। কারণ বাজারমূল্য সেখানেও বেশি। খাদ্য অধিদপ্তর এ বছর পাঁচ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর বেশির ভাগ চাল। ক্রয় মূল্য ৪৮০ ডলার বা কেজিপ্রতি ৩৪-৩৫ টাকা। এর সঙ্গে ক্রয়মূল্য ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে প্রকৃত মূল্য আরো বেশি হবে। সরকার তা কম খরচে সরবরাহ করবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এ কারণে প্রচুর ভর্তুকিও দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেশি হওয়ার পেছনে যে অন্য কারণও রয়েছে, তা এ-সংক্রান্ত বিতর্কে খুব একটা আলোচনা করা হয় না।
বর্তমান বছরে অন্তত দুটি বিষয় স্পষ্ট। এক. কৃষি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি উপকরণে যথেষ্ট ভর্তুকি দেওয়া সত্ত্বেও এটা হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো কৃষি শ্রমিকদের মজুরিও বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ তাদেরও বাঁচতে হবে। অন্য একটি কারণ হলো এ ধরনের শ্রমিকের সংখ্যা আগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ দ্রুত নগরায়ণের ফলে এদের অনেকেই এখন অকৃষি পেশায় যুক্ত। অনেকেই বিদেশে শ্রমিকের কাজ করছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
খাদ্য অধিদপ্তর সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ কেন করে না, তার কারণ একাধিক। এক. এক কোটিরও বেশি কৃষকের কাছে পেঁৗছানো এ দপ্তরের জন্য সম্ভব নয়। লোকবল নেই। দুই. লোকবলের জোগান দিলেও অন্য সমস্যা রয়েছে। ধান শুকাতে হবে, যাতে নির্ধারিত আর্দ্রতা রক্ষা করা সম্ভব হয়। সে ব্যবস্থা এ অধিদপ্তরের নেই। এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য চালকল মালিকরাই একমাত্র উৎস। কৃষকরা অবশ্য ধান কাটার পর এটাকে শুকানোর চেষ্টা করে। এ কারণেই দেখা যায় মহাসড়কের ওপর ধান শুকানোর চেষ্টা। অতি নগণ্য সংখ্যক বড় কৃষকের বাড়িতেও এটা করা হয়ে থাকে। চাহিদার তুলনায় তার পরিমাণ হবে অতি অল্প। তিন. ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের উদ্বৃত্ত শস্যের পরিমাণও কম। খাদ্য অধিদপ্তর এ কারণেই চালকল মালিকদের ৫০০ টন বা তার বেশি পরিমাণ চাল ক্রয় করে থাকে। সংগ্রহ ব্যবস্থাপনার জন্য এ পদ্ধতি অনেকাংশে ঝামেলামুক্ত। চার. ধান বা চাল বিক্রি করার জন্য নিকটস্থ খাদ্যগুদামে কৃষকদের যেতে হয়। এটি কৃষকদের অনুকূলে নয়। যেতে হবে অন্তত উপজেলা সদরে। আবার সব উপজেলায় খাদ্যগুদাম নেই। পাঁচ. অতীতে সাময়িক ক্রয়কেন্দ্র উপজেলার নিম্ন পর্যায়েও খোলা হয়েছিল। এ ব্যবস্থা সফল হয়নি। সাময়িক ক্রয়কেন্দ্র থেকে নিকটস্থ মূল খাদ্যগুদামে সংগৃহীত শস্য পাঠাতে হবে। বাস্তব অবস্থা সরকারি নীতিনির্ধারকরা কোনো সময়ই জনগণকে জ্ঞাত করে না। ভয় হলো, এতে জনগণ বিক্ষুব্ধ হবে। তারা জোর গলায় বলে, কৃষকদের কাছ থেকেই সরাসরি ধান নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করা হবে। বাস্তবতা জানা সত্ত্বেও তারা এসব কথা বলতে দ্বিধা করে না। এর সঙ্গে জড়িত অন্য একটি বাস্তবতা। তা হলো চালকল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করে কি কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব? এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। একটি নেতিবাচক, অন্যটি কিছুটা হলেও ইতিবাচক। এ বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেশি-বিদেশি গবেষকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। স্বল্পসংখ্যক দেশি গবেষক যুক্তি দিয়ে থাকেন, সংগ্রহ মূল্য সম্পর্কে সরকারি ঘোষণা কিছুটা হলেও বাজারে প্রভাব রাখতে সক্ষম। অন্যদিকে এ ঘোষণার ফলে ধান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কৃষকদের দরকষাকষির একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। যারা নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করে, তারা এটাও বলে থাকে, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না করার জন্য সরকারি সংগ্রহ কাঠামো বিলুপ্তির দাবি রাখে। এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব হলো, এ যুক্তিও সঠিক নয়। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়ার প্রায় সব দেশেই সরকারি পর্যায়ে সংগ্রহ ব্যবস্থা বিরাজমান। রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণেই এটা করা হয়। রাজনৈতিক যুক্তি হলো, সরকার কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আন্তরিক। এটা বোঝাতে হবে। এর সঙ্গে যোগ করা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্যও এর প্রয়োজন রয়েছে। সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য মজুদ থাকলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী দুর্গত এলাকায় পেঁৗছানো সম্ভব। এর সঙ্গে যোগ করা যায় বহু বছর ধরে প্রচলিত খাদ্যভিত্তিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচি। এর মধ্যে টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও বিনা মূল্যে দুর্গত মানুষের কাছে খাদ্য বিতরণ বা গ্র্যাটুলিয়াস রিলিফ (জিআর)। এই দুই পদ্ধতি ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তন করা হয়। মূলত ত্রাণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গেই এরা যুক্ত ছিল। এখনো আছে। তবে ষাট বা সত্তরের দশকের সময় প্রবর্তিত হয় কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা কাবিখা। সাম্প্রতিক গবেষণায় নিশ্চিত করা হয়েছে, সরকারি খাদ্যগুদামের ৭৪ শতাংশ এ উৎস থেকেই মেটানো হয়।
বাম্পার ফলনের জন্য স্বভাবতই বাজারে চাল সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। সরবরাহ বৃদ্ধি পেলেই দাম কমতে থাকে। ভোক্তারা খুশি হয়। পক্ষান্তরে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ হয়। মিডিয়ায় কয়েক দিন ধরে বলা হচ্ছে, এ বছর আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। এর আগে বোরো ফসলের ফলনও তাই ছিল। কিন্তু বাজারে দাম কমেনি। ভোক্তারাও হতাশ। কিছু সংবাদপত্রে চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এর পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতার উল্লেখ করা হয়েছে। খাদ্য ও পুষ্টি গবেষণা সংস্থার গবেষণার উদৃ্লতিও এর সঙ্গে দেওয়া হয়েছে। অভিমত হলো, মূল্য বৃদ্ধির জন্য মানুষ যতটুকু প্রয়োজন, তার তুলনায় কম খাচ্ছে। সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, এবার আর সরকারকে চাল আমদানি করতে হবে না। বাম্পার ফলন হওয়ার কারণেই তিনি এ কথা বলেছেন। তবে বাম্পার ফলন হলেই যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে, এমন কোনো কথা নেই। সময়ে সময়ে সরকারি নীতিনির্ধারকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার কারণেই এটা হয়েছে। বলা হয়, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১৪.৮০ লাখ টন চাল ও গম মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ১২ লাখ চার হাজার টন চাল এবং দুই লাখ ৭৬ হাজার টন গম। কিন্তু এর প্রভাব বাজারে দৃশ্যমান নয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারেও মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি ভারত খাদ্যশস্য রপ্তানির ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছে। এর প্রভাবও বাজারে নেই। কারণ বাজারমূল্য সেখানেও বেশি। খাদ্য অধিদপ্তর এ বছর পাঁচ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর বেশির ভাগ চাল। ক্রয় মূল্য ৪৮০ ডলার বা কেজিপ্রতি ৩৪-৩৫ টাকা। এর সঙ্গে ক্রয়মূল্য ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে প্রকৃত মূল্য আরো বেশি হবে। সরকার তা কম খরচে সরবরাহ করবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এ কারণে প্রচুর ভর্তুকিও দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেশি হওয়ার পেছনে যে অন্য কারণও রয়েছে, তা এ-সংক্রান্ত বিতর্কে খুব একটা আলোচনা করা হয় না।
বর্তমান বছরে অন্তত দুটি বিষয় স্পষ্ট। এক. কৃষি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি উপকরণে যথেষ্ট ভর্তুকি দেওয়া সত্ত্বেও এটা হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো কৃষি শ্রমিকদের মজুরিও বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ তাদেরও বাঁচতে হবে। অন্য একটি কারণ হলো এ ধরনের শ্রমিকের সংখ্যা আগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ দ্রুত নগরায়ণের ফলে এদের অনেকেই এখন অকৃষি পেশায় যুক্ত। অনেকেই বিদেশে শ্রমিকের কাজ করছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments