হারেও বড় প্রাপ্তি নাসিরের সেঞ্চুরি by নোমান মোহাম্মদ

স্কোর কার্ড বলছে, দ্বিতীয় ওয়ানডের বিজয়ী দল পাকিস্তান। ব্যবধান ৭৬ রানের। স্কোর কার্ড বলছে না যে ম্যাচটি জিতেছে বাংলাদেশও! ব্যবধান ৮৬ রানের!একটু গোলমেলে ঠেকছে, তাই তো? প্রথম অংশটি অবশ্য জলবৎতরলং। পাকিস্তানের করা ২৬২ রানের জবাবে ১৮৬ পর্যন্ত যেতে পারে স্বাগতিকরা। ৭৬ রানের জয়ে তাই বছরের ষষ্ঠ ওয়ানডে সিরিজ নিশ্চিত হয় পাকিস্তানের। দ্বিতীয় অংশে বর্ণিত বাংলাদেশের জয়ের মাহাত্ম্য অন্যত্র।


একমাত্র টোয়েন্টি টোয়েন্টি এবং প্রথম ওয়ানডের কোনোটিতেই তিন অঙ্কে যেতে পারেনি তারা। কালও একসময় ওই ১০০-কে মনে হচ্ছিল আলেয়ার মতো, যা হয়তো ছোঁয়া যাবে না কিছুতেই। শেষ পর্যন্ত ১০০ ছাড়িয়ে আরো ৮৬ রান দূরে যেতে পেরেছে বাংলাদেশ। সে কারণেই অমন ভিন্ন রকম ৮৬ রানের জয়, অবশ্য যদি লাজলজ্জার মাথা খেয়ে সেটিকে জয় হিসেবে অভিহিত করা যায় আর কী!
আসলে টোয়েন্টি টোয়েন্টির ৯ উইকেটে ৮৫ এবং প্রথম ওয়ানডের ৯১ রানে অল আউটে ওই শতরানের জুজুতেই পেয়ে বসেছিল মুশফিকুর রহিমের দলকে। কাল নিজেদের ব্যাটিংয়ের ওভার দশেক যেতে না যেতে সেটি আরো বেশি করে। তাত্তি্বকভাবে তারা ইনিংস শুরু করেছিল ২৬৩ রানের লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু ৯.১ ওভারে ১৯ রান তুলতেই যখন সাজঘরে ফিরলেন প্রথম চার ব্যাটসম্যান, পরিবর্তিত হয়ে গেল টার্গেট। ২৬৩-এর স্বপ্ন তখন মিলিয়ে গেছে দূর দিগন্তে, হাঁচড়ে-পাচড়ে ১০০ করতে পারলেই হয়! শেষ ৬ উইকেটে চাই ৮১ রান_উরিব্বাস, কম কঠিন কাজ তো নয়!
নাসির হোসেন নামের এক বেপরোয়া তরুণের দুর্বিনীত আর সাকিব আল হাসান নামের এক অভিজ্ঞ যোদ্ধার সতর্ক ব্যাটিংয়ের মিশেলে হাসিল হয় সেই কাজ। কিন্তু লজ্জা কি আর মুছে তাতে! ওভারপ্রতি ৫.২৬ রানের জন্য ইনিংস শুরু করেছিল যে দলটি, ২০ ওভার শেষে তাদের রান রেট ২! স্কোর বোর্ডে ৪ উইকেটে ৪০! যদি ভাগ্যের পরশ না থাকত, তাহলে এই রান সংখ্যা হতে পারত আরো কম, উইকেটসংখ্যা আরো বেশি। সেটি হয়নি। তাতে প্রমাণ হয়েছে, ভাগ্য সব সময় সাহসীদের পক্ষেই শুধু থাকে না, অসহায়-ভীরু-দুর্বলদেরও সহায় হয় কখনো-সখনো।
নাসিরের বীরত্বগাথা অবশ্য কমছে না তাতে। এ বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেকের পর থেকেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তাঁর জাতটা আলাদা। বিরুদ্ধ স্রোতে সাঁতার কাটতেই যাঁর স্বচ্ছন্দ। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা থেকে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই যাঁর বৈশিষ্ট্য। কালও ড্রেসিংরুমে বসে থেকে দেখেছেন সতীর্থদের আত্মাহুতির মিছিল। ক্রিজে নেমে তাতে গা ভাসিয়ে দেননি নাসির। ওই একটু-আধটু ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছেন মাত্র। সে তো হিমালয় জয়ের সময় এডমন্ড হিলারিও পেয়েছিলেন। আবার শেষ পর্যন্ত এভারেস্টকে পদানত করেছিলেন ঠিকই। কালও নাসির সব বাধা-বিপত্তি জয় করে তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। তাতে যে বীরত্বরস, সেটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিরল। কোনো সন্দেহ ছাড়াই এ দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা সেঞ্চুরিটি করলেন নাসির।
কাল রানের খাতা খেলার আগেই তাঁর ব্যাটের কানায় লাগা বল গলে যায় স্লিপে দাঁড়ানো ফিল্ডার ইউনিস খানের হাত দিয়ে। উইকেটকিপার সরফরাজ সহজ ক্যাচ ছাড়েন ৯ রানের সময়। এরপর আরো বেশ কয়েকবার ব্যাটে শিস কেটে বেরিয়ে গেছে বল। কিন্তু দাঁত কামড়ে পড়ে ছিলেন ঠিকই। সুযোগ পেলেই হেনেছেন পাল্টা ছোবল। এই করতে করতেই ৯২তম বলে ষষ্ঠ বাউন্ডারিতে নাসির তুলে নেন হাফ সেঞ্চুরি। আর ইনিংসের শেষ দিকে সেঞ্চুরি তো তুলে নিলেন রূপকথার মতো করে।
বাংলাদেশের ইনিংসের ওই অন্তিমলগ্নে একমাত্র আকর্ষণ হয়ে ছিল নাসিরের সেঞ্চুরি হবে কি না। শেষ দুই ওভারে বাংলাদেশের চাই ৯৭ রান, নাসিরের সেঞ্চুরির জন্য প্রয়োজন ১৪। পরের লক্ষ্যটিই বরং বাস্তবসম্মত। আফ্রিদির প্রথম বক্কোভারের ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে পেঁৗছলেন ৯২-তে, পরেরটিতে পয়েন্ট দিয়ে স্ল্যাশ করে মারা বাউন্ডারিতে চলে আসেন সেঞ্চুরির এক স্ট্রোক দূরত্বে। এক বল পরই উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে মারতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লেগে যায় বল। উইকেটরক্ষকের সাধ্যি ছিল না সেটি ধরার। গড়িয়ে গড়িয়ে বল সীমানাছাড়া হতেই ছোট্ট ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরি পেয়ে যান নাসির। ততক্ষণে ১৩৪ বলে ১১টি বাউন্ডারি এবং এক ছক্কায় ১০০ রান তাঁর নামের পাশে। আর ৯ ওয়ানডের ৭ ইনিংসে ৪১.৮৩ গড়ে এই ডানহাতির রান ২৫১, এক সেঞ্চুরি ও দুই হাফ সেঞ্চুরির মালায়। ঈর্ষণীয় বটে!
কিন্তু এ সবই তো লড়াইয়ের গতিপথ নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পরের কথা। আগের অংশে এক সাকিব ছাড়া নাসিরের বাকি সতীর্থরা যে যারপরনাই ব্যর্থ! টস জিতে ব্যাটিং নিয়ে পাকিস্তান দেখিয়ে দিয়েছে এমন ক্রিজে কেমনভাবে ব্যাটিং করতে হয়। প্রথম ২৫ ওভারে ২ উইকেটে ৯৩ রান তুলেছিল তারা। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে পরের ২৫ ওভারে যোগ করে আরো ১৬৯ রান। তাদের এই ইনিংসে নেই কোনো সেঞ্চুরিয়ান। সর্বোচ্চ রানই মাত্র ৫৯, উমর আকমলের। কিন্তু হাফিজ (৩২), ইউনিস (৩৭), মিসবাহর (৩৭) সতর্ক ব্যাটিংয়ের সঙ্গে শেষদিকে আফ্রিদির ঝড় (২৭ বলে ৪২) যুক্ত হলে জেতার মতো রান পেয়ে যায় পাকিস্তান। এমন উইকেটে ৭ উইকেটে তোলা ওই ২৬২ রান টপকে যাওয়ার সাধ্যি তো নেই বাংলাদেশের।
তার পরও হয়তো ক্ষীণ একটা আশার রশ্মি ছিল। সেটিকে আঁধারে ডুবিয়ে দিতে দেরি করেনি স্বাগতিকদের টপ অর্ডার। ওপেনিং জুটির স্থায়িত্ব মাত্র ২১ বলের। উমর গুলের বহু দূরের বলকে তাড়া যে কেন করতে গেলেন তামিম ইকবাল, তা তিনিই জানেন! ফল, ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপে ক্যাচ। গত বছর ভারতের বিপক্ষে দেড় শ রানের ইনিংস খেলা, লর্ডস-ম্যানচেস্টারে টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি করে হৈচৈ ফেলে দেওয়া, সুবাদে উইজডেন ক্রিকেটার টেস্ট প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার পুরস্কার জেতা তামিমের এখন ঘোর দুঃসময়। জিম্বাবুয়ের ব্রায়ান ভিট্টোরিকে 'অর্ডিনারি বোলার' বলে আলটপকা মন্তব্যের পর থেকে নিজেই হয়ে গেছেন 'অর্ডিনারি'। এ বছর খেলা ১৯ ওয়ানডের মধ্যে কাল নবমবারের মতো আউট হলেন দুই অঙ্কে যাওয়ার আগে। চলতি সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ফিরেছেন রানের খাতা খেলার আগে, কাল মাত্র ৪ রান করে। ফর্মের বৈরিতার সমান্তরালে ইনজুরি নিয়ে ধোঁয়াশা আর কোচের সঙ্গে দ্বন্দ্বের গুঞ্জনে দুঃস্বপ্নের মতোই সময় কাটছে তামিমের।
সঙ্গীবিহনে ইমরুল কায়েসও (৬) বেশিক্ষণ ক্রিজে থাকেননি। হাফিজের বলে মিসবাহকে কাভারে ক্যাচ প্র্যাকটিস করিয়ে ফিরেছেন দ্রুতই। গত ম্যাচে বাদ পড়ার পর ফিরেও তাই কিছু করতে পারলেন না এ বাঁহাতি। অথচ এই ইমরুলই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ৬০ এবং নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে অপরাজিত ৭৩ করে হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। বিশ্বকাপের পর পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আছে তাঁর ৯৫ বলে ৯৩ রানের ইনিংস। এরপর? মরুপথে শুকিয়ে গেল রানের ধারা। সর্বশেষ ৯ ইনিংস মিলিয়ে ইমরুলের তাই ১৩১ রান, মাত্র ১৪.৫৫ গড়ে। দুই ওপেনারের পর শাহরিয়ার নাফীস (৭) ও মুশফিকুর রহিমও (১) স্কোরারদের খুব একটা কষ্ট দেননি। তখনই তো আরেকবার ১০০-এর নিচে গুটিয়ে যাওয়ার চোখরাঙানি ছিল বাংলাদেশের সামনে।
পঞ্চম উইকেটে নাসির-সাকিবের ১০৬ রানের জুটিতে শেষ পর্যন্ত হয়নি তা। সাবধানী সাকিবের দুই অঙ্কে যেতে লেগেছে ৪৫ বল। শহীদ আফ্রিদির করা বলটিতেই মিড উইকেটে তাঁর ক্যাচ ছাড়েন হাফিজ। নাসিরের কয়েকটি সুযোগও মিস করেছেন পাকিস্তানিরা। শেষ পর্যন্ত এই জুটি ভাঙে ৮৯ বলে ৩৪ রান করে সাকিব সাঈদ আজমলকে রিটার্ন ক্যাচ দিলে। পরের গল্পটুকুন তো নাসিরের। তাঁর বীরত্বের, তাঁর গৌরবের, তাঁর ম্যাচ অব দ্য ম্যাচ হওয়ার।
৭৬ রানে হারা কিংবা ৮৬ রানে জেতা (!) ম্যাচে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের প্রাপ্তি বলতে ওইটুকুনই। ব্যাট হাতে নাসির হোসেনের সদম্ভ চূড়ান্ত ঘোষণা, হারিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, অনেক দিন টিকে থাকার জন্যই এসেছেন তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই ভঙ্গুর সময়ে এটাই বা কম কী!

No comments

Powered by Blogger.