নুরুল ইসলামের মৃত্যুরহস্য-চাঞ্চল্যকর মামলা হলেও খোলেনি জট by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
নাগরিক সমাজ অকার্যকর তদন্তের বিষয়টিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বারবার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক পর্যায়ে মামলাটিকে দশটি 'চাঞ্চল্যকর' মামলার অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেয়। সাধারণভাবে আমরা বুঝি, এই অন্তর্ভুক্তি তদন্তে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রদানের জন্য। এরপর দু'বছর কেটে গেছে। তদন্তকাজে কোনো চাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়নি। অগ্রগতি জানা যায়নি
গণতন্ত্রী পার্টির সাবেক সভাপতি এবং মহাজোটের তৎকালীন সমন্বয়ক নুরুল ইসলাম রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর। তিনি লালমাটিয়ার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে নুরুল ইসলাম মহাজোটের প্রার্থী ছিলেন নোয়াখালীর একটি আসনে। ঢাকা থেকে নোয়াখালী যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে শুনতে পেলেন, সোনালী ব্যাংকের ঋণ খেলাপের অভিযোগে নাকি তার মনোনয়নপত্র বাতিল হচ্ছে। অথচ ঋণ তো দূরের কথা, সোনালী ব্যাংকের কথিত শাখায় তার কোনো অ্যাকাউন্টও কোনোদিন ছিল না। ষড়যন্ত্র আঁচ করে মাঝপথ থেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন। গভীর রাতে লালমাটিয়ার ফ্ল্যাটে গেলেন। ফ্ল্যাটে সেই রাতে ছিলেন তিনি ও তার একমাত্র ছেলে ইসলাম তমোহর। নুরুল ইসলামের স্ত্রী রুবী রহমান তখন আমেরিকায় ছিলেন। রাতে ফ্ল্যাটে অগি্নদগ্ধ(?) হয়ে তমোহর তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করে এবং নুরুল ইসলাম হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
পুরো ঘটনাই রহস্যময়। অগি্নদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার কথাটিও প্রশ্নবিদ্ধ। একটি মহল দাবি করছিল যে, ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিটের ফলে আগুন লেগেছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক তদন্ত শেষে পরিষ্কার রিপোর্ট দিয়েছিল, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট ঘটেনি এবং অগি্নকাণ্ডও ঘটেনি।
যারা ফ্ল্যাটটি দেখে এসেছেন, তারা সবাই লক্ষ্য করেছেন, যে ঘরটিতে কথিত অগি্নকাণ্ডে দু'জন মানুষ মৃত্যুবরণ করলেন, সে ঘরটিতে একটি বইভর্তি আলমারি রয়েছে, অথচ একটি বইয়েও এতটুকু পোড়া দাগ নেই। সোফা এবং টেবিলে পত্রিকা ও কাগজপত্র ছিল, আগুনে একটি কাগজও পোড়েনি। আলনায় কাপড়চোপড় রয়েছে, বিছানাপত্র রয়েছে। সবই অক্ষত।
ঘটনার তিন-চার মাস পরও যারা ঘরে ঢুকেছেন, তারা বলেছেন, ঢুকেই তারা তীব্র ঝাঁঝাল গন্ধ পেয়েছেন। এতদিন পরও ঝাঁঝাল গন্ধ যায়নি। আগুন লাগলে এমন গন্ধ হয় না। তাহলে এমন ঝাঁঝাল গন্ধ কিসের থেকে হয়?
লালমাটিয়ার ওই বাড়িতে অনেক ফ্ল্যাট। একেক ফ্লোরে একাধিক ফ্ল্যাট। তথাকথিত অগি্নকাণ্ডে পাশের ফ্ল্যাটে বা ফ্লোরের অন্যত্র আগুনের লেলিহান শিখা দূরের কথা, একটু তাপও ছড়ায়নি। যে ঘরে নুরুল ইসলাম ও তমোহর অগি্নদগ্ধ (?) হলেন, সেই ঘরে একটি সিলিং ফ্যান দুমড়ে-মুচড়ে রয়েছে। ফ্যানটির নিচেই খাবারের টেবিলে কয়েকটি পত্রিকা পড়ে ছিল। কাঠের টেবিলটিতে আগুনের কোনো চিহ্ন নেই, রঙও চটেনি। কাগজও পোড়েনি। অথচ ঠিক ওপরে ঝুলে থাকা সিলিং ফ্যানটি দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। অগি্নদগ্ধ (?) হয়ে তমোহর পড়ে ছিল ফ্লোরে। অথচ তার গায়ের জামাকাপড় আগুনে এতটুকু পোড়েনি। নুরুল ইসলামের গায়ের কাপড়ও পোড়েনি। পুড়েছে নুরুল ইসলামের শ্বাসনালি। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নুরুল ইসলাম একবারও আগুনের কথা বলেননি। বলেছিলেন শ্বাসনালির ভেতরে জ্বালার কথা। বলেছিলেন নাশকতার কথা। তার মৃত্যু-পূর্ব কথার ভিডিও ফুটেজ টিভি সাংবাদিকদের কাছে থেকে থাকবে।
তমোহর নাকি টেলিফোনে অনবরত হুমকি পাচ্ছিল তার বাবার বিষয়ে। 'নুরুল ইসলামের মৃত্যুক্ষণ এসে গেছে, তাকে অজু করে প্রস্তুত থাকতে বল'_ এ ধরনের কথা বলা হয়েছে তমোহরকে। তমোহর বিচলিত হয়ে নিকটজনদের কাছে নাকি তা প্রকাশও করেছিল। ইন্টারনেটে বিদেশে থাকা তার মা এবং বোনের কাছেও হুমকির কথা প্রকাশ করেছিল।
মৃত্যুকালীন ঘটনা সম্পর্কে এ রকমই জানা গেছে। এখন দেখা যাক মৃত্যু-পরবর্তী তদন্তে কী ঘটেছিল এবং কী ঘটছে। তদন্তকারীর প্রাথমিক রিপোর্টে নাকি বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে অগি্নকাণ্ড এবং অগি্নকাণ্ডের ফলে মৃত্যু, এমন ধারণাই দেওয়া হয়েছিল। পরিবার বা সুধীজন কারও কাছেই এ ধারণা গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিশেষ করে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের রিপোর্টে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, শর্ট সার্কিটের কোনো ঘটনা ঘটেনি, অগি্নকাণ্ডও ছিল না। এ পর্যায়ে মামলার তদন্ত সিআইডির কাছে হস্তান্তরিত হয়। তদন্তকারীর পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, যেখানে অগি্নকাণ্ডের কোনো লক্ষণ ছিল না, সেখানে রিপোর্টে অগি্নকাণ্ডের কথা এলো কেন? নাশকতাকারীদের বাঁচানোর জন্য? ইত্যাকার অনেক প্রশ্নের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে তদন্ত শুরু করে সিআইডি।
তদন্তকারী পরিবর্তনই সার। তদন্ত এগোচ্ছিল না। দীর্ঘদিনে তদন্তের অগ্রগতি দূরের কথা, তদন্তকাজে তৎপরতার কথাও শোনা যায়নি। নতুন তদন্তকারী সরাসরি অগি্নকাণ্ডের কথা না বললেও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছেন, কোনো ক্লু তারা খুঁজে পাচ্ছেন না।
ক্লু খুঁজে বের করার দায়িত্ব তো তদন্তকারীর। এ বিষয়ে তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অভিজ্ঞ। বিফল হওয়ার কথা তারা কেন বলবেন? এই বিফলতা কি তাদের দক্ষতার অভাব নির্দেশ করে না? নাকি পেছনের কোনো অপশক্তি তাদের টেনে রেখেছে? তারাই ভালো জানেন।
নাগরিক সমাজ অকার্যকর তদন্তের বিষয়টিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বারবার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক পর্যায়ে মামলাটিকে দশটি 'চাঞ্চল্যকর' মামলার অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেয়। সাধারণভাবে আমরা বুঝি, এই অন্তর্ভুক্তি তদন্তে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রদানের জন্য। এরপর দু'বছর কেটে গেছে। তদন্তকাজে কোনো চাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়নি। অগ্রগতি জানা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট মহল থেকে জানা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত ফ্ল্যাটের দেয়াল, মেঝে ও ছাদে যে তৈলাক্ত কালি লেগে রয়েছে, সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরি টেস্ট করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের পরীক্ষাগারে এবং বিসিএসআইআর বা সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে। উল্লেখ্য, এই কাজটি করা উচিত ছিল তদন্তকারীদের উদ্যোগে। না, তারা এই উদ্যোগ নেননি। কেন নেননি, তারাই বলতে পারবেন। এমনকি পৃথকভাবে করা এ দুটি স্যাম্পল টেস্টের রিপোর্ট সংগ্রহেও তদন্তকারী সংস্থা কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টটি সিআইডিতে পাঠিয়েছে বলে জানা যায়। তাতেও নড়েচড়ে বসেনি তদন্তকারী সংস্থা। এ পর্যায়ে কয়েক মাস আগে ফ্ল্যাটটির সামনে একটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধনে উপস্থিত হয়ে মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, মৃত্যুটি নাশকতামূলক বলে মনে করার যুক্তি রয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। এরপর সিআইডি কর্তৃপক্ষ সায়েন্স ল্যাবরেটরির টেস্ট রিপোর্টটি গ্রহণ করেছে। সিআইডির তদন্তে ধীরগতি, অনীহা, 'চাঞ্চল্যের' অভাব কি প্রমাণ করে না যে, তদন্তকারী কোনো অপশক্তির দ্বারা প্রভাবিত এবং শৃঙ্খলিত? সরকার যখন 'চাঞ্চল্যকর মামলা' হিসেবে গ্রহণ করল, তখন তদন্তে 'চাঞ্চল্য' ও অগ্রসরতা বিধানের দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। সরকারের মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পরিষ্কারভাবেই 'ক্লু'-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। সিআইডি এখন নাশকতা উদ্ঘাটনে অগ্রসর হতে পারে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরির পৃথক দুটি স্যাম্পল টেস্টের রিপোর্ট সিআইডিকে 'ক্লু' সন্ধানে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিতে পারে। সিআইডি যদি 'চোখ থাকিতে অন্ধ' হওয়ার ভূমিকায় অভিনয় করতে থাকে, তাহলে কোনোদিনই তারা ক্লু খুঁজে পাবে না, যদিও ক্লু তাদের চোখের সামনেই রয়েছে।
আগুনের আলামত নেই, তবু অগি্নকাণ্ড আখ্যায়িত করে তদন্তকারীর ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। এখন তারা সরে এসে বলছে, ক্লু পাচ্ছে না। তুলনীয় একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। কয়েক বছর আগে, শাহবাগ মোড়ে একটি বাসে 'অগি্নকাণ্ডে' বেশ ক'জন আরোহী মৃত্যুবরণ করেন। আগুনের লেলিহান শিখা ছিল না। পথচারীরা আগুন দেখেনি। বাসের বাইরের দিকটাতে আগুন লাগার আলামত নেই। কিন্তু ভেতরে আরোহীরা শ্বাসনালির প্রদাহে মৃত্যুবরণ করেছেন। বাসের সিটগুলো দুমড়ে গেছে। এ ঘটনাটিরও 'ক্লু' খুঁজে পাননি তদন্তকারীরা। বিচারও হয়নি।
মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তার মান্যবর পিতা মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের হত্যার বিচার পাননি। এমনকি তিন-চতুর্থাংশ ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার পরও বিচারে অগ্রগতি নেই। এমন অবস্থায়, নুরুল ইসলামের হত্যার ঘটনা তদন্তে অনগ্রসরতা হৃদয় ব্যথিত করলেও আশার সঞ্চার করে না। অচলাবস্থা কাটাতে হলে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সিআইডিকে মৌখিক নির্দেশ নয়, পরিষ্কার এবং অর্থপূর্ণ 'গো অ্যাহেড' সিগন্যাল দিতে হবে।
আজ নুরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। স্মরণ করি স্নেহভাজন তমোহরকে। মৃত্যুর ওপার থেকে কেউ ফিরে আসে না। তারাও আসবেন না। যারা বেঁচে আছে, ভবিষ্যতে যারা জন্ম নেবে এবং বেঁচে থাকবে, তাদের নিরাপদ জীবনের জন্য হত্যার বিচার হওয়া প্রয়োজন। সুস্থ সমাজ গঠনের প্রয়োজনে সরকারের কাছে আবেদন, নুরুল ইসলামের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন প্রয়াস কোথায় আটকে আছে, কেন আটকে আছে_ সে বিষয়ে যেন নজরদারি করা হয়। তদন্তের বাধা অপসারণ করুন। তদন্তের পর বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করুন।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : ব্যাংকার ও কলাম লেখক
পুরো ঘটনাই রহস্যময়। অগি্নদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার কথাটিও প্রশ্নবিদ্ধ। একটি মহল দাবি করছিল যে, ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিটের ফলে আগুন লেগেছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক তদন্ত শেষে পরিষ্কার রিপোর্ট দিয়েছিল, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট ঘটেনি এবং অগি্নকাণ্ডও ঘটেনি।
যারা ফ্ল্যাটটি দেখে এসেছেন, তারা সবাই লক্ষ্য করেছেন, যে ঘরটিতে কথিত অগি্নকাণ্ডে দু'জন মানুষ মৃত্যুবরণ করলেন, সে ঘরটিতে একটি বইভর্তি আলমারি রয়েছে, অথচ একটি বইয়েও এতটুকু পোড়া দাগ নেই। সোফা এবং টেবিলে পত্রিকা ও কাগজপত্র ছিল, আগুনে একটি কাগজও পোড়েনি। আলনায় কাপড়চোপড় রয়েছে, বিছানাপত্র রয়েছে। সবই অক্ষত।
ঘটনার তিন-চার মাস পরও যারা ঘরে ঢুকেছেন, তারা বলেছেন, ঢুকেই তারা তীব্র ঝাঁঝাল গন্ধ পেয়েছেন। এতদিন পরও ঝাঁঝাল গন্ধ যায়নি। আগুন লাগলে এমন গন্ধ হয় না। তাহলে এমন ঝাঁঝাল গন্ধ কিসের থেকে হয়?
লালমাটিয়ার ওই বাড়িতে অনেক ফ্ল্যাট। একেক ফ্লোরে একাধিক ফ্ল্যাট। তথাকথিত অগি্নকাণ্ডে পাশের ফ্ল্যাটে বা ফ্লোরের অন্যত্র আগুনের লেলিহান শিখা দূরের কথা, একটু তাপও ছড়ায়নি। যে ঘরে নুরুল ইসলাম ও তমোহর অগি্নদগ্ধ (?) হলেন, সেই ঘরে একটি সিলিং ফ্যান দুমড়ে-মুচড়ে রয়েছে। ফ্যানটির নিচেই খাবারের টেবিলে কয়েকটি পত্রিকা পড়ে ছিল। কাঠের টেবিলটিতে আগুনের কোনো চিহ্ন নেই, রঙও চটেনি। কাগজও পোড়েনি। অথচ ঠিক ওপরে ঝুলে থাকা সিলিং ফ্যানটি দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। অগি্নদগ্ধ (?) হয়ে তমোহর পড়ে ছিল ফ্লোরে। অথচ তার গায়ের জামাকাপড় আগুনে এতটুকু পোড়েনি। নুরুল ইসলামের গায়ের কাপড়ও পোড়েনি। পুড়েছে নুরুল ইসলামের শ্বাসনালি। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নুরুল ইসলাম একবারও আগুনের কথা বলেননি। বলেছিলেন শ্বাসনালির ভেতরে জ্বালার কথা। বলেছিলেন নাশকতার কথা। তার মৃত্যু-পূর্ব কথার ভিডিও ফুটেজ টিভি সাংবাদিকদের কাছে থেকে থাকবে।
তমোহর নাকি টেলিফোনে অনবরত হুমকি পাচ্ছিল তার বাবার বিষয়ে। 'নুরুল ইসলামের মৃত্যুক্ষণ এসে গেছে, তাকে অজু করে প্রস্তুত থাকতে বল'_ এ ধরনের কথা বলা হয়েছে তমোহরকে। তমোহর বিচলিত হয়ে নিকটজনদের কাছে নাকি তা প্রকাশও করেছিল। ইন্টারনেটে বিদেশে থাকা তার মা এবং বোনের কাছেও হুমকির কথা প্রকাশ করেছিল।
মৃত্যুকালীন ঘটনা সম্পর্কে এ রকমই জানা গেছে। এখন দেখা যাক মৃত্যু-পরবর্তী তদন্তে কী ঘটেছিল এবং কী ঘটছে। তদন্তকারীর প্রাথমিক রিপোর্টে নাকি বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে অগি্নকাণ্ড এবং অগি্নকাণ্ডের ফলে মৃত্যু, এমন ধারণাই দেওয়া হয়েছিল। পরিবার বা সুধীজন কারও কাছেই এ ধারণা গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিশেষ করে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের রিপোর্টে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, শর্ট সার্কিটের কোনো ঘটনা ঘটেনি, অগি্নকাণ্ডও ছিল না। এ পর্যায়ে মামলার তদন্ত সিআইডির কাছে হস্তান্তরিত হয়। তদন্তকারীর পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, যেখানে অগি্নকাণ্ডের কোনো লক্ষণ ছিল না, সেখানে রিপোর্টে অগি্নকাণ্ডের কথা এলো কেন? নাশকতাকারীদের বাঁচানোর জন্য? ইত্যাকার অনেক প্রশ্নের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে তদন্ত শুরু করে সিআইডি।
তদন্তকারী পরিবর্তনই সার। তদন্ত এগোচ্ছিল না। দীর্ঘদিনে তদন্তের অগ্রগতি দূরের কথা, তদন্তকাজে তৎপরতার কথাও শোনা যায়নি। নতুন তদন্তকারী সরাসরি অগি্নকাণ্ডের কথা না বললেও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছেন, কোনো ক্লু তারা খুঁজে পাচ্ছেন না।
ক্লু খুঁজে বের করার দায়িত্ব তো তদন্তকারীর। এ বিষয়ে তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অভিজ্ঞ। বিফল হওয়ার কথা তারা কেন বলবেন? এই বিফলতা কি তাদের দক্ষতার অভাব নির্দেশ করে না? নাকি পেছনের কোনো অপশক্তি তাদের টেনে রেখেছে? তারাই ভালো জানেন।
নাগরিক সমাজ অকার্যকর তদন্তের বিষয়টিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বারবার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক পর্যায়ে মামলাটিকে দশটি 'চাঞ্চল্যকর' মামলার অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেয়। সাধারণভাবে আমরা বুঝি, এই অন্তর্ভুক্তি তদন্তে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রদানের জন্য। এরপর দু'বছর কেটে গেছে। তদন্তকাজে কোনো চাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়নি। অগ্রগতি জানা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট মহল থেকে জানা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত ফ্ল্যাটের দেয়াল, মেঝে ও ছাদে যে তৈলাক্ত কালি লেগে রয়েছে, সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরি টেস্ট করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের পরীক্ষাগারে এবং বিসিএসআইআর বা সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে। উল্লেখ্য, এই কাজটি করা উচিত ছিল তদন্তকারীদের উদ্যোগে। না, তারা এই উদ্যোগ নেননি। কেন নেননি, তারাই বলতে পারবেন। এমনকি পৃথকভাবে করা এ দুটি স্যাম্পল টেস্টের রিপোর্ট সংগ্রহেও তদন্তকারী সংস্থা কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টটি সিআইডিতে পাঠিয়েছে বলে জানা যায়। তাতেও নড়েচড়ে বসেনি তদন্তকারী সংস্থা। এ পর্যায়ে কয়েক মাস আগে ফ্ল্যাটটির সামনে একটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধনে উপস্থিত হয়ে মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, মৃত্যুটি নাশকতামূলক বলে মনে করার যুক্তি রয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। এরপর সিআইডি কর্তৃপক্ষ সায়েন্স ল্যাবরেটরির টেস্ট রিপোর্টটি গ্রহণ করেছে। সিআইডির তদন্তে ধীরগতি, অনীহা, 'চাঞ্চল্যের' অভাব কি প্রমাণ করে না যে, তদন্তকারী কোনো অপশক্তির দ্বারা প্রভাবিত এবং শৃঙ্খলিত? সরকার যখন 'চাঞ্চল্যকর মামলা' হিসেবে গ্রহণ করল, তখন তদন্তে 'চাঞ্চল্য' ও অগ্রসরতা বিধানের দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। সরকারের মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পরিষ্কারভাবেই 'ক্লু'-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। সিআইডি এখন নাশকতা উদ্ঘাটনে অগ্রসর হতে পারে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরির পৃথক দুটি স্যাম্পল টেস্টের রিপোর্ট সিআইডিকে 'ক্লু' সন্ধানে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিতে পারে। সিআইডি যদি 'চোখ থাকিতে অন্ধ' হওয়ার ভূমিকায় অভিনয় করতে থাকে, তাহলে কোনোদিনই তারা ক্লু খুঁজে পাবে না, যদিও ক্লু তাদের চোখের সামনেই রয়েছে।
আগুনের আলামত নেই, তবু অগি্নকাণ্ড আখ্যায়িত করে তদন্তকারীর ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। এখন তারা সরে এসে বলছে, ক্লু পাচ্ছে না। তুলনীয় একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। কয়েক বছর আগে, শাহবাগ মোড়ে একটি বাসে 'অগি্নকাণ্ডে' বেশ ক'জন আরোহী মৃত্যুবরণ করেন। আগুনের লেলিহান শিখা ছিল না। পথচারীরা আগুন দেখেনি। বাসের বাইরের দিকটাতে আগুন লাগার আলামত নেই। কিন্তু ভেতরে আরোহীরা শ্বাসনালির প্রদাহে মৃত্যুবরণ করেছেন। বাসের সিটগুলো দুমড়ে গেছে। এ ঘটনাটিরও 'ক্লু' খুঁজে পাননি তদন্তকারীরা। বিচারও হয়নি।
মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তার মান্যবর পিতা মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের হত্যার বিচার পাননি। এমনকি তিন-চতুর্থাংশ ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার পরও বিচারে অগ্রগতি নেই। এমন অবস্থায়, নুরুল ইসলামের হত্যার ঘটনা তদন্তে অনগ্রসরতা হৃদয় ব্যথিত করলেও আশার সঞ্চার করে না। অচলাবস্থা কাটাতে হলে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সিআইডিকে মৌখিক নির্দেশ নয়, পরিষ্কার এবং অর্থপূর্ণ 'গো অ্যাহেড' সিগন্যাল দিতে হবে।
আজ নুরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। স্মরণ করি স্নেহভাজন তমোহরকে। মৃত্যুর ওপার থেকে কেউ ফিরে আসে না। তারাও আসবেন না। যারা বেঁচে আছে, ভবিষ্যতে যারা জন্ম নেবে এবং বেঁচে থাকবে, তাদের নিরাপদ জীবনের জন্য হত্যার বিচার হওয়া প্রয়োজন। সুস্থ সমাজ গঠনের প্রয়োজনে সরকারের কাছে আবেদন, নুরুল ইসলামের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন প্রয়াস কোথায় আটকে আছে, কেন আটকে আছে_ সে বিষয়ে যেন নজরদারি করা হয়। তদন্তের বাধা অপসারণ করুন। তদন্তের পর বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করুন।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : ব্যাংকার ও কলাম লেখক
No comments