মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আজিজুর রহমান by মহিবুর রহমান

ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান এমএনএর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। মোহম্মদ আজিজুর রহমান ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে ১৯২০ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তার বিপ্লবী পিতা মাওলানা আকিমুদ্দিন সরকারের হাত ধরে তিনি স্কুলজীবনে ১৯৩৭ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যান। সেখানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অন্যতম ভাবশিষ্য হিসেবে ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন এবং কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে অবস্থানকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সহচর হিসেবে কাজ করেন। অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান ১৯৭০ সালে বৃহত্তর দিনাজপুরের আসন থেকে এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য, ঠাকুরগাঁও, বালিয়াডাঙ্গি, রানীশংকৈল এবং হরিপুর থানা) নির্বাচিত হন। এরপর মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলে তিনি ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলে তিনি ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব হাতে নেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে তিনি মুজিবনগর সরকার কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ৭নং সেক্টর এবং ৬নং সেক্টরের অর্ধেক অঞ্চলের জন্য লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার হিসেবে তার সদর দফতর ছিল ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত তরঙ্গপুরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার।
স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অকুতোভয় নেতা মিত্র বাহিনীর অগ্রগামী বাহিনীর সঙ্গে ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও মুক্ত করেন। স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭২ সালে এমসিএ (কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেমবি্ল অব বাংলাদেশ) হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে নিয়োজিত হন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৬৭ জন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) এবং ৩০০ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) মিলে সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেমবি্ল অব বাংলাদেশ হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান দলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। তিনি ১৯৬০ সালের জুন মাস থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ৬ দফা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল আইয়ুবের জেল-জুলুমের ভয়ে রাজপথ থেকে যখন বেশিরভাগ নেতাই সরে দাঁড়ান, তখন মোঃ আজিজুর রহমান মাথায় গ্রেফতারের হুলিয়া নিয়েও জনতার অকুতোভয় সৈনিকের মতো গুটিকয় নেতাকর্মী নিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (দৃশ্যত কার্যকরী সভাপতি) হিসেবে রুখে দাঁড়ান। বৃহত্তর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য জীবনপণ সংগ্রাম করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দিনাজপুরে আওয়ামী লীগ ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। তিনি তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি বৃহত্তর দিনাজপুর আওয়ামী লীগ রাজনীতির অপরিহার্য এবং শীর্ষ নেতা হয়ে ওঠেন।
মোঃ আজিজুর রহমান তার ঘাসিপাড়াস্থ ভাড়া বাড়িতে নিভৃতে বিনা চিকিৎসায় ইন্তেকাল করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের স্বর্ণ সন্তান এই অকুতোভয় আর নির্লোভ জননেতা দিনাজপুর শহরের সোনাপীর গোরস্থানে ঝোপঝাড়-আগাছায় ভরা একটি স্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত।

No comments

Powered by Blogger.