এইডস হতে দেব না

দেহের প্রতিরোধশক্তি সুস্থ রয়েছে এমন লোকদের মধ্যে যেসব সাধারণ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও পরজীবী গুরুতর রোগ ঘটাতে পারে না, সেগুলোও এইচআইভিতে আক্রান্ত লোকদের মধ্যে ঘটায় সুবিধাবাদী মারাত্মক অসুখ। আর মৃত্যুও ঘটে সে জন্য। মানুষের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান পথ হলো অনিরাপদ যৌন মিলন। অবশ্য অনিরাপদ রক্ত নিলে, নেশার ওষুধ গ্রহণকারী লোকদের সংক্রমিত সুচ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করলে, সংক্রমিত মা থেকে শিশুর


মধ্যে এ সংক্রমণ ঘটতে পারে।পৃথিবীতে এইডসের জীবাণু বহনকারী লোকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেই ১৯৮০ সালের দিকে এইডস প্রথম শনাক্ত হয়েছিল। এর পর থেকে পৃথিবীজুড়ে অনেক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, সারাবিশ্বে এইচআইভি/এইডস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ৩৩ মিলিয়ন। প্রতিবছর পঞ্চাশ হাজার লোক নতুন করে এইডস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এইডস বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হচ্ছে ১ ডিসেম্বর ১৯৮৮ সাল থেকে। এইডস সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশ্ব এইডস দিবসে লাল রঙের রিবন পরিধান করতে হয়। নিউইয়র্কের ভিজুয়াল এইডস শিল্পী কাওকাস ১৯৯১ সালে এর প্রচলন করেন। সচেতনতা বৃদ্ধির রূপক হলো লাল রিবন, এর পেছনে বাণিজ্যিক কোনো উদ্দেশ্য নেই। এ রোগের জন্য দায়ী একটি ভাইরাস_ হিউম্যান ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি)।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো 'শূন্যের কোঠায় পেঁৗছাতে হবে' আর স্লোগান হলো 'কোনো বৈষম্য নয়, আর এইডস রোগ অথবা এইডসজনিত মৃত্যু হতে দেব না'।
এইডস প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকরা কিছু রোগীর মধ্যে অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখতে পান। প্রথমে দেখা যায় নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু প্রমোদবালকের মধ্যে এমন কিছু অসুখ, যেমন_ কাপোসিস সার্কোমা_ ত্বকের বিরল এক ধরনের ক্যান্সার এবং নিউমোসিস্টিক কারিনি নিউমোনিয়া_ পাখিবাহিত শ্বাসতন্ত্রের রোগ। পরপরই এ রকম অসুখ দেখা গেল শিরায় নেশার ওষুধ নেয় কিংবা অনিরাপদ রক্ত নিয়েছে এমন লোকদের মধ্যে। ১৯৮২ সালে এ রোগের একটি নামও হলো_ 'অ্যাকোয়ার্ড ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম'-সংক্ষেপে এইডস। এইডস রোগের মূলে আছে যে ভাইরাস, এর নাম 'হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস' বা এইচআইভি। সংক্রমিত দেহতরলের সরাসরি সংস্পর্শে ছড়ায় এ সংক্রমণ। এই ভাইরাস আক্রমণ করে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে। সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা খর্ব হতে থাকে শরীরের, আর শরীর অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে সরল-সহজ জীবাণুর সংক্রমণের কাছে। দেহপ্রতিরোধী সেই কোষগুলো হলো এক ধরনের শ্বেতকণিকা_ 'টি কোষ' বা ঈউ৪ কোষ। বলা হয় যে, এইচআইভিতে সংক্রমিত লোকদের দেহে এই কোষ গণনা যখন ২০০-এর নিচে পেঁৗছায়, তখনই এইডস রোগের সূচনা হয়। এইডস কেবল একটি রোগ নয়, কয়েকটি রোগের সমষ্টিরূপে প্রকাশ পায়। এ জন্য এর নামকরণ করা হয়েছে 'সিনড্রোম' বা 'রোগসমষ্টি'।
দেহের প্রতিরোধশক্তি সুস্থ রয়েছে এমন লোকদের মধ্যে যেসব সাধারণ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও পরজীবী গুরুতর রোগ ঘটাতে পারে না, সেগুলোও এইচআইভিতে আক্রান্ত লোকদের মধ্যে ঘটায় সুবিধাবাদী মারাত্মক অসুখ। আর মৃত্যুও ঘটে সে জন্য। মানুষের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান পথ হলো অনিরাপদ যৌন মিলন।
অবশ্য অনিরাপদ রক্ত নিলে, নেশার ওষুধ গ্রহণকারী লোকদের সংক্রমিত সুচ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করলে, সংক্রমিত মা থেকে শিশুর মধ্যে এ সংক্রমণ ঘটতে পারে। সংক্রমিত সুচের আঘাত পেলে, সংক্রমিত রেজার বা ক্ষুর ব্যবহার করলে। দেহযন্ত্র সংস্থাপনের মাধ্যমেও কদাচিৎ সংক্রমণ ঘটতে পারে।
তবে কোলাকুলি, করমর্দন, স্পর্শ, থালাবাসন ব্যবহার, টয়লেট শিট ব্যবহার, হাঁচি -কাশির মাধ্যমে, খেলাধুলা ও পতঙ্গের দংশনে এইচআইভি ছড়ায় না।
এ রোগের চিকিৎসা হয় ভাইরাসরোধক ওষুধ দিয়ে; তবে নিরাময় হয় না। আর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, করাও কঠিন। টিকা আবিষ্কার সুদূরপরাহত। তাই প্রতিরোধই এর প্রধান উপায়।
এইডস সম্পর্কে জানতে হবে, সবাইকে জানাতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মিলনকে, সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধকে, ধর্মীয় অনুশাসনকে এইডস রুখতে যাওয়ার পথে প্রধান উপায় বলে আমাদের জানতে হবে।
নিরাপদ যৌন মিলন, কনডম ব্যবহার_ এসব বিষয়ও প্রতিরোধের উপায় হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। 'নিরাপদ যৌনতা' বিষয়টি শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে বোঝাতে হবে। অনিরাপদ রক্ত না নেওয়া, একবার ব্যবহার্য (ডিসপোজেবল) সুচ ও সিরিঞ্জের ব্যবহার, সেলুনে রেজার বা বেল্গড নতুন ব্যবহার করা, গর্ভধারণের আগে সংক্রমিত মায়ের চিকিৎসা পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
পৃথিবীর এইচআইভি ঝুঁঁকির সম্মুখীন এক-পঞ্চমাংশ লোক এইডস প্রতিরোধের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। এইচআইভি বহনকারী দশ জনের মধ্যে মাত্র একজনকে এ পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। আর নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশগুলোতে এইচআইভি থেকে রক্ষাকারী ওষুধ যাদের প্রয়োজন তার মাত্র ২৫ শতাংশ রোগী বর্তমানে পাচ্ছে। ৭৫ শতাংশ রোগী জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে বঞ্চিত।
বিশ্বের এইচআইভি বহনকারী মানুষের মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই বসবাস করে সাব-সাহারা দেশগুলোতে। বাংলাদেশের মতো নাজুক অর্থনীতির দেশের জনগণের অবস্থা কতটা নিরাপদ তা উপাত্ত দিয়ে অনুভব করা সম্ভব নয়। দিন দিন বেশিসংখ্যক মানুষ এইডসের জীবাণু বহন করছে এবং ঝুঁঁকিপ্রবণ মানুষের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। একই সঙ্গে যদি সংক্রমণ রোধের ব্যাপক ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে অসংখ্য মানুষকে এ প্রাণঘাতী রোগে মৃত্যুবরণ করতে হবে।
ডো. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার
সহকারী অধ্যাপক
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

No comments

Powered by Blogger.