কেমন আছ মা-চোখের সব জল বুকের ভেতরে নেমে আগুন হয়ে জ্বলছে-মজবুল নেসা
বিজয়ের ৪০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এই ডিসেম্বরে। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের মায়েরা কেমন আছেন, তা নিয়েই ধারাবাহিক এই আয়োজনশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গেও আমি পুত্র আবদুল জব্বারকে ডাকি; ডেকে ডেকে কেঁদে কেঁদে চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ঘন শ্বাসের কারণে দম আসে-যায় অবস্থা। হাঁপানির ওষুধ ঠিক মতো খেতে না পারায় ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেছি। এখন আর দাঁড়িয়ে চলাফেরা করতে পারি না, বসে বসেই চলাফেরা করি।
প্রতিদিন কবরের পাশে বসে ছেলের জন্য কাঁদি আর ছেলের কবরের আগাছা পরিষ্কার করি। ৪০ বছর ধরে কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখের সব জল বুকের ভেতরে নেমে আগুন হয়ে জ্বলছে। আমার মতো হাজার হাজার শহীদ-মাতা ও সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের বুকের ভেতরের সেই তুষের অনলে কবে পুড়ে খাক হবে রাজাকার, আল-বদর আর স্বাধীনতা বিরোধীরা? শেখের বেটিকে আমি অনুরোধ জানাই, সব যুদ্ধাপরাধীকে যেন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারে। তাহলেই আমাদের বুকের ভেতরের তুষের আগুন নিভবে। কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলেই শান্তি পাবে আমার সন্তান আবদুল জব্বারের আত্মা। আমার বুকের আগুন নিভবে। আমি মরে শান্তি পাব।
অভাবের পরিবার আমাদের। আমার আট সন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তান আবদুল জব্বার ছিল শান্ত স্বভাবের, নিমগ্ন কিশোর। সুনামগঞ্জ এইচএমপি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় অভাবী পরিবারের হাল ধরতে আনসার বাহিনীতে চলে যায়। যুদ্ধ শুরু হলে নাম লেখায় মুক্তিবাহিনীতে। ৫ নং চেলা সাব-সেক্টরে মেজর মোতালেব ছিলেন কমান্ডার। কম্পানি কমান্ডার বীরপ্রতীক এনামুল হকের অধীনে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করে আমার ছেলে আবদুল জব্বার। এক দিন খবর পাই, ছেলেটিকে গুলি করে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানি বাহিনী। ৫ ডিসেম্বর রাতে সুনামগঞ্জের মধুমিতা হোটেল এলাকায় আমার ছেলেকে গুলিতে ঝাঁজরা করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। পরের দিন তার সহযোদ্ধারা বাড়িতে এসে লাশ রেখে যায়। আমার ছেলের বুক-পেট-উরু-হাত-পা ঝাঁজরা ছিল গুলিতে; লাশ দেখে আমি স্থির থাকতে পারিনি। সেই যে কান্না শুরু হয়েছিল, সেই কান্না এখন অশ্রুহীন। অশ্রু ঝরতে ঝরতে আমি এখন চোখে দেখতে পাই না। ছেলে হারানোর শোকের কান্না শুকিয়ে বুকের ভেতর আগুন হয়ে জ্বলছে। আমি চোখে দেখতে না পেলেও রাজাকার যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখে মরতে চাই। যাদের কারণে আমার বুকের ধনসহ হাজার হাজার সন্তান শহীদ হয়েছে, তাদের বিচার হলে মরেও শান্তি পাব।
আবদুল জব্বার যুদ্ধে যাওয়ার আগের দিন শেষবারের মতো আমার কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিয়ে যায়। পাতে তুলে আমাকে ভাত খাওয়ায়। অন্যদিনের মতো আলাদা করে সেবা শুশ্রূষা করে। রাতে পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় নেয়; বলে যায়, আমার ফিরে আসার অপেক্ষা করো না মা। যুদ্ধে আমি মারা গেলে তোমার অন্য চার ছেলেসহ হাজার হাজার বাঙালি সন্তানের মধ্যে আমাকে খুঁজো। দোয়া কর, যাতে মাতৃভূমিকে তোমার জন্য স্বাধীন-মুক্ত জায়নামাজ করে দিয়ে যেতে পারি। সেই যে দেশ স্বাধীনের প্রত্যয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল রাতের আঁধারে_খোকা আর ফেরেনি। এসেছিল সহযোদ্ধাদের কাঁধে চড়ে রক্তমাখা জামা গায়ে।
আবদুল জব্বার শহীদ হওয়ার পরদিন খবর পাই। ওই দিন স্থানীয় লোকজনকে হাত-পা ধরে ছেলের লাশ আনার জন্য অনুরোধ করি। ভয়ে কেউ যেতে চায়নি। কিন্তু আমার কান্নার কাছে পরাজিত হয়ে নদীর ওপারে গিয়ে লাশ আনে লোকজন। ক্ষত-বিক্ষত আমার বুকের ধনকে দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ছেলের লাশ দেখে তার বাবা ঘরবন্দি হলো; এরপর ঘর থেকে খুব কম বের হতেন। সারাক্ষণ নাওয়া-খাওয়া ভুলে ছেলের নাম জপত। যুদ্ধের তিন বছর পর তার বাবাও মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর চার ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়ি। ঠিক মতো খেতে পেতাম না। ছোট ছোট ছেলেরা শ্রমিকের কাজ করে সংসারে হাল ধরে। জীবনভর এই মাটির ঘরেই আছি।
আমার ছেলেকে মেরেও পাকিস্তানি হায়েনারা ক্ষান্ত হয়নি। সে যুদ্ধে গেছে_ এই অপরাধে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হায়েনারা আমাদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলে। ছেলের লাশ কোনো মতে দাফন করে সপরিবারে চলে যাই ভারত সীমান্তের ডলুড়া এলাকায়। দেশ স্বাধীনের প্রায় ছয় মাস পর আমরা ফিরে আসি। ছেলে শহীদ হওয়ার পর আমার স্বামী আবদুস সাত্তার অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েন। কথা বলতেন কম। সব সময় অন্য মনস্ক থাকতেন। জমিজমা না থাকায় বড় কষ্ট করে সেই থেকে খেয়ে-না খেয়ে বেঁচে আছি। রোগ-শোকে কাতর থাকি সব সময়। কোনো মতে খাবার জোটলেও ওষুধ জোটানো কঠিন। যুদ্ধের পাঁচ বছর পর একমাত্র মুরগিটি বিক্রি করে শহীদ মাতার ভাতার জন্য ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করেছিলাম। এরপর থেকে এই ভাতায় কোনো মতে চলছি। আর কোনো অবলম্বন নেই। এখন অন্য চার ছেলের সবাই পৃথক। আমি ছোট ছেলের কাছে থাকি। তার পাঁচ সন্তান। আমার এক মেয়ের স্বামী মারা যাওয়ায় সেও এখন তার বাচ্চা নিয়ে আমাদের কাছে থাকে। খুব কষ্টে যাচ্ছে দিনকাল। এর মাঝেই আবার প্রতিবেশী আমার বাড়ির প্রায় ৩০ শতাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে। এ নিয়ে ছেলেপুলে ও নাতিরা ঝগড়া করতে চায়। আমি তাদের থামিয়ে রাখি। বড় ছেলেকে হারিয়েছি আর কোনো সন্তানকে হারাতে চাই না। দখলদারদের কাছ থেকে জায়গা উদ্ধার এবং শহরে মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে সরকারি জায়গা বন্দোবস্ত করে দেবে বলে বরকত নামের একজন আমার কাছ থেকে সাত হাজার টাকা নিয়েছে। সুদে এনে ওই টাকা দিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন হলো কিছুই হয়নি, তার দেখাও পাই না। উল্টো এই টাকার সুদ গুনতে হচ্ছে আমার অভাবী ছেলেদের।
গ্রামের মাঠে দাপিয়ে ফুটবল খেলত আমার কিশোর ছেলে আবদুল জব্বার। কারো সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়া করেনি। অভাবের সংসারে কোনো দিন কোনো আবদারও করেনি। সাধ্য অনুযায়ী যা দিতাম, তাই খেত। ছেলেটি অনেক মায়া করত আমাকে। নিজে আমার কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিত। বিছানা ঝেড়ে দিত। অসুখ-বিসুখ হলে সারা রাত জেগে শুশ্রূষা করত। তার ছোট ভাই-বোনদেরও অনেক মায়া করত।
যুদ্ধের তিন বছর পর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আমার ছেলের কবর পাকা করে দেয়। ওই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে সান্ত্বনা জানিয়ে একটি পত্র দেন। পত্রের সঙ্গে জেলা প্রশাসন থেকে দুই হাজার টাকার অনুদান আনতে বলেন। শেখ সাহেবের চিঠিটি আমি এখনো যত্নে রেখেছি। সুনামগঞ্জ সর্বদলীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী যত দিন বেঁচেছিলেন তত দিন আমার খোঁজ নিতেন। মাঝেমধ্যে তাঁর বাড়িতে নিয়ে খাওয়াতেন। আসার সময় কাপড়-চোপড়, টাকা-পয়সা দিতেন। এখন কেউ আমার খোঁজ নেয় না। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসেও কেউ স্মরণ করে না। এসব দিনেও ছেলের কবরটি অনাদরে পড়ে থাকে। আমি শুধু কবরের পাশে বসে কাঁদি।
আমার ছেলেটিকে বসতঘরের পেছনেই কবর দিয়েছিলাম আমার ইচ্ছায়, যাতে সব সময় ছোটবেলার মতো আমার চোখে চোখে থাকে। আমি মুর্খ-সুর্খ মানুষ। সব সময় কবর দেখে ছেলের জন্য দোয়া করি। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এলে যদি স্মরণে থাকে_তাহলে ভোরে ওঠে ছেলের কবরের কাছে গিয়ে আল্লার কাছে কান্নাকাটি করি। ছেলের জন্য দোয়া-দরুদ পড়ি। কিন্তু আমি স্মরণ করলেও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বা সরকারের পক্ষ থেকে কবরে এসে শ্রদ্ধা জানায় না কেউ। নাতি-নাতনিদের গর্ব করে আমার ছেলের বীরত্বগাঁথা শোনাই। আগ্রহ ভরে তারাও শোনতে চায়। বুঝে-না বুঝে চোখের পানি ফেলে। তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু এসব করবে কে?
মজবুল নেসা : সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রাজারগাঁও গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জব্বারের মা
অনুলিখন : শামস শামীম, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
No comments