আন্দোলন ও ভোটের হাওয়া-সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীদের পোস্টার ফেস্টুনে এলাকা ছেয়ে গেছে by শাহেদ চৌধুরী ও লোটন একরাম

নেকটা হঠাৎ করেই রাজনীতির মাঠ গরম হতে শুরু করেছে। সরকার ও বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) বিভক্তি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। বিএনপি আজ রোববার ঢাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। হরতালের নামে বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকারি দল। হরতালের পর লাগাতার আরও কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিরোধী দল।


এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতারা নতুন করে বাগ্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির প্রতিবাদে লাগাতার আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ডিসিসি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না। এর জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, 'নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের মতো রাতের আঁধারে পালিয়ে যাবেন না। ডিসিসি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনমত যাচাই করুন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা হেরে গেলে বিএনপির সমালোচনা মেনে নেওয়া হবে।'
এ ধরনের তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে দুই ধরনের আবহ তৈরি হয়েছে। বিএনপি আন্দোলনে নেমেছে। একই সঙ্গে বইতে শুরু করেছে ভোটের হাওয়া। বিএনপি অবশ্য এখন পর্যন্ত দলীয়ভাবে নির্বাচন বর্জন কিংবা বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে তারা কৌশলী হয়ে নাগরিক কমিটির ব্যানারে প্রার্থীদের সমর্থন দেবেন বলেই বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন।
সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেও বিষয়টি এখন আদালতে রয়েছে। ঢাকাকে বিভক্ত করার প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠেছে কম-বেশি সবাই। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও এর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে বেশ শক্ত ভাষায়। আওয়ামী লীগেরও অনেক নেতাকর্মী ঢাকার হৃদয়কে দুই ভাগ করার কারণ খুঁজছেন। সরকারের পক্ষ থেকে দুই ভাগের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলা হয়েছে, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত নতুন রাজধানী বিনির্মাণে ঢাকাকে দুই ভাগ করা হয়েছে। নগরবাসীরা অবশ্যই এর সুফল পাবে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের বর্তমান
ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে যারা সরকার সমর্থক, তারাও এ যুক্তি মানতে নারাজ। তারা এক বাক্যে ঢাকাকে দুই ভাগ করার বিপক্ষে স্পষ্ট অভিমত দিয়েছেন।
বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিতে রাজনৈতিক কারণে সরকার ঢাকাকে দুই ভাগ করেছে। এক ঢাকায় নির্বাচন হলে সরকারি দলের প্রার্থীর বিজয়ের সম্ভাবনা কম বলেই এমন অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এতেও সরকারের শেষ রক্ষা হবে কি-না, সেটা সন্দিহান। এর ফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েনও বাড়বে।
ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে নানা কথা রয়েছে। অবিভক্ত ঢাকার মেয়র মন্ত্রী মর্যাদার হলেও বিভক্ত ঢাকার মেয়রের মর্যাদা হবে প্রতিমন্ত্রীর। তাই অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা বিভক্ত ঢাকায় নির্বাচন করতে আগ্রহী হবেন না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ইভিএম (ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন) পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রতিবাদে কুমিল্লার নির্বাচন বয়কট করছে বিএনপি। ঢাকায় ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি নির্বাচন কমিশন। চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি ওয়ার্ডে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামে বিএনপির মনজুর আলম জয়ী হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের একেএম শামীম ওসমান হেরে গেছেন। এদিকে ইভিএমের ব্যাপারে বিএনপি অতীতের অনীহা পরিহার করে ইভিএমের আদ্যোপান্ত জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ঢাকাকে বিভক্ত করার প্রতিবাদে আজ হরতাল ডাকলেও এখানেই বিএনপি থেমে থাকবে না বলে আভাস দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তারা দাবি আদায়ে বদ্ধপরিকর। গতকাল তিনি বিভক্তির বিষয়ে সরকারকে 'গণভোট' জনমত যাচাইয়ের আহ্বান জানিয়েছেন।
একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিতে চাইছে না বিএনপি। এ ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে নেপথ্যে থেকে নাগরিক কমিটির প্রার্থীদের সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি চিন্তা-ভাবনায় রাখা হয়েছে। আসন্ন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও প্রায় একই কৌশল গ্রহণ করেছে দলটি। রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন বর্জন করলেও দলের জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কু 'বিদ্রোহী' প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন।
নাগরিক কমিটির ব্যানারে বিএনপি মেয়র প্রার্থী হিসেবে যাকে সমর্থন দিতে পারেন তিনি হলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরী। তিনি উত্তর ঢাকায় মেয়র পদের জন্য নির্বাচনে লড়তে আগ্রহী। দক্ষিণ ঢাকার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে কারোর নাম শোনা না গেলেও ভেতরে ভেতরে কয়েকজন প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হলেও বিএনপি ঘরানার রাজনীতিতে বর্তমানে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম নিয়ে আলোচনা করছেন দলের নেতাকর্মীরা। সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু, ঢাকার সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস এবং বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ।
সরকারি দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সমর্থকরা ইতিমধ্যেই মাঠে নামতে শুরু করেছেন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হরেক রকমের পোস্টার-ফেস্টুন শোভা পাচ্ছে। নগরবাসীকে ঈদ শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। অনেকে হজ করে এসেছেন। এখন গ্রুপ বৈঠক করে এলাকাবাসীর সমর্থন চাইছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। তারা গণসংযোগ করছেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়ের পর দোয়া চেয়েছেন সব ক'জন সম্ভাব্য প্রার্থী।
মসজিদে দোয়া চাইতে গিয়ে অবশ্য বিপাকে পড়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের একজন। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এলাকা হিসেবে পরিচিত টিকাটুলির একটি মসজিদে একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে জুমার নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়ার মতো অপচেষ্টাও হয়েছে। আওয়ামী লীগের ওই প্রার্থী অবশ্য শেষতক ওই মসজিদে নামাজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। এ জন্য তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার দৃষ্টিতে, দক্ষ সংগঠক হওয়ার পরেও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল সমর্থিত প্রার্থী একেএম শামীম ওসমান ইমেজ সংকটের কারণে হেরে গেছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় সমর্থনের বেলায় আবারও একই ধরনের ভুল করতে নারাজ দলের হাইকমান্ড। এ কারণেই সব দিকে ভেবেচিন্তে প্রার্থী বাছাই করা হবে। বর্তমানে সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলের সমর্থন পাওয়ার জন্য নীতিনির্ধারক মহলে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেছেন। ঢাকাকে দুই ভাগ করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত এবং এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টারও ছেপেছেন তারা। আগামী ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েও পোস্টার-ফেস্টুন টাঙ্গানোর উদ্যোগ রয়েছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পক্ষ থেকে।
সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় এখন নামের ছড়াছড়ি। তাদের মধ্যে ঢাকা উত্তরে রয়েছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, ঢাকা-১০ আসনের সাংসদ একেএম রহমতুল্লাহ এবং ঢাকা-১৫ আসনের সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার। ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হক আসলাম, এখলাস উদ্দিন মোল্লাও সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় আছেন।
ঢাকা দক্ষিণের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ঢাকা-৯ আসনের সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী, ঢাকা-১২ আসনের সাংসদ ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এবং ঢাকার সাবেক সাংসদ হাজী মোহাম্মদ সেলিম। এ ছাড়াও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ এবং ঢাকা-৬ আসনের সাংসদ মিজানুর রহমান খান দীপুর নামও শোনা যাচ্ছে।
প্রচার-প্রচারণা ও আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, একেএম রহমতুল্লাহ, কামাল আহমেদ মজুমদার, মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, সাবের হোসেন চৌধুরী এবং হাজী মোহাম্মদ সেলিম। মেয়র পদে সাংসদদের প্রার্থী হতে বিধিনিষেধ রয়েছে। এ অবস্থায় আলোচিত প্রার্থীদের মধ্যে যারা সাংসদ, তারা দলের সমর্থন পাবেন না। সে ক্ষেত্রে উত্তর ঢাকায় দলের বাইরে থেকে অন্য কাউকে সমর্থন করার বিষয়টি চিন্তা-ভাবনায় রাখা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, দলীয় সমর্থনের বেলায় আগামীতে সরকার পরিবর্তনের পর মেয়রের ভূমিকার সম্ভাব্যতার কথা চিন্তা-ভাবনা রাখা হবে। আগামী নির্বাচনে ঢাকার মেয়র মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন। মেয়রের পতাকা পেলে উল্টে যেতে পারেন, এমন কাউকে সমর্থন দেওয়া হবে না। এ অবস্থায় নগর নেতাকর্মীরা পরীক্ষিত নেতৃত্বকে সমর্থন দেওয়ার পক্ষে রয়েছেন।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, তিনি নির্বাচনে লড়ার জন্য ষোল আনা প্রস্তুত। ঢাকা-১০ আসনের সাংসদ একেএম রহমতুল্লাহ বলেছেন, তিনি সাদা কাপড়ের মানুষ। তার গায়ে কোনো দাগ নেই। ঢাকা-১৫ আসনের সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার তার বিকল্প হয়ে আওয়ামী লীগের অন্য কেউ ভোট টানতে পারবেন না বলে মন্তব্য করেছেন।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, তিনি ঢাকার সন্তান। তার বাবা প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ঢাকাবাসীর সুখে-দুঃখে থেকেছেন। তিনিও বাবার মতো ঢাকাবাসীর জন্য সুখে-দুঃখে আছেন এবং সব সময় থাকবেন। ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন পেলে নির্বাচনে লড়বেন বলে জানিয়েছেন। ঢাকার সাবেক সাংসদ হাজী মোহাম্মদ সেলিমের মতে, ভোটযুদ্ধে কেউই তার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না।

No comments

Powered by Blogger.