প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফর-কাছের দেশ থেকে সম্ভাবনার হাতছানি by আশফাকুর রহমান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের মধ্য দিয়ে পুবের জানালা দিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করুক, বিশেষ করে মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে বাংলাদেশ সচেষ্ট হবে বলে আশা করব। এখন দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ১০ কোটি ডলারেরও কম। এর মধ্যে বাংলাদেশের রফতানি ৫০ লাখ ডলারও হবে না। ওষুুধ, পাট, কসমেটিকস, চামড়াজাত দ্রব্য, কম্পিউটার প্রভৃতি নানা ধরনের পণ্য সেখানে রফতানির সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে
আমরা আমদানি করতে পারি চাল, কৃষিজাত পণ্য, কাঠ ও গ্যাস। তিন-চার বছরে দুই দেশের বাণিজ্য বছরে একশ' কোটি ডলারে পেঁৗছানো কঠিন কাজ নয়
একসময় চট্টগ্রাম থেকে বার্মার (বর্তমান নাম মিয়ানমার) রেঙ্গুন (বর্তমান নাম ইয়াংগুন, দেশের রাজধানী) ও মংডুতে নিয়মিত স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। চাকরি ও ব্যবসা উপলক্ষে বাঙালিদের অন্যতম গন্তব্য ছিল পুবের এই দেশটি। কিন্তু এখন মিয়ানমারকে কত দূরের দেশই না মনে হয়। অথচ এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও শরণার্থী বিষয়ে যে সমস্যা এবং যার মাত্রা যথেষ্ট প্রকট, তা কিন্তু নিকট প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণেই।
আগামীকাল সোমবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিকট প্রতিবেশী এই দেশটি সফরে যাচ্ছেন। কেন ও কী কারণে মিয়ানমার কাছের দেশ হয়েও অনেক দূরের দেশে পরিণত হলো, সে ইতিহাস চর্চায় যাব না। সে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবশ্যই এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। দীর্ঘ সামরিক শাসনামলে শাসকরা বহির্বিশ্বের কাছ থেকে নিজেদের অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমে তাদের তেমন উৎসাহ ছিল না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে চলেছে। এর সূচনা গত মার্চ মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী থিন সেইনের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে। তিনি অং সান সু চিকে মুক্তি দিয়েছেন। সংবাদপত্রও আগের তুলনায় যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করছে। আসিয়ান দেশগুলো এ পরিবর্তন বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ২০১৪ সালে অর্থনৈতিক এ জোটের নেতৃত্বভার অর্পিত হবে মিয়ানমারের হাতে। এ জোট এখন গোটা বিশ্বে উন্নয়ন ইস্যুতে বিশ্বের অন্যতম মডেল। আসিয়ানের নেতৃত্ব অর্পিত হলে এবং এ সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় দেশটি আর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকবে না। সেখানে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে এবং যা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে তা নজর এড়ায়নি পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নের সিঁড়িতে প্রায় তিন দশক ধরে উঠে বসা দেশগুলোর নেতৃত্বের।
বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরেও যে বিষয়টি রয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে যায় বারাক ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ইয়াংগুন সফরের কর্মসূচি থেকে। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এটা কোনো পদস্থ মার্কিন কর্মকর্তার ইয়াংগুনে পা রাখা। বুধবার তাকে স্বাগত জানিয়ে প্রেসিডেন্ট থিন সেইন বলেছেন, ল্যান্ডমার্ক সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচিত হলো।
আমরা খুব কাছের দেশ হয়ে সেখানকার পরিবর্তন কেন নজরে রাখব না? আমরা এটা জানি যে, মিয়ানমারে চীনের প্রভাব যথেষ্ট। গোটা বিশ্ব যখন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, চীনের কমিউনিস্ট নেতৃত্ব থেকেছে তাদের পাশে। আবার এটাও মনে রাখা দরকার যে, সমাজতান্ত্রিক চীনা নেতৃত্ব একসময় মিয়ানমারে 'বিপ্লব রফতানির' কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু তা ব্যর্থ হওয়ায় দু'দেশের সম্পর্ক তিক্ত হলেও তা কাটিয়ে উঠতে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা মিয়ানমারের সেনা শাসনজনিত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তেমন আমলে নেয়নি, বরং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ইস্যুগুলোতে কাজ করেছে। মিয়ানমারের নেতৃত্ব অবশ্য সম্প্রতি এই চীনকেই কিছুটা রুষ্ট করেছে ইরাবতী নদীতে চীনা সাহায্যে ৩২০ কোটি ডলারের একটি বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করে। এ প্রকল্পের বিষয়ে মিয়ানমারের জনমত বিরুদ্ধে ছিল এবং সম্প্রতি তাদের নতুন সরকার সেটা আমলে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশটিকে যে কাছে টানতে সচেষ্ট হয়েছে তার একটি লক্ষ্য চীনের প্রভাব কমিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি। বাংলাদেশের জন্য ভূমণ্ডলীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইস্যু তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোমবারের সফর অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। নিকট প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে আমাদের ব্যবসার অনেক সুযোগ রয়েছে। বিশেষভাবে যেসব বিষয়ে চুক্তি নেই, কিন্তু হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগ, সড়ক, নৌ ও বিমানপথে যোগাযোগ, পর্যটন এবং মুদ্রা বিনিময়। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর এলসি সেখানে গৃহীত হলে অনেক সমস্যা মিটে যাবে। সাধারণভাবে অনেকেরই প্রতিবেশী দেশটি সম্পর্কে ধারণা নেই। বিচ্ছিন্নতাই এর কারণ। আয়তনে দেশটি বাংলাদেশের পাঁচগুণ বড়। কিন্তু জনসংখ্যা অনেক কম। বাংলাদেশে যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৯০০ লোকের বসবাস, মিয়ানমারে বাস মাত্র ৭০ জনের। মাথাপিছু জমির পরিমাণ বাংলাদেশের নাগরিকদের ১২ গুণের বেশি। আমাদের নিকটবর্তী আরাকান পার্বত্য ভূমিতে রয়েছে চুনাপাথর, কাঠ, বাঁশ, সমুদ্রজাত দ্রব্য ও খনিজ সম্পদ। কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের জন্য তারা জমি ইজারা দেওয়ার উদার নীতি অনুসরণ করছে। চুক্তিভিত্তিক খামার পরিচালনার জন্য তারা আয়কর ছাড়সহ কয়েক ধরনের কর সুবিধা দিয়ে থাকে। যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ১৬৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে সেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ আমাদের অবশ্যই কাজে লাগাতে উদ্যোগী হতে হবে।
এটা ঠিক, রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। কক্সবাজার এলাকায় এ সমস্যা প্রকট। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি গত বছর ইয়াংগুন সফরের সময় এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবার শীর্ষ পর্যায়ে সফরের সময় এ ইস্যুতে বরফ গলবে, এমন আশা করব। সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেহেতু উন্নত হচ্ছে, সে কারণে নতুন করে শরণার্থীর আগমন হয়তো ঘটবে না। আরেকটি বড় সমস্যা বঙ্গোপসাগরের সীমানা চিহ্নিত করা। সাগরে অর্থনৈতিক স্বার্থের এলাকা নিয়ে বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে গড়িয়েছে। ওই এলাকায় তেল ও গ্যাসসম্পদের বড় মজুদ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান এবং যৌথ উদ্যোগে তা অনুসন্ধান ও আহরণের কোনো সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে রয়েছে বলে মনে হয় না। এ ইস্যুতে একসময় সামরিক উত্তেজনাও সৃষ্টি হয়েছিল।
তবে এসব সমস্যা সত্ত্বেও আমরা সিঙ্গাপুরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারি। তারা ইউরোপের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলে, একই সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে রয়েছে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা। মিয়ানমারকে আসিয়ানে আরও বেশি করে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে এ দেশটির অবদান অনস্বীকার্য। মিয়ানমারে তাদের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। বাণিজ্য সম্পর্কও মজবুত। চীনও এ দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে সর্বদা সচেষ্ট ছিল। খনিজ সম্পদ উন্নয়নের কন্ট্রাক্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা বিশেষভাবে তৎপর। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতও পিছিয়ে নেই। চীনের মতো তারাও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রসর হয়েছে এবং তার সুফল পাচ্ছে। তাদের একটি বিশেষ বিবেচনা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের ল্যান্ডলকড রাজ্যগুলোর জন্য সমুদ্রপথে যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি। বাংলাদেশের দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলায়ও ভারত এ ধরনের সুবিধা চাইছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের মধ্য দিয়ে পুবের জানালা দিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করুক, বিশেষ করে মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে বাংলাদেশ সচেষ্ট হবে বলে আশা করব। এখন দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ১০ কোটি ডলারেরও কম। এর মধ্যে বাংলাদেশের রফতানি ৫০ লাখ ডলারও হবে না। ওষুুধ, পাট, কসমেটিকস, চামড়াজাত দ্রব্য, কম্পিউটার প্রভৃতি নানা ধরনের পণ্য সেখানে রফতানির সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে আমরা আমদানি করতে পারি চাল, কৃষিজাত পণ্য, কাঠ ও গ্যাস। তিন-চার বছরে দুই দেশের বাণিজ্য বছরে একশ' কোটি ডলারে পেঁৗছানো কঠিন কাজ নয়। বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে গ্যাস আমদানির প্রতি। মনে রাখতে হবে, ভারতও একই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং চীন এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। মিয়ানমারের গ্যাসের মজুদ উল্লেখযোগ্য। আমরা সেখানে যৌথভাবে শিল্প (বিশেষ করে রাসায়নিক সার) ও বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের কথা বিবেচনা করতে পারি। রাখাইন রাজ্যে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভাগাভাগি করা সহজ হবে। বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যা বিবেচনায় রেখে আমরা অগ্রসর হবো, তবে অনেক দূরের সম্ভাবনাও পরিকল্পনায় থাকা চাই। এটাও মনে রাখতে হবে, দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন দুটি প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক রাতারাতি বদলে যাবে না। যোগাযোগ বা কানেকটিভিটি বাড়াতে পারলে সার্বিক সম্পর্কে তার প্রভাব পড়ে থাকে। আবার সম্পর্কের ভিত রচিত হলে যোগাযোগ বাড়ানোর তাগিদ সৃষ্টি হয়। এখন মিয়ানমারে যাত্রীবাহী কোনো স্টিমার বা জাহাজ বাংলাদেশ থেকে যায় না। সড়কপথেও যোগাযোগ নেই। দশকের পর দশক ধরে এ ধরনের সংযোগ ছিন্ন হয়ে আছে। এখন তা পুনঃস্থাপনের সুযোগ এসেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো উন্নয়ন সহযোগীরা এ ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা দিতে পারে। চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপনের জন্যও যেতে হবে মিয়ানমার হয়ে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় এ বিষয়টি আলোচনায় ছিল। এখন তার মিয়ানমার সফরের সময় নিশ্চয়ই কুনমিং-চট্টগ্রাম কানেকটিভিটি খতিয়ে দেখা হবে।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে মিয়ানমার স্টাডির প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান। এ দায়িত্বভার বিশেষজ্ঞদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া ভালো। ব্যবসায়ীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হবে। তারা ইউরোপ-আমেরিকায় রফতানি বাড়িয়েছেন। এখন কাছের দেশের হাতছানি রয়েছে। নিশ্চয়ই তারা তা কাজে লাগাতে পারবেন।
আশফাকুর রহমান : সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং সেন্টার ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স স্টাডিজের প্রধান
একসময় চট্টগ্রাম থেকে বার্মার (বর্তমান নাম মিয়ানমার) রেঙ্গুন (বর্তমান নাম ইয়াংগুন, দেশের রাজধানী) ও মংডুতে নিয়মিত স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। চাকরি ও ব্যবসা উপলক্ষে বাঙালিদের অন্যতম গন্তব্য ছিল পুবের এই দেশটি। কিন্তু এখন মিয়ানমারকে কত দূরের দেশই না মনে হয়। অথচ এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও শরণার্থী বিষয়ে যে সমস্যা এবং যার মাত্রা যথেষ্ট প্রকট, তা কিন্তু নিকট প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণেই।
আগামীকাল সোমবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিকট প্রতিবেশী এই দেশটি সফরে যাচ্ছেন। কেন ও কী কারণে মিয়ানমার কাছের দেশ হয়েও অনেক দূরের দেশে পরিণত হলো, সে ইতিহাস চর্চায় যাব না। সে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবশ্যই এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। দীর্ঘ সামরিক শাসনামলে শাসকরা বহির্বিশ্বের কাছ থেকে নিজেদের অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমে তাদের তেমন উৎসাহ ছিল না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে চলেছে। এর সূচনা গত মার্চ মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী থিন সেইনের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে। তিনি অং সান সু চিকে মুক্তি দিয়েছেন। সংবাদপত্রও আগের তুলনায় যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করছে। আসিয়ান দেশগুলো এ পরিবর্তন বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ২০১৪ সালে অর্থনৈতিক এ জোটের নেতৃত্বভার অর্পিত হবে মিয়ানমারের হাতে। এ জোট এখন গোটা বিশ্বে উন্নয়ন ইস্যুতে বিশ্বের অন্যতম মডেল। আসিয়ানের নেতৃত্ব অর্পিত হলে এবং এ সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় দেশটি আর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকবে না। সেখানে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে এবং যা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে তা নজর এড়ায়নি পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নের সিঁড়িতে প্রায় তিন দশক ধরে উঠে বসা দেশগুলোর নেতৃত্বের।
বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরেও যে বিষয়টি রয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে যায় বারাক ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ইয়াংগুন সফরের কর্মসূচি থেকে। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এটা কোনো পদস্থ মার্কিন কর্মকর্তার ইয়াংগুনে পা রাখা। বুধবার তাকে স্বাগত জানিয়ে প্রেসিডেন্ট থিন সেইন বলেছেন, ল্যান্ডমার্ক সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচিত হলো।
আমরা খুব কাছের দেশ হয়ে সেখানকার পরিবর্তন কেন নজরে রাখব না? আমরা এটা জানি যে, মিয়ানমারে চীনের প্রভাব যথেষ্ট। গোটা বিশ্ব যখন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, চীনের কমিউনিস্ট নেতৃত্ব থেকেছে তাদের পাশে। আবার এটাও মনে রাখা দরকার যে, সমাজতান্ত্রিক চীনা নেতৃত্ব একসময় মিয়ানমারে 'বিপ্লব রফতানির' কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু তা ব্যর্থ হওয়ায় দু'দেশের সম্পর্ক তিক্ত হলেও তা কাটিয়ে উঠতে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা মিয়ানমারের সেনা শাসনজনিত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তেমন আমলে নেয়নি, বরং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ইস্যুগুলোতে কাজ করেছে। মিয়ানমারের নেতৃত্ব অবশ্য সম্প্রতি এই চীনকেই কিছুটা রুষ্ট করেছে ইরাবতী নদীতে চীনা সাহায্যে ৩২০ কোটি ডলারের একটি বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করে। এ প্রকল্পের বিষয়ে মিয়ানমারের জনমত বিরুদ্ধে ছিল এবং সম্প্রতি তাদের নতুন সরকার সেটা আমলে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশটিকে যে কাছে টানতে সচেষ্ট হয়েছে তার একটি লক্ষ্য চীনের প্রভাব কমিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি। বাংলাদেশের জন্য ভূমণ্ডলীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইস্যু তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোমবারের সফর অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। নিকট প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে আমাদের ব্যবসার অনেক সুযোগ রয়েছে। বিশেষভাবে যেসব বিষয়ে চুক্তি নেই, কিন্তু হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগ, সড়ক, নৌ ও বিমানপথে যোগাযোগ, পর্যটন এবং মুদ্রা বিনিময়। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর এলসি সেখানে গৃহীত হলে অনেক সমস্যা মিটে যাবে। সাধারণভাবে অনেকেরই প্রতিবেশী দেশটি সম্পর্কে ধারণা নেই। বিচ্ছিন্নতাই এর কারণ। আয়তনে দেশটি বাংলাদেশের পাঁচগুণ বড়। কিন্তু জনসংখ্যা অনেক কম। বাংলাদেশে যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৯০০ লোকের বসবাস, মিয়ানমারে বাস মাত্র ৭০ জনের। মাথাপিছু জমির পরিমাণ বাংলাদেশের নাগরিকদের ১২ গুণের বেশি। আমাদের নিকটবর্তী আরাকান পার্বত্য ভূমিতে রয়েছে চুনাপাথর, কাঠ, বাঁশ, সমুদ্রজাত দ্রব্য ও খনিজ সম্পদ। কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের জন্য তারা জমি ইজারা দেওয়ার উদার নীতি অনুসরণ করছে। চুক্তিভিত্তিক খামার পরিচালনার জন্য তারা আয়কর ছাড়সহ কয়েক ধরনের কর সুবিধা দিয়ে থাকে। যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ১৬৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে সেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ আমাদের অবশ্যই কাজে লাগাতে উদ্যোগী হতে হবে।
এটা ঠিক, রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। কক্সবাজার এলাকায় এ সমস্যা প্রকট। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি গত বছর ইয়াংগুন সফরের সময় এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবার শীর্ষ পর্যায়ে সফরের সময় এ ইস্যুতে বরফ গলবে, এমন আশা করব। সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেহেতু উন্নত হচ্ছে, সে কারণে নতুন করে শরণার্থীর আগমন হয়তো ঘটবে না। আরেকটি বড় সমস্যা বঙ্গোপসাগরের সীমানা চিহ্নিত করা। সাগরে অর্থনৈতিক স্বার্থের এলাকা নিয়ে বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে গড়িয়েছে। ওই এলাকায় তেল ও গ্যাসসম্পদের বড় মজুদ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান এবং যৌথ উদ্যোগে তা অনুসন্ধান ও আহরণের কোনো সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে রয়েছে বলে মনে হয় না। এ ইস্যুতে একসময় সামরিক উত্তেজনাও সৃষ্টি হয়েছিল।
তবে এসব সমস্যা সত্ত্বেও আমরা সিঙ্গাপুরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারি। তারা ইউরোপের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলে, একই সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে রয়েছে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা। মিয়ানমারকে আসিয়ানে আরও বেশি করে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে এ দেশটির অবদান অনস্বীকার্য। মিয়ানমারে তাদের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। বাণিজ্য সম্পর্কও মজবুত। চীনও এ দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে সর্বদা সচেষ্ট ছিল। খনিজ সম্পদ উন্নয়নের কন্ট্রাক্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা বিশেষভাবে তৎপর। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতও পিছিয়ে নেই। চীনের মতো তারাও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রসর হয়েছে এবং তার সুফল পাচ্ছে। তাদের একটি বিশেষ বিবেচনা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের ল্যান্ডলকড রাজ্যগুলোর জন্য সমুদ্রপথে যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি। বাংলাদেশের দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলায়ও ভারত এ ধরনের সুবিধা চাইছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের মধ্য দিয়ে পুবের জানালা দিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করুক, বিশেষ করে মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে বাংলাদেশ সচেষ্ট হবে বলে আশা করব। এখন দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ১০ কোটি ডলারেরও কম। এর মধ্যে বাংলাদেশের রফতানি ৫০ লাখ ডলারও হবে না। ওষুুধ, পাট, কসমেটিকস, চামড়াজাত দ্রব্য, কম্পিউটার প্রভৃতি নানা ধরনের পণ্য সেখানে রফতানির সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে আমরা আমদানি করতে পারি চাল, কৃষিজাত পণ্য, কাঠ ও গ্যাস। তিন-চার বছরে দুই দেশের বাণিজ্য বছরে একশ' কোটি ডলারে পেঁৗছানো কঠিন কাজ নয়। বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে গ্যাস আমদানির প্রতি। মনে রাখতে হবে, ভারতও একই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং চীন এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। মিয়ানমারের গ্যাসের মজুদ উল্লেখযোগ্য। আমরা সেখানে যৌথভাবে শিল্প (বিশেষ করে রাসায়নিক সার) ও বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের কথা বিবেচনা করতে পারি। রাখাইন রাজ্যে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভাগাভাগি করা সহজ হবে। বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যা বিবেচনায় রেখে আমরা অগ্রসর হবো, তবে অনেক দূরের সম্ভাবনাও পরিকল্পনায় থাকা চাই। এটাও মনে রাখতে হবে, দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন দুটি প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক রাতারাতি বদলে যাবে না। যোগাযোগ বা কানেকটিভিটি বাড়াতে পারলে সার্বিক সম্পর্কে তার প্রভাব পড়ে থাকে। আবার সম্পর্কের ভিত রচিত হলে যোগাযোগ বাড়ানোর তাগিদ সৃষ্টি হয়। এখন মিয়ানমারে যাত্রীবাহী কোনো স্টিমার বা জাহাজ বাংলাদেশ থেকে যায় না। সড়কপথেও যোগাযোগ নেই। দশকের পর দশক ধরে এ ধরনের সংযোগ ছিন্ন হয়ে আছে। এখন তা পুনঃস্থাপনের সুযোগ এসেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো উন্নয়ন সহযোগীরা এ ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা দিতে পারে। চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপনের জন্যও যেতে হবে মিয়ানমার হয়ে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় এ বিষয়টি আলোচনায় ছিল। এখন তার মিয়ানমার সফরের সময় নিশ্চয়ই কুনমিং-চট্টগ্রাম কানেকটিভিটি খতিয়ে দেখা হবে।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে মিয়ানমার স্টাডির প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান। এ দায়িত্বভার বিশেষজ্ঞদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া ভালো। ব্যবসায়ীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হবে। তারা ইউরোপ-আমেরিকায় রফতানি বাড়িয়েছেন। এখন কাছের দেশের হাতছানি রয়েছে। নিশ্চয়ই তারা তা কাজে লাগাতে পারবেন।
আশফাকুর রহমান : সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং সেন্টার ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স স্টাডিজের প্রধান
No comments