জলিল সাহেব তো সব ছ্যাড়াবেড়া করে দিলেন! by আফরোজা হাসান খান
আহা! জলিল সাহেব যে এমন নির্জলা সত্য উচ্চারণ করবেন সুদূর লন্ডনে বসে, সেটা কেউ কি ভেবেছিলেন? না, কেউ ভাবেননি। ভাবা উচিত ছিল। এর আগেও আবদুল জলিল এমপি ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী বেশকিছু বেফাঁস কথা বলেছিলেন। তখন অনেকেই বলেছেন, সাধারণ সম্পাদকের পদ হারিয়ে আর মন্ত্রিত্ব না পেয়ে তিনি এমন উক্তি করেছেন। সেটা বোধহয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও ভেবেছেন।
সেজন্য প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেননি তাকে। কিন্তু এখন দেশের মাটি থেকে তিনি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি অনেক দূরে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে, লন্ডনে বসে আবদুল জলিল ফাঁস করে দিলেন দলের গোপন কথা। বিগত নির্বাচনে মহাজোট সরকার কিভাবে জিতেছে, কারা সেই বিজয়ের হোতা, ডিজিটাল বাংলার সেই বিজয় যে মইন উ আহমেদের নেটওয়ার্কের জোরে হয়েছে, তার নাড়িটি জনগণের সামনে মেলে দিয়েছেন। না, পুরোপুরি মেলে তিনি দেননি বা দিতে পারেননি। কিংবা দেয়ার কথা ভাবতেও পারেননি। তবে সুচিমুখ খুলে দিয়েছেন তিনি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কারণে আবদুল জলিলকে একটি আওয়ামী ছোবল অবশ্য খেতে হয়েছে ওই লন্ডনেই। দিব্যজ্ঞানী আওয়ামী কর্মীরা জলিলের কথা শুনে এতটাই বিরক্ত হয়েছে যে, ব্রিটিশ এটিকেট ভুলে তারা বাংলার কেঁদো বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে জলিলের ওপর। এতে জলিল সাহেব লাঞ্ছিত হলেও মনের খেদ প্রকাশ করতে পেরে কিছুটা হালকাবোধই করছেন, আমরা এটা ধরে নিতে পারি। সত্য, সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জলিল সাহেবকে সাধারণ সম্পাদকের পদে রেখেও কাজ করতে দেননি দলীয় প্রধান। এখন বোঝা যাচ্ছে কেন ডিজিএফআই জলিলকে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করেছিল। তাকে রাজনীতি থেকে ইস্তফা দেয়ার ঘোষণাও দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ডিজিএফআই'র চাপেই যে জলিল সাহেব রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন, এখন তা সপষ্ট। আর ওই সংস্থাটি যে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করছিল তা বলাই বাহুল্য। শেখ হাসিনার ইঙ্গিতেই জলিল সাহেব যাতে রাজনীতিতে না ফিরতে পারেন কিংবা ফিরলেও যাতে সাধারণ সম্পাদকের পদে না থাকতে পারেন, সেজন্যই ওই ঘোষণা আদায় করা হয়েছিল। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে এলে, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান 'ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে' বলে জলিলকে বরণ করে নিয়ে দায়িত্ব ফিরিয়ে দেন। কিন্তু প্রবাসে অবস্থানরত শেখ হাসিনা তার পুনঃপ্রত্যাবর্তন মেনে নেননি। তিনি জলিলকে ফোন করে রেসেট থাকতে বলেন। সেই সময় এ বিষয়টি ছিল খুবই মুখরোচক আলোচনার বিষয়। কিন্তু জনগণ বুঝতে পারেনি শেখ হাসিনার নীলনকশার চালটি। তিনি এবং মইন উ আহমেদ রাজনৈতিক সংস্কারের নাটকটি সাজিয়েছিলেন বেশ কায়দা করে, যাতে বোঝা না যায় যে সামরিক ব্যাক্ড সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার গোপন অাঁতাত হয়েছে। কথায় আছে, সত্য ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় না। সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টারা যদি মুখ খোলেন, তাহলেও জানা যাবে নির্বাচনী বিজয়ের পেছনে কোন্ ধরনের নীলনকশা কাজ করেছে। আমি তো শুনেছি লোকের মুখে, তারা বলেছে উপজেলা-জেলার ডিসিরা ডিজিটালভাবে আসনগুলোতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে দিয়েছে। সেটা কী রকম, জিজ্ঞেস করাতে তারা বলেছে, বিজয়ী বিএনপি প্রার্থীর ভোট আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছে বলে রেজাল্ট পাঠানো হলো ইসি সচিবালয়ে। একবার বিজয়ী ঘোষিত হলে সেটা ঠিক করা বা ন্যায় প্রতিষ্ঠা এই বাংলাদেশে পাহাড় সরানোর মতো কঠিন। বললাম, বিএনপির এজেন্টরা কী করল? জবাব এলো, বাংলাদেশে রাজনৈতিক নৈতিকতা বলে কিছু নেই। বোঝা গেল মোটা দাগে জনগণ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। কিন্তু আজকে জলিলের অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসছে ঝোলার বিড়ালটি এবং সে কেবল একবার মিউ ডেকেছে। ২. বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, সরকার সংবিধান সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার জন্যই। তার এ কথার জবাব দিয়েছেন বেগম সাজেদা চৌধুরী। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়েছিলেন তিনি পুজোর ব্যবস্থাপনা দেখতে। সেখানে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে একটি সংবিধান দিয়েছে। আর তারা (বিএনপি) সেই সংবিধানকে রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বিকৃত করেছে। আমরা সেই বিকৃত অংশই আগের অবস্থায় নিয়ে আসব। এ অভিযোগ আওয়ামীমনস্কদের। তারা যা বিশ্বাস করে তা বলে। বিএনপি যা বিশ্বাস করে তা মুখ ফুটে বলে না। আওয়ামী লীগের অন্যতম বৃদ্ধিজীবী কাম ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন লিখেছেন, 'শেখ মুজিবের আমলে ১৯৭৪ সালের চতুর্থ সংশোধনীই এই সংবিধানের ওপর প্রথম আঘাত যদিও তার আমলেই সিভিল সমাজের কর্তৃত্বের দলিল ১৯৭২ সালে সংবিধান পাস হয়। এরপর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে এই দলিল প্রায় বিকৃত করে ফেলেছেন। ১৯৯০ সালের পর সংসদে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে...' [বাংলাদেশে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম/ মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্তকুমার রায়]। মামুন ও জয়ন্ত সত্য লিখেছেন। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে মামুনের সে দায় ও দায়িত্বও আছে। সেটা ভুলে যাননি তিনি। আমাদের মহান সংবিধান যে প্রথম বিকৃত করেন স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, সেটা স্বীকার করাটাই আওয়ামী লীগের পক্ষে কঠিন। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিব গণতন্ত্র হত্যা করে প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতি ও একদলীয় শাসন কায়েম করেন। এক দলটির নাম বাকশাল। সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতার ঘোষক জেনারেল জিয়া যে বহুদলীয় গণতন্ত্রের মুখটি খুলে দিয়েছিলেন, ইতিহাসবিদ সেই সত্য লিখলেন না। '১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক সমাজের প্রতিনিধিরা' লিখেছেন মামুন-জয়ন্ত। ওই সময়কালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সামরিক গণতন্ত্র উপভোগ করেছে। এই ইতিহাস-সত্যও মামুন-জয়ন্ত লেখেননি। '১৯৯০ সালের পর সংসদে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু আগে মুক্তিযুদ্ধের মূল সুর ও নাগরিক সমাজকে হেয় করে যেসব সংশোধনী করা হয়েছিল তার বদল হয়নি।' [ঐ ] সত্যকে কেমন করে আড়াল করত হয়, আওয়ামী ইতিহাসের ছাত্র মামুন তার প্রমাণ রেখেছেন। দ্বাদশ সংশোধনী পাস করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছে বিএনপি। আর গণতন্ত্রের মানসপুত্রী শেখ হাসিনার পিতাজী গণতন্ত্র হত্যা করে কায়েম করেছিলেন স্বৈর শাসন। এতে মহান নেতার কোনো সখলন হয় না। কারণ তিনি একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের রাজপথ ধরে এসে পৌঁছেছিলেন দেশের স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। তার নামে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে সত্য, কিন্তু তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেননি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকের পক্ষে বিপ্লবী হওয়া সম্ভব নয়। শেখ মুজিব তার উদাহরণ। ১৯৯০ সালের পর ক্ষমতায় বসে বিএনপি এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই দেশে আবারও গণতন্ত্র ফিরে আসে। একবার জেনারেল জিয়া, আরেকবার বেগম জিয়ার হাতে এই দেশবাসী ফিরে পায় রাষ্ট্র পরিচালনার সংবিধান। এই সত্যটি মামুন-জয়ন্ত আড়াল করতে গিয়ে লেখেন, '১৯৯০ সালের পর দ্বাদশ সংশোধনী...'। একানব্বই সালের নির্বাচনের কথাও যাতে লিখতে না হয়, লেখকদ্বয় সে চেষ্টাই করেছেন। আর আজ যদি ১৯৭২ সালের অবিকৃত সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করে আওয়ামী লীগ, তাতে তাদের নেতা শেখ মুজিবকেই তারা অস্বীকার করবে। আর শেখ মুজিবকে যারা রাজনৈতিকভাবে অস্বীকার করবে, তারা মুক্তিযুদ্ধের মূল সুরের প্রশ্নটি তোলে কেমন করে? অস্বীকার করে এ কারণে যে তাদের কোনো রাজনৈতিক দর্শন নেই ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ছাড়া। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা বাদ দিলাম কেননা তিনি নতুন আওয়ামী লীগার, আমু, রাজ্জাক, তোফায়েল, জলিলের মতো প্রবীণ রাজনীতিকরা কি কোনো অবদানই রাখেননি? আর এ দেশের জনগণ? তাদের কোনো মূল্য নেই আওয়ামী নেতৃত্বের কাছে? জনগণের ওপর যে আওয়ামী লীগের কোনো আস্থা নেই, সেটা বহুবার শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন। ষড়যন্ত্র কোথা থেকে উঠে আসে, এখন সেটা মানুষ বোঝে। আমাদের রাজনীতি থেকে ষড়যন্ত্র পরিহার না করা গেলে এ দেশের উন্নতি সম্ভব নয়।
No comments