কোন পথে চীন by ড. তারেক শামসুর রেহমান
আগামী ১ অক্টোবর চীন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ষাট বছর পালন করবে। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর বেইজিংয়ের তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে প্রয়াত চীনা নেতা মাও জে ডং সমাজতান্ত্রিক চীনা রাষ্ট্রের কথা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর কেটে গেছে অনেকটা বছর। সোভিয়েত ইউনিয়নে ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে। ভেঙে গেছে সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থা। কিন্তু চীন এখনও তার রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে টিকে আছে।
যদিও চীনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে এখন অনেক প্রশ্ন আছে-এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা কতটুকু সমাজতান্ত্রিক কিংবা আদৌ সমাজতান্ত্রিক কীনা, এ নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীদের মাঝেও দ্বিমত লক্ষ্য করা যায়। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে গেল, তখন পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রহ ছিল চীনকে নিয়ে। তখন এমন মন্তব্যও শোনা গেছে যে, চীনেও সমাজতন্ত্রের পতন ঘটবে। বিল ক্লিনটন তো প্রকাশ্যেই বলেছিলেন (১৯৯৮) তার জীবদ্দশায় তিনি দেখবেন চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে(?)। কিন্তু 'শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে' চীন শুধু টিকেই থাকেনি বরং অন্যতম বিশ্বশক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত আইএমএফ-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ বছরের শেষ নাগাদ চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গিয়ে দাঁড়াবে ৯ ভাগে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রবৃদ্ধির হার ৩ ভাগ ও জাপানেরও ৩ ভাগ। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পর বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। আর গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর মতে ২০২৭ সালের দিকে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। চীনের এই যে বিকাশ ও উন্নয়ন, এটা সম্ভব হয়েছে চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ও সঠিক নেতৃত্বের কারণে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরপরই চীনে এর প্রভাব পড়ে। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন অধ্যাপক লি তা চাও এবং ছেন তু সিউ পাঠচক্র গড়ে তুলে তরুণদের মার্কসবাদে আকৃষ্ট করেন। ছাত্রদের মধ্যে মাও জে ডং এই পাঠচক্রে যোগ দিয়েছিলেন। সাংহাইয়ে ১৯১৮ সালে আর বেইজিংয়ে ১৯১৯ সালে এ রকম পাঠচক্র গঠিত হয়েছিল। সাংহাইয়ে ১৯২০ সালে কমিউনিষ্ট গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয় এবং বেইজিং ও ক্যান্টনে এরূপ গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯২১ সালের ১ জুলাই সাংহাই প্রথম কংগ্রেসে চীনের কমিউনিষ্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মলাভ করে। মাও জে ডং প্রথম কংগ্রেসে অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন। সেই থেকে ২০০৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৮৮ বছর চীনা কমিউনিষ্ট পার্টি চীনা জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এই দীর্ঘ পথযাত্রায় কমিউনিষ্ট পার্টি কখনও নন্দিত হয়েছে, কখনও বা বিতর্কিত হয়েছে। চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্যদের জাতীয়তাবাদী কুয়ো মিং তাং দলে যোগদান ও তাদের সঙ্গে ১৯২৩ ও ১৯৩৬ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৩৪ সালে দীর্ঘ ৬ হাজার মাইলের লং-মার্চ যাতে প্রায় ১ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছিল ও লং-মার্চ ১১টি প্রদেশের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ১৯৪৯ সালে কুয়ো মিং তাং তথা চিয়াং কাইসেককে ক্ষমতা থেকে বিতাড়ন করে বেইজিংয়ের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল-সবই ছিল কমিউনিষ্ট পার্টির অর্জন। এমনকি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে গরবাচেভ যখন তার সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন, তখন চীনা নেতৃত্ব এ ধরনের ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়নি। তারা শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে প্রাধান্য দিয়েছিল। চীনে অর্থনৈতিক সংস্কার, অর্থাৎ গরবাচেভের 'পেরোসেত্রাইকা' বাস্তবায়ন হয়েছিল। কিন্তু গরবাচেভের মতো তারা গ্লাসনস্ত বা রাজনৈতিক সংস্কারে হাত দেয়নি। তবে চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির দীর্ঘ পথযাত্রায় অনেক সিদ্ধান্ত বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। যেমন বলা যেতে পারে ১৯৫৩ সালের শুদ্ধি অভিযানের কথা কিংবা ১৯৬৫ সালের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা। মাওয়ের এৎবধঃ খবধঢ় ঋড়ৎধিৎফ চৎড়মৎধসসব ও তথাকথিত 'চার কুচক্রী'র উত্থান ও মাওকে সামনে রেখে ক্ষমতা করায়ত্ত করার ঘটনায় অনেক বাড়াবাড়ি হয়েছিল, এসব অভিযোগও ছিল। তবে এটাও সত্য, ডানপন্হীদের প্রভাব কমানোর জন্য মাও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। সেই সময় দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের অনেককে গ্রামে কমিউনে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে মাও জে ডংয়ের মৃত্যু ও ১৯৭৭-৮০ সময়সীমায় দেং জিয়াও পিংয়ের উত্থান চীনকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দেয়। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে দেং তার অর্থনীতির কথা বলতে গিয়ে পার্টি থেকে দ্বিতীয়বারের মতো বহিষ্কার হয়েছিলেন। অনেকেরই মনে থাকার কথা দেংয়ের সেই বিখ্যাত উক্তি-'বিড়াল সাদা কী কালো, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা বিড়াল ইঁদুর মারে কি-না।' দেং জিয়াও পিং বিশ্বাস করতেন, চীনা অর্থনীতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হলে এতে পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে গড়ে ওঠা বাজার অর্থনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেদিন তাকে পুঁজিবাদের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তিনি বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, আবার ফিরেও এসেছিলেন। মজার কথা দেং কখনও পার্টি চেয়ারম্যান হননি। তিনি চানওনি। তিনি ছিলেন পার্টির মিলিটারি কমিশনারের চেয়ারম্যান। ১৯৮৭ সালে দেং ১৩তম পার্টি কংগ্রেসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে অবসর নেন, আর ১৯৯২ সালে তিনি পার্টির মিলিটারি কমিশনের দায়িত্বভারও ছেড়ে দেন। ১৯৯৭ সালে দেং মারা যান। মাও জে ডংয়ের মৃত্যুর পর চীনকে সঠিকভাবে পরিচালনায় একটি গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন দেং। ঠিক তেমনি ১৯৮৯ সালেও তিনি তার বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। দেংয়ের ভাবশিষ্য হিসেবে পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঝাও জিয়াং ১৯৮৬ সালে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে 'ভেলভেট রেভ্যুলুশন' যখন সেখানে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটাচ্ছে, তখন এর ঢেউ এসে লাগে চীনেও। চীনের ইতিহাসে সর্বকালের বৃহৎ ছাত্র বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালে। ছাত্ররা ব্যাপক গণতন্ত্রের দাবি তোলে এবং একপর্যায়ে বেইজিংয়ের তিয়ান আন মেন স্কোয়ার দখল করে নেয়। পার্টি চেয়ারম্যান ঝাও জিয়াং ছাত্রদের দাবি-দাওয়ার প্রতি কিছুটা দুর্বল ছিলেন। ওই সঙ্কটের সময় দেং জিয়াও পিং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন। ছাত্র অসন্তোষ দমনে তিনি তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে ট্যাংক পাঠান। ছাত্র অসন্তোষ দমন করা হয়। ওই সময়ে ছাত্র অসন্তোষ যদি দমন করা না যেত, তাহলে আজকে চীনের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। দেং সেদিন সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছিলেন। যার ফলে চীন একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়। চীনের ছাত্র অসন্তোষের ঘটনায় ঝাও জিয়াং অপসারিত হয়েছিলেন। এরপর দায়িত্ব নেন জিয়াং জেমিন। ২০০৫ সালের নভেম্বরে পার্টির ১৬তম কংগ্রেসে জিয়াং জেমিনের স্থলাভিষিক্ত হন হু জিন তাও। ২০০৭ সালে ১৭তম কংগ্রেসে তিনি আরও ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। অর্থাৎ তিনি থাকবেন ২০১২ সাল পর্যন্ত। পার্টির পলিটব্যুরোতে নতুন অন্তর্ভুক্ত সি জি পিং কিংবা লি কে কিয়াং প্রেসিডেন্ট হু জিন তাওয়ের উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে ক্ষমতায় যেই আসুন, চীনের এই অর্থনৈতিক অগ্রগতি থেমে থাকবে-এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে চীন এখন কোন পথে? চীনে যে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি চালু হয়েছে, তা কি আগামী ৫০ বছর টিকে থাকতে পারবে? নাকি চীন পুরোপুরি বাজার অর্থনীতিতে ফিরে যাবে? সেই সঙ্গে রয়েছে কমিউনিষ্ট পার্টির একক কর্তৃত্বের প্রশ্নটি। চীনে কমিউনিষ্ট পার্টি কি এককভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে আগামী ৫০ বছর পর্যন্ত? সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ এসব প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। চীনে ধ্রুপদী সমাজতন্ত্র নেই। চীন সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে চীনের সংবিধান সংশোধন করে সেখানে বাজার অর্থনীতি চালু করা হয়। এর মধ্য দিয়ে চীনে চার দশকের বেশিকাল ধরে চালু ষ্ট্যালিনবাদী কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির অবসান ঘটেছিল। সেখানে পুঁজিবাদী অর্থনীতির আদলে ষ্টক এক্সচেঞ্জ গড়ে তোলা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কমানো হয়েছে। ব্যক্তিগত খাত সৃষ্টি করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক 'কমিউন' ব্যবস্থা অনেক আগেই বাতিল করা হয়েছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করতে পারছেন। চীন জুড়ে ব্যক্তিগত খাতে গড়ে উঠেছে শত শত রেষ্টুরেন্ট, নাইট ক্লাব আর শিল্প প্রতিষ্ঠান। বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক, যেখানে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীরা শতকরা একশ' ভাগ লভ্যাংশ নিয়ে যেতে পারছেন। বিখ্যাত ম্যাকডোনাল্ড রেষ্টুরেন্টও রয়েছে প্রায় প্রতিটি বড় শহরে। বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের ফলে গ্রামগুলো এখন ছোট ছোট শহরে পরিণত হয়েছে। শহরগুলো এখন আর চেনা যায় না। সব আকাশছোঁয়া বাড়ি। ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত টাইম পত্রিকায় নতুন একটি শহর ঝড়হমলরধহম-এর ছবি ছাপা হয়েছে, যা দেখলে অবাক হতে হয়। সব আকাশছোঁয়া বাড়ি, যা শত শত শহরবাসীকে আশ্রয় দিচ্ছে। এরকম শত শত ঝড়হমলরধহম এখন চীনের সর্বত্র গড়ে তোলা হচ্ছে। সপষ্টতই একুশ শতক হচ্ছে চীনের, যেমনি উনিশ শতক ছিল ব্রিটেনের এবং বিশ শতক ছিল ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চীনকে আজ অন্যতম শক্তিতে পরিণত করেছে। চীনের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ এখন ২ ট্রিলিয়ন ডলার। ফরচুন ম্যাগাজিনের মতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫০০টি বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে চীনের একারই রয়েছে ৩৭টি কোম্পানি। চীনে জ্বালানি চাহিদা বাড়ছে। বিশ্বে জ্বালানির (ব্যবহৃত) ১৬ ভাগ শুধু চীনেই ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি তেল ব্যবহারের দিক থেকে চীন শীর্ষ ৩টি দেশের একটি। চীনে বর্তমানে ২১ মিলিয়ন, অর্থাৎ ২ কোটি ১০ লাখ ছাত্রছাত্রী শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছে। প্রতিবছর ৩ লাখ ছাত্রছাত্রী বিদেশে পড়াশোনার জন্য যায়। ২০৬ মিলিয়ন ছাত্রছাত্রী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে যাচ্ছে নিয়মিত। ১৯৪৮ সালে চীনে যেখানে শিক্ষার হার ছিল মাত্র ২০ ভাগ, এখন শতকরা ১০০ ভাগ লোকই সেখানে শিক্ষিত। বিশ্বব্যাংক যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় চীন এরইমধ্যে ২০ কোটি লোককে দারিদ্র্যের মধ্য থেকে বের করে আনতে পেরেছে। চীনকে বলা হয় পঞ্চম 'ড্রাগন' (ঋরভঃয উৎধমড়হ) অর্থাৎ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তার অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও জার্মানির পাশাপাশি। কিন্তু ২০১০ সালেই জাতীয় উৎপাদনের দিক থেকে জাপানকে পেছনে ফেলে দেয় চীন। একটি পরিসংখ্যান দিলেই এটি বুঝতে সহজ হবে। বিশ্বে যত জুতা ও ফটোকপিয়ার তৈরি হয় তার তিন ভাগের দু'ভাগ উৎপাদিত হয় চীনে। বিশ্বের উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ৬০ ভাগ, ডিভিডির ৫৫ ভাগ, ৫০ ভাগ ডিজিটাল ক্যামেরা, ৩০ ভাগ পারসোনাল কম্পিউটার, ৭৫ ভাগ বাচ্চাদের খেলনা শুধু চীনেই তৈরি হয়। এই যে বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি, বিশ্ব রাজনীতিতে তার একটি ভূমিকা তো থাকবেই। প্রায় ৫৫ জাতি ও উপজাতি, ২২টি প্রদেশ, ৫টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, ৪টি বিশেষ অঞ্চল, ১৪৭টি বিশেষ এলাকা ও প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার বিশাল এক দেশ চীন। এই চীন একুশ শতকে বিশ্ব রাজনীতিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করবে। কমিউনিষ্ট পার্টি হচ্ছে অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি, যার কার্ডধারী সদস্য সংখ্যা হচ্ছে এখন ৭৬ মিলিয়ন। এরা সবাই উচ্চশিক্ষিত। আগের মতো সারা জীবনের জন্য এখন কেউ আর পলিটব্যুরোতে থাকেন না। নেতারা অবসরে যান। সত্যিকার অর্থেই একটি যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চীনে। তাহলে আগামীতে আমরা কেমন সমাজ কাঠামো দেখতে পাব চীনে? পশ্চিমা সমাজের মতো এক ধরনের গণতন্ত্র ও পুরোপুরি বাজার অর্থনীতিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থা? না, চীনে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র চালুর কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং এতে করে চীন ভেঙে যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার ঘবড়-ধঁঃযড়ৎরঃধৎরধহরংস লাতিন আমেরিকার ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃরংস ও ইউরোপের, বিশেষ করে নরডিকভুক্ত দেশগুলোর ঝড়পরধষ উবসড়পৎধপু-র সমন্বয়ে চীনে এক ধরনের নয়া সমাজ ব্যবস্থার জন্ম হচ্ছে, যাকে সমাজতন্ত্র বলা যাবে না, আবার পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাও বলা যাবে না। এটা এক ধরনের মডেল, যেখানে অর্থনীতি মূল পুরোধাশক্তি। সেনাবাহিনীতে কমিউনিষ্ট পার্টির একক কর্তৃত্ব এখনও বজায় রয়েছে। যতদিন এই কর্তৃত্ব বজায় থাকবে, ততদিন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কমিউনিষ্ট পার্টির রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর কর্তৃত্ব বজায় থাকবে। তবে সমস্যা যে চীনে নেই, তা নয়। জনগোষ্ঠীর মাঝে ২০৭ মিলিয়ন লোক এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যাদের দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ ডলারের নিচে। বিশ্বব্যাংক এই আয়কে দারিদ্র্যের সীমারেখা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। চীনে সবচেয়ে বেশি পরিবেশ দূষণ হয়। পরিসংখ্যান বলে, পরিবেশ দূষণের কারণে ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা ২৮ দশমিক ৫ ভাগ। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের হারও চীনে বেশি। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘর মুসলমানদের নিয়েও সমস্যা রয়েছে চীনের, যা সাম্প্রতিক সময়ে অন্যতম আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের 'নয়া সম্পর্ক' চীনের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। তারপরও বিশ্ব আসরে চীনের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে চীন সৈন্য পাঠাচ্ছে। এনপিটি ও সিটিবিটিতে চীন স্বাক্ষর করেছে। নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার্স গ্রুপেরও সদস্য চীন। সুতরাং আগামী দিনে চীনের ভূমিকা যে বারে বারে আলোচিত হতে থাকবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তাই জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডেভিড সামবোগ (উধারফ ঝযধসনধঁময)-এর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি মন্তব্য করছেন ----- এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ১৯৪৯ সালের চীন, আর ২০০৯ সালের চীন এক নয়। আর ২০৪৯ সালের চীন, যখন তার বয়স গিয়ে দাঁড়াবে একশ' বছর, তখন চীনে কোন ধরনের সমাজ ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাব তা এই মুহূর্তে বলা সত্যিই কঠিন। লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments