প্রশাসনের ছত্রছায়ায় জবরদখল
ভূমিদস্যু ও জবরদখলকারীদের অবৈধ দখলে চলে গেছে দেশের লাখ লাখ একর জমি। স্বাধীনতার পর থেকে কোনো সরকারের আমলে সরকারি খাসজমি উদ্ধার ও তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। প্রশাসনের সহায়তায় সুবিধাভোগী প্রভাবশালী মহল নানা কৌশলে করায়ত্ত করে নিয়েছে এসব জমি। অর্থের বিনিময়ে এগুলো হাতবদলও হচ্ছে। কোনো কোনো সময় খাসজমি আংশিক উদ্ধার করা হলেও আবার তা চলে গেছে ভূমিদস্যুদের দখলে।
ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করার পরও তা নানা কৌশলে অাবার হাতিয়ে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এবং আইনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা কব্জা করে ভোগদখল করে যাচ্ছে তারা। এ ধরনের জবরদখলের অবসান না হলে ন্যায়বিচারসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমঅবনতি রোধ করা সম্ভব নয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বর্তমানে সারাদেশে অবৈধ দখলে রয়েছে এক লাখ একরেরও বেশি খাসজমি। এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছে ২০ হাজার একরেরও বেশি। প্রভাবশালী মহল নামে-বেনামে এসব জমি ভোগদখল করছে। ক্ষেত্রবিশেষে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে বেচাকেনা ছাড়াও চাষবাস, স্থাপনা নির্মাণ এমনকি জমি ভাড়ার বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে অবাধে। মাঝে মধ্যে হম্বিতম্বি করলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ ব্যাপারে আদৌ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে খাস জমি রয়েছে ১২ লাখ একরেরও বেশি। ওই হিসাব মতে, শুধু কৃষি জমির ৬৩ হাজার একরই রয়েছে অবৈধ দখলে। বর্তমানে এই অবৈধ দখলের পরিমাণ কত তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করায় সরকারি খাসজমির বেহাল অবস্থা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও পুরোপুরি অবহিত নয়। স্বয়ং কৃষিমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, মোট খাসজমির সঠিক পরিসংখ্যান এবং অবৈধ দখলে চলে যাওয়া জমির পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ে নেই। এ অব্যবস্থাপনার অবসান করার লক্ষ্যে খাসজমি উদ্ধার করার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালের নীতিমালা অনুযায়ী ভূমি বন্দোবস্ত এবং অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে। রাজধানীসহ দেশের বিপুল পরিমাণ খাসজমি ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাওয়ায় বন্দোবস্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার থাকলেও বঞ্চিত হচ্ছে ভূমিহীন পরিবার। দেশের অন্যান্য দুর্ঘটের মতো এসব খাসজমি দখলের পেছনেও প্রশাসনের কালোহাতই জড়িত। নিয়মানুসারে খাসজমি রক্ষণাবেক্ষণের দায়-দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। কিন্তু বাস্তবচিত্র অন্যরকম। প্রশাসনের জ্ঞাতসারেই খাসজমি বেহাত হচ্ছে। এ অবস্থা একদিনে হয়নি। ক্রমশ জবরদখলের চক্রান্ত পোক্ত হয়েছে। নিচ থেকে ওপর মহল পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করছে ভূমিদস্যুরা। ভুয়া কাগজপত্র ও বন্দোবস্ত দেখিয়ে তারা খাসজমি দখলে নিচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটিয়ে সাধারণ মানুষের দখলে থাকা জমি কেড়ে নেয়া হচ্ছে, বনভূমি দখলের নিশানা হিসেবে বাগান, বনায়ন, এমনকি ছোট-বড় স্থাপনা নির্মাণ চলছে, নদীর তীর থেকে তল পর্যন্ত সীমানাখুঁটি গেড়ে বালি ভরাট করে চলছে দখলের মহোৎসব। অতীতের মতো এখনও এসব সরকারি সম্পত্তি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, পদস্থ কর্মকর্তা এবং সমাজের প্রভাবশালীরাই দখল করছে বলে অভিযোগ আছে। উচ্ছেদের নামে যে নাটক চলছে দুই-এক মাসের মধ্যেই ঘটছে তার যবনিকাপাত। বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে দলীয় প্রভাব এবং প্রশাসনের সহায়তায় খাসজমি জবরদখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে অনেকটা উৎসবের আমেজে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা জেলায় ২০ হাজার ২৬৩ একর খাসজমি রয়েছে। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ও পৌরসভা এলাকায় খাসজমিতে প্রভাবশালী মহল ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে গড়ে তুলেছে বিভিন্ন প্রজেক্ট। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, বড় ব্যবসায়ী, পদস্থ কর্মকর্তা ও অন্যান্য শক্তিশালী গ্রুপ। এর মধ্যে সবচেয়ে চাক্ষুস দখলদার হচ্ছে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানি। এদের দৌরাত্ম্যে ঢাকার পুরনো খালসহ নগরীর সন্নিহিত এলাকার সরকারি জলাশয় পর্যন্ত বেহাত হয়ে যাচ্ছে। খাসজমির অবৈধ দখলদার তথা ভূমিদস্যুদের জবরদখল তৎপরতার প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলে এরকম ভাবনার অবকাশ আছে যে, দেশে আইনের শাসন বলে কিছু নেই। সরকার বদল হলে এই শূন্যতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ক্ষেত্রবিশেষ প্রশাসন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে জবরদখলকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কসুর করে না। প্রকৃতপক্ষে সরকারি খাসজমির মালিক হচ্ছে দেশের জনগণ। এ জমি কাউকে দিলে তার প্রথম দাবিদার ভূমিহীন পরিবার। একথা কাগজ-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই। ফলে দরিদ্র মানুষ ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আইন প্রয়োগ না হওয়ায় চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে গোটা ভূমি ব্যবস্থাপনায়। জবরদখলের ফলে খুন-খারাবি, মামলা-মোকাদ্দমা বাড়ছে, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেশের মৌলিক উন্নয়ন। এ অবস্থা কোনো বিবেচনায়ই কাঙ্ক্ষিত নয়। জবরদখল উচ্ছেদ করতে হবে, দরিদ্র মানুষের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। উপরন্তু ভূমিদস্যুদের আনতে হবে দৃষ্টান্তমূলক সাজার আওতায়। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ এবং দৃঢ় রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
No comments