এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে by আফজাল হোসেন
মুখে আমরা যত কথাই বলি, মনে মনে কতটুকু চেয়েছিলাম, সবাই তা জানি। আশার স্বভাব, বসতে দিলে শুতে চায়। তেমনি আমরাও আশার সঙ্গে চেয়েছিলাম আরও বেশি, তাই যা হওয়ার হলো। বেদনায় ভালো রকম আহত হয়েছি, দুঃখে কেউ নিঃশেষ হয়ে যাইনি—সে প্রমাণ কড়ায়-গন্ডায় পাওয়া হলো বাংলাদেশে বিশ্বকাপের শেষ দিনে।
মিরপুর স্টেডিয়ামে নিজেদের স্বার্থ ছাড়া সেদিন প্রায় ২২ হাজার দর্শক হাজির হয়েছিল কেন? কোন দায় থেকে, কোন কর্তব্যে, কিসের তাগিদে? খেলা ছিল নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার, তাতে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছুই ছিল না, তবু হাজির ছিল বোধ হয় ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’ কথাটা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইচ্ছায়। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববাসীকে দেখানো সম্ভব হলো, যে চোখ দিয়ে আমাদের দেখার অভ্যাস, সেটা বদলাতে হবে তাদের। অনুমান, মনগড়া ধারণা অনুযায়ী এই দেশ ও মানুষকে দেখা যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
সব দোষ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির নয়, আমরাও অনেক কিছু করি, করেছি, করে থাকি। নিজেদের মন্দ দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ করে দিয়েছি আবার সেই আমরাই দেখালাম, সুযোগ পেলে আমরাও পারি। প্রমাণ করা হলো, মন্দের চেয়ে আমাদের মধ্যে ভালোর পরিমাণই বেশি। আমাদের দরকার যথার্থ উপলক্ষ।
অবাক হতে হয়, এই সেই মানুষ, যাদের মনে হারানোর শোক এখনো দগদগে ঘায়ের মতো থেকে যাওয়ার কথা! দেখা গেল বর্তমানকে ভুলে আগামীর স্বপ্ন নিয়ে ভালো আছে সবাই। একই স্টেডিয়ামে সামান্য কদিন আগে যে দুঃখের কাহিনি রচিত হয়েছিল, তার কোনো চিহ্ন চোখে পড়েনি।
পাওয়ার ধরন কত রকমের হয়। খেলায় হেরে দুঃখ পাই সবাই, কেউ একজন শুধু দুঃখের যাতনায় ঢিল ছুড়ে বসে বিদেশি খেলোয়াড়দের গাড়িতে। এই এক তিল অসংযত আচরণে দুঃখ-ভারক্রান্ত কোটি মানুষের মনপ্রাণ লজ্জায় নুয়ে যায়। পরদিন মাত্র কজন যুবক দেশের মানুষের লজ্জা কাটাতে, বিদেশি খেলোয়াড়েরা যে হোটেলে থাকে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সবার হাতে প্ল্যাকার্ড, সেই প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘আমরা দুঃখিত’।
মাত্র কজনের এই সভ্য, অতি সুন্দর আচরণ আমাদের হেঁট হওয়া মাথা আবার খানিকটা উঁচু করে দেয়। প্ল্যাকার্ডধারীরা সংখ্যায় বেশি ছিল না কিন্তু তাদের অসাধারণ ভূমিকায় পুরো জাতির অর্জন কম হয়নি। আমাদের জানা হয়, সবার মাথা একসঙ্গে হেঁট করে দিতে মাত্র একজনে পারে, আবার মুষ্টিমেয়র ইচ্ছায়, আগ্রহে, দায়িত্বশীল আচরণে, লজ্জা কাটিয়ে গৌরব পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।
হেরে যাওয়া দল দুঃখ পায়, সে বেদনায় সব শেষ হয়ে গেছে, অনুভব জাগে না। পরাজয় নতুন করে জয়ের আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে মনে। খেলায় পরাজয় মানে খেলায়ই পরাজয়, ব্যক্তি বা সমষ্টির পরাজয় নয়। পরাজয় মানে বিষাদ, খণ্ডকালীন অস্বস্তি। পরাজয়ে গৌরব ভেসে যায় না, হতাশা ঠেসে ধরে না।
খেলায় অহংকারের জায়গা নেই বলে জয়ের অহংকারে ফুলে-ফেঁপে ওঠা বা পরাজয়ে অহংকার ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে, এমন আশঙ্কা নেই। খেলায় জয়ী হলে কেউ ভাবে না আমি বা আমরা শ্রেষ্ঠ। পরাজিতরা ভাবে না চক্রান্ত করে তাদের হারানো হয়েছে। পরাজয়ে দেশীয় বা বিদেশি শক্তির কালো হাত রয়েছে, খেলায় এমন ভাবার মনোবৃত্তি বা সুযোগ নেই। খেলায় জিততে প্রতিদিন বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন। কোনো এক সময়ের যোগ্যতায় সারাজীবন জয়ের প্রত্যাশা করা যায় না। খেলায় চাই নিষ্ঠা, প্রত্যয়, মনোবল। গলার জোর, গায়ের জোর দিয়ে খেলা হয় না, কৌশলের প্রয়োজন হয়, কুটপনা নয়।
খেলা মানে সংযম, ধৈর্য, জয়ের জন্য দুর্বার আকাঙ্ক্ষা। জয়ের জন্য যা খুশি তাই নয়। খেলা মানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু নয়, অপর পক্ষ। খেলা অপর পক্ষকে অসম্মান করতে শেখায় না। প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠতে বলে না।
খেলা মানে সভ্যতা, সৌজন্যবোধ, সহিষ্ণুতা। ভাষায়, আচরণে, ব্যবহারে সতর্কতার সঙ্গে সৌর্ন্দযকে রক্ষা। খেলা মানে সন্দেহপ্রবণতা নয়, অন্যের শক্তিকে ধুলোজ্ঞান নয়; নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থা, ভরসা, অন্যের প্রতি সমীহ। মান-অপমান নয়, ছোট বা বড় প্রমাণের জন্য নয়, মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব চর্চার জন্যই খেলা।
খেলায় মিথ্যার কোনো জায়গা নেই, শঠতার কোনো প্রশ্রয় নেই। মনে এক, মুখে আরেক—এমন অসুস্থতা খেলার মাঠে অচল। উত্তেজনা প্রশমনের জন্য খেলায় চিৎকার চলে, হুংকার অচল। খেলায় জিততে মিটিং, মিছিল, ভাষণ ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে না। মানুষকে আচরণে-বিচরণে সন্ত্রস্ত করার কায়দা-কানুন খেলায় অচল। অস্ত্রশস্ত্র বা হিংসার যাবতীয় উপকরণ খেলার মাঠে অপদার্থ বিশেষ। অপদার্থ শ্রেণীর মানুষ খেলার মাঠে অপদার্থই। মেধা, যোগ্যতা ছাড়া কারও দয়াদাক্ষিণ্যে খেলোয়াড় পরিচিতি গড়ে ওঠে না।
নিজ স্বার্থে, ক্ষমতার প্রতাপে অক্ষম মানুষকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু কোনো ক্ষমতাবান একজন অক্ষমকে সফল খেলোয়াড় বানাতে পারে না। পেশিশক্তিতে সামাজিক জীবনে এক ধরনের প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব, খোলার মাঠে নয়।
টাকার বিনিময়ে অদরকারি মানুষকে দরকারিতে পরিণত করা যায়, টাকা দরকারি খেলোয়াড় বানাতে অক্ষম। তোষামোদকারী, চাটুকার শ্রেণীর মানুষও খেলার মাঠে অচল। অচলদের সচল হওয়ার সুযোগ থাকলেও তা নেপথ্যে।
খেলোয়াড়েরা মাঠে আসে খেলতে, দর্শক যায় দেখতে। তোষামোদকারীরা ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’ প্রবাদটার মতো। যখন সবাই খেলার আনন্দে মেতে থাকে, ওই চরিত্রেরা খেলার বদলে মাথায় অন্য কিছুর অঙ্ক সাজায়। খেলার বদলে অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে প্রয়োজনীয় করে তোলে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট অশুভর লেজে পা দেয়নি, মানুষের অন্তরের সব শুভকে জাগিয়ে দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন মানুষেরা একসঙ্গে হয়েছে, বিষণ্ন মানুষেরা একত্র হয়েছে। বিপন্ন মন আনন্দের খোরাক পেয়ে গেছে। হতাশাগ্রস্ত মানুষ পেয়েছে আশার আলোর সন্ধান।
মানুষ তিক্ততা ভুলেছে। এখন পরস্পরকে ঘনিষ্ঠ মনে হয় তাদের। একসঙ্গে মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে, বেদনার্ত হয়। দলেবলে মিলে আনন্দে উজ্জ্বল, শোকে মুহ্যমান হয়। বিশ্বকাপে ক্রিকেটের উত্তেজনায় ‘এক জাতি এক দেশ’—এ পুরোনো পরিচয় আবার ফেরত পাওয়া হয়েছে। সংকীর্ণতা সরেছে, সংকোচ ঘুচেছে। ক্রিকেট আমাদের নত মাথা উঁচু করে দিয়েছে। দরিদ্র দেশের ক্রিকেটকে এখন দরিদ্র বলতে বাধবে।
বনেদিরা ক্রিকেটকে সমীহ করে, এখন ক্রিকেট এবং বাংলাদেশ—এই দুইকে সমীহ না দেখিয়ে উপায় নেই। উষ্ণ আতিথেয়তা, সম্ভাবনাময় ক্রিকেট দিয়ে এবার বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনেছে। দুর্যোগের বাংলাদেশ, কলঙ্কিত বাংলাদেশ, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙার দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে ক্রিকেট। আমরা জানি, বহু দিনে বহু মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষায় এমনটা সম্ভব হয়েছে। আমরা জানি, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা ছাড়া ক্রিকেটের শির এতটা উন্নত হতো না।
আমাদের অনেক ক্ষুদ্রতা কেটেছে, প্রচলিত অনেক স্বভাবের বদল ঘটেছে কিন্তু একাংশের ক্ষুদ্রতা অব্যয়, অক্ষয় থাকবে। চেনা স্বভাবের সামান্য অংশ বদলাবে না।
পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল... হ্যাঁ, আমরা টের পাচ্ছি ভোরের আলো ফুটেছে। শুনতে পাচ্ছি পাখিদের কলকাকলি। এক অনির্বচনীয় সুখের অনুভূতি মানুষের মনে। অসাধারণ এক সুগন্ধ তাদের প্রাণে বহমান। সবার অনুভব, ‘কাননে কুসুম কলি কত যে ফুটিল’।
নিশ্চয় ফুটেছে কুসুম, তাই জগৎজুড়ে সৌরভ, কলকাকলিতে মুখর সোনার বাংলার সোনার মানুষদের মন। এই তরুণ সৌরভ কি অটুট থাকবে? এই মুখরতা ভবিষ্যতে কি নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে?
পুরোনো কাণ্ডে, শাখা-প্রশাখায় নতুন রঙের পাতা, স্বভাবে চির পুরোনো। অচল মানুষের সচল তোষামোদি, নানা ভ্রষ্টাচার আপাতত পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। এই অসহায়ত্ব তো বেশি দিন থাকবে না। সে তো মনে মনে গাইছে ‘এই দিন তো দিন নয়, আরও দিন আছে ... ’
ক্রিকেট নিয়ে মানুষে, দেশে এত বড় বদল ঘটে গেল, বিশ্বকাপের বছর গড়িয়ে যাবে, উৎসবের আমেজ হয়ে যাবে আনন্দময় স্মৃতি। আমাদের ঘরে ঘরে শিয়রে বা বিছানার পাশের টেবিলে টেবিলে তেতো স্বাদের লাল সিরাপটা কি অনড় থাকবে? আমাদের রেহাই দেবে না? চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকবে, শাসাবে, শাসিয়েই যাবে, আমাকে ছাড়া চলবে না তোমাদের?
বিশ্বকাপের জয় সর্বত্র, সব মানুষের মনে। পরাজয় একখানে, যেখানে তার কোনো হাত নেই।
আফজাল হোসেন: অভিনেতা ও বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা।
মিরপুর স্টেডিয়ামে নিজেদের স্বার্থ ছাড়া সেদিন প্রায় ২২ হাজার দর্শক হাজির হয়েছিল কেন? কোন দায় থেকে, কোন কর্তব্যে, কিসের তাগিদে? খেলা ছিল নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার, তাতে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছুই ছিল না, তবু হাজির ছিল বোধ হয় ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’ কথাটা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইচ্ছায়। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববাসীকে দেখানো সম্ভব হলো, যে চোখ দিয়ে আমাদের দেখার অভ্যাস, সেটা বদলাতে হবে তাদের। অনুমান, মনগড়া ধারণা অনুযায়ী এই দেশ ও মানুষকে দেখা যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
সব দোষ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির নয়, আমরাও অনেক কিছু করি, করেছি, করে থাকি। নিজেদের মন্দ দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ করে দিয়েছি আবার সেই আমরাই দেখালাম, সুযোগ পেলে আমরাও পারি। প্রমাণ করা হলো, মন্দের চেয়ে আমাদের মধ্যে ভালোর পরিমাণই বেশি। আমাদের দরকার যথার্থ উপলক্ষ।
অবাক হতে হয়, এই সেই মানুষ, যাদের মনে হারানোর শোক এখনো দগদগে ঘায়ের মতো থেকে যাওয়ার কথা! দেখা গেল বর্তমানকে ভুলে আগামীর স্বপ্ন নিয়ে ভালো আছে সবাই। একই স্টেডিয়ামে সামান্য কদিন আগে যে দুঃখের কাহিনি রচিত হয়েছিল, তার কোনো চিহ্ন চোখে পড়েনি।
পাওয়ার ধরন কত রকমের হয়। খেলায় হেরে দুঃখ পাই সবাই, কেউ একজন শুধু দুঃখের যাতনায় ঢিল ছুড়ে বসে বিদেশি খেলোয়াড়দের গাড়িতে। এই এক তিল অসংযত আচরণে দুঃখ-ভারক্রান্ত কোটি মানুষের মনপ্রাণ লজ্জায় নুয়ে যায়। পরদিন মাত্র কজন যুবক দেশের মানুষের লজ্জা কাটাতে, বিদেশি খেলোয়াড়েরা যে হোটেলে থাকে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সবার হাতে প্ল্যাকার্ড, সেই প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘আমরা দুঃখিত’।
মাত্র কজনের এই সভ্য, অতি সুন্দর আচরণ আমাদের হেঁট হওয়া মাথা আবার খানিকটা উঁচু করে দেয়। প্ল্যাকার্ডধারীরা সংখ্যায় বেশি ছিল না কিন্তু তাদের অসাধারণ ভূমিকায় পুরো জাতির অর্জন কম হয়নি। আমাদের জানা হয়, সবার মাথা একসঙ্গে হেঁট করে দিতে মাত্র একজনে পারে, আবার মুষ্টিমেয়র ইচ্ছায়, আগ্রহে, দায়িত্বশীল আচরণে, লজ্জা কাটিয়ে গৌরব পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।
হেরে যাওয়া দল দুঃখ পায়, সে বেদনায় সব শেষ হয়ে গেছে, অনুভব জাগে না। পরাজয় নতুন করে জয়ের আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে মনে। খেলায় পরাজয় মানে খেলায়ই পরাজয়, ব্যক্তি বা সমষ্টির পরাজয় নয়। পরাজয় মানে বিষাদ, খণ্ডকালীন অস্বস্তি। পরাজয়ে গৌরব ভেসে যায় না, হতাশা ঠেসে ধরে না।
খেলায় অহংকারের জায়গা নেই বলে জয়ের অহংকারে ফুলে-ফেঁপে ওঠা বা পরাজয়ে অহংকার ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে, এমন আশঙ্কা নেই। খেলায় জয়ী হলে কেউ ভাবে না আমি বা আমরা শ্রেষ্ঠ। পরাজিতরা ভাবে না চক্রান্ত করে তাদের হারানো হয়েছে। পরাজয়ে দেশীয় বা বিদেশি শক্তির কালো হাত রয়েছে, খেলায় এমন ভাবার মনোবৃত্তি বা সুযোগ নেই। খেলায় জিততে প্রতিদিন বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন। কোনো এক সময়ের যোগ্যতায় সারাজীবন জয়ের প্রত্যাশা করা যায় না। খেলায় চাই নিষ্ঠা, প্রত্যয়, মনোবল। গলার জোর, গায়ের জোর দিয়ে খেলা হয় না, কৌশলের প্রয়োজন হয়, কুটপনা নয়।
খেলা মানে সংযম, ধৈর্য, জয়ের জন্য দুর্বার আকাঙ্ক্ষা। জয়ের জন্য যা খুশি তাই নয়। খেলা মানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু নয়, অপর পক্ষ। খেলা অপর পক্ষকে অসম্মান করতে শেখায় না। প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠতে বলে না।
খেলা মানে সভ্যতা, সৌজন্যবোধ, সহিষ্ণুতা। ভাষায়, আচরণে, ব্যবহারে সতর্কতার সঙ্গে সৌর্ন্দযকে রক্ষা। খেলা মানে সন্দেহপ্রবণতা নয়, অন্যের শক্তিকে ধুলোজ্ঞান নয়; নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থা, ভরসা, অন্যের প্রতি সমীহ। মান-অপমান নয়, ছোট বা বড় প্রমাণের জন্য নয়, মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব চর্চার জন্যই খেলা।
খেলায় মিথ্যার কোনো জায়গা নেই, শঠতার কোনো প্রশ্রয় নেই। মনে এক, মুখে আরেক—এমন অসুস্থতা খেলার মাঠে অচল। উত্তেজনা প্রশমনের জন্য খেলায় চিৎকার চলে, হুংকার অচল। খেলায় জিততে মিটিং, মিছিল, ভাষণ ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে না। মানুষকে আচরণে-বিচরণে সন্ত্রস্ত করার কায়দা-কানুন খেলায় অচল। অস্ত্রশস্ত্র বা হিংসার যাবতীয় উপকরণ খেলার মাঠে অপদার্থ বিশেষ। অপদার্থ শ্রেণীর মানুষ খেলার মাঠে অপদার্থই। মেধা, যোগ্যতা ছাড়া কারও দয়াদাক্ষিণ্যে খেলোয়াড় পরিচিতি গড়ে ওঠে না।
নিজ স্বার্থে, ক্ষমতার প্রতাপে অক্ষম মানুষকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু কোনো ক্ষমতাবান একজন অক্ষমকে সফল খেলোয়াড় বানাতে পারে না। পেশিশক্তিতে সামাজিক জীবনে এক ধরনের প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব, খোলার মাঠে নয়।
টাকার বিনিময়ে অদরকারি মানুষকে দরকারিতে পরিণত করা যায়, টাকা দরকারি খেলোয়াড় বানাতে অক্ষম। তোষামোদকারী, চাটুকার শ্রেণীর মানুষও খেলার মাঠে অচল। অচলদের সচল হওয়ার সুযোগ থাকলেও তা নেপথ্যে।
খেলোয়াড়েরা মাঠে আসে খেলতে, দর্শক যায় দেখতে। তোষামোদকারীরা ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’ প্রবাদটার মতো। যখন সবাই খেলার আনন্দে মেতে থাকে, ওই চরিত্রেরা খেলার বদলে মাথায় অন্য কিছুর অঙ্ক সাজায়। খেলার বদলে অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে প্রয়োজনীয় করে তোলে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট অশুভর লেজে পা দেয়নি, মানুষের অন্তরের সব শুভকে জাগিয়ে দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন মানুষেরা একসঙ্গে হয়েছে, বিষণ্ন মানুষেরা একত্র হয়েছে। বিপন্ন মন আনন্দের খোরাক পেয়ে গেছে। হতাশাগ্রস্ত মানুষ পেয়েছে আশার আলোর সন্ধান।
মানুষ তিক্ততা ভুলেছে। এখন পরস্পরকে ঘনিষ্ঠ মনে হয় তাদের। একসঙ্গে মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে, বেদনার্ত হয়। দলেবলে মিলে আনন্দে উজ্জ্বল, শোকে মুহ্যমান হয়। বিশ্বকাপে ক্রিকেটের উত্তেজনায় ‘এক জাতি এক দেশ’—এ পুরোনো পরিচয় আবার ফেরত পাওয়া হয়েছে। সংকীর্ণতা সরেছে, সংকোচ ঘুচেছে। ক্রিকেট আমাদের নত মাথা উঁচু করে দিয়েছে। দরিদ্র দেশের ক্রিকেটকে এখন দরিদ্র বলতে বাধবে।
বনেদিরা ক্রিকেটকে সমীহ করে, এখন ক্রিকেট এবং বাংলাদেশ—এই দুইকে সমীহ না দেখিয়ে উপায় নেই। উষ্ণ আতিথেয়তা, সম্ভাবনাময় ক্রিকেট দিয়ে এবার বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনেছে। দুর্যোগের বাংলাদেশ, কলঙ্কিত বাংলাদেশ, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙার দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে ক্রিকেট। আমরা জানি, বহু দিনে বহু মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষায় এমনটা সম্ভব হয়েছে। আমরা জানি, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা ছাড়া ক্রিকেটের শির এতটা উন্নত হতো না।
আমাদের অনেক ক্ষুদ্রতা কেটেছে, প্রচলিত অনেক স্বভাবের বদল ঘটেছে কিন্তু একাংশের ক্ষুদ্রতা অব্যয়, অক্ষয় থাকবে। চেনা স্বভাবের সামান্য অংশ বদলাবে না।
পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল... হ্যাঁ, আমরা টের পাচ্ছি ভোরের আলো ফুটেছে। শুনতে পাচ্ছি পাখিদের কলকাকলি। এক অনির্বচনীয় সুখের অনুভূতি মানুষের মনে। অসাধারণ এক সুগন্ধ তাদের প্রাণে বহমান। সবার অনুভব, ‘কাননে কুসুম কলি কত যে ফুটিল’।
নিশ্চয় ফুটেছে কুসুম, তাই জগৎজুড়ে সৌরভ, কলকাকলিতে মুখর সোনার বাংলার সোনার মানুষদের মন। এই তরুণ সৌরভ কি অটুট থাকবে? এই মুখরতা ভবিষ্যতে কি নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে?
পুরোনো কাণ্ডে, শাখা-প্রশাখায় নতুন রঙের পাতা, স্বভাবে চির পুরোনো। অচল মানুষের সচল তোষামোদি, নানা ভ্রষ্টাচার আপাতত পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। এই অসহায়ত্ব তো বেশি দিন থাকবে না। সে তো মনে মনে গাইছে ‘এই দিন তো দিন নয়, আরও দিন আছে ... ’
ক্রিকেট নিয়ে মানুষে, দেশে এত বড় বদল ঘটে গেল, বিশ্বকাপের বছর গড়িয়ে যাবে, উৎসবের আমেজ হয়ে যাবে আনন্দময় স্মৃতি। আমাদের ঘরে ঘরে শিয়রে বা বিছানার পাশের টেবিলে টেবিলে তেতো স্বাদের লাল সিরাপটা কি অনড় থাকবে? আমাদের রেহাই দেবে না? চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকবে, শাসাবে, শাসিয়েই যাবে, আমাকে ছাড়া চলবে না তোমাদের?
বিশ্বকাপের জয় সর্বত্র, সব মানুষের মনে। পরাজয় একখানে, যেখানে তার কোনো হাত নেই।
আফজাল হোসেন: অভিনেতা ও বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা।
No comments