ধর্ম- মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত by রেডিও তেহরান

উরোপে রেনেসাঁর সময় সেক্যুলারিজমের উৎপত্তি ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে তা প্রভাব বিস্তার করে। এই মতবাদ অনুযায়ী, রাজনীতি এবং শাসন ক্ষমতার সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ধর্ম ব্যক্তিগত একটি বিষয় এবং ব্যক্তির গন্ডিতেই তা সীমাবদ্ধ। কাজেই সেক্যুলারিজম রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্মের কোন ভূমিকাকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে না।
চার্চ বা গীর্জাগুলো যখন খ্রিস্ট ধর্মের নামে সমাজে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিল এবং জনগণের সাথে অন্যায় আচরণ করছিল, ঠিক সে সময় সেক্যুলারিজমের উৎপত্তি ঘটে। গীর্জাগুলোর চরম অন্যায়-অপরাধে অতিষ্ঠ হয়ে সে সময় ইউরোপের জনগণ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিষয়াদি তথা রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করার মতবাদ মেনে নেয়। তবে ইউরোপে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠিত হতে দীর্ঘ সময় লেগেছে এবং এ ইস্যুতে রক্তক্ষয়ী কয়েকটি যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে। ইউরোপে যখন সেক্যুলারিজমের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে তখন বিশ্বের অন্য প্রান্তে ঘটছে ভিন্ন ঘটনা। এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি সভ্যতা তখন প্রায় শক্তিহীন। এ অবস্থায় ইউরোপের কয়েকটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যাপক শক্তি অর্জন করে এবং এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে আগ্রাসন চালায়। এ সময় ঔপনিবেশিক দেশগুলো প্রাচ্যের সম্পদ লুণ্ঠন করার পাশাপাশি সেখানকার জনগণের মাঝে ধর্মবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। সবাইকে সেক্যুলার বানানোর চেষ্টা করে।
ইউরোপীয়রা প্রাচ্যের দেশগুলোর জনগণকে ধর্ম থেকে দূরে সরাতে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যবহারের কৌশল বেছে নেয়। তারা সেক্যুলারিজমের দীক্ষা দিতে উচ্চ শিক্ষার নামে তাদের অনেককেই প্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ইউরোপে নিয়ে যায়। এদের অনেকেই সেখানে গিয়ে শিল্প ও বিজ্ঞান ক্ষেত্রে ইউরোপের বিভিন্ন সাফল্য দেখে এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, পাশ্চাত্যের মতো প্রাচ্যেও ধর্মকে ব্যক্তির গন্ডিতে আবদ্ধ করতে হবে এবং পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিজমকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে। এক কথায় সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ধর্মকে দূরে সরাতে হবে।
ইউরোপীয়রা দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মুসলিম দেশগুলোতে বিভিন্ন কৌশলে সেক্যুলারিজম ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় পাশ্চাত্যপন্থী বুদ্ধিজীবীরা সেক্যুলারিজম বিস্তারে মূল ভূমিকা পালন করে। মুসলিম বিশ্বের কোন কোন শাসক গোষ্ঠীও নিজেদের স্বার্থে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা করে। তবে মুসলিম সমাজে সেক্যুলারিজম কখনোই ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে তুরস্কের মতো কোন কোন দেশের ইসলাম বিরোধী মহল সেক্যুলারিজমকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালায়। ১৯২৩ সালে কামাল আতাতুর্কের মাধ্যমে তুরস্কে আনুষ্ঠানিকভাবে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসলামী বিপ্লবের আগে ইরানেও সেক্যুলার ব্যবস্থা চালু ছিল। শাহ সরকার সর্বশক্তি দিয়ে পাশ্চাত্যের ঘনিষ্ঠ হবার এবং ইসলাম ধর্মকে সমাজ থেকে মূলোৎপাটনের চেষ্টা চালিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, সেক্যুলাররা গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার শ্লোগান দিলেও মুসলিম দেশগুলোর সেক্যুলার শাসকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বৈরাচারী এবং দেশের জনগণের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
মুসলিম দেশগুলোর মানুষ কখনোই মন থেকে সেক্যুলারিজমকে মেনে নেয়নি। কারণ এই মতবাদ মুসলিম দেশগুলোর জনগণের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং ধর্মের অবমাননা করছে। আসলে সেক্যুলারিজম হচ্ছে একটি বৈষয়িক মতবাদ। এই মতবাদ কেবল মানুষের বৈষয়িক চাহিদাকেই গুরুত্ব দেয়। এখানে আধ্যাত্মিকতার কোন স্থান নেই। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের জনগণের হৃদয় ও চিত্তে ইসলাম ধর্ম প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং মুসলিম বিশ্বের মানুষেরা গভীর ভাবে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাস করে। সম্ভবত এ কারণেই সেক্যুলাররা এখন ইসলামী শরীয়ত বা বিধি বিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে ইসলাম ধর্মকেও ব্যক্তি কেন্দ্রিক ইবাদত-বন্দেগী ও বিশ্বাসের গন্ডিতে আবদ্ধ করা যায়। তারা মুসলমানদেরকে ধর্মের রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলোকে উপেক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু নিঃসন্দেহে মুসলিম বিশ্বের জনগণ ক্রমেই আরও সচেতন হয়ে উঠছে। বিশ্বে এখন ইসলামী জাগরণ দেখা দিয়েছে। আর এই বাস্তবতা বিজাতীয় মতবাদ সেক্যুলারিজমের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে কাজ করছে। ইসলামী জাগরণ আসলে সমৃদ্ধ ইসলামী সভ্যতার বিকাশ ও ধর্মের প্রতি প্রত্যাবর্তনেরই প্রতিধ্বনি। সেক্যুলারিজম সমাজকে ধর্মের প্রভাবমুক্ত এমনকি সমাজ থেকে ধর্ম বিতাড়িত করার পক্ষে। এ অবস্থায় ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় এবং বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (রহ:) এর স্পষ্ট চিন্তা-দর্শন সেক্যুলারিজমের জন্য মহাবিপদ হিসেবে দেখা দেয়। ধর্ম যে রাজনীতি থেকে আলাদা নয় এবং সমাজে ইসলামী শিক্ষা যে অপরিহার্য্য তা ইমাম খোমেনী (রহঃ) নিজে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে প্রমাণ করে গেছেন।
এ কারণে পাশ্চাত্যের সেক্যুলার দেশগুলো এবং মুসলিম বিশ্বে তাদের মিত্ররা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে ওঠেপড়ে লাগে। কিন্তু তাদের এসব ষড়যন্ত্র ইসলামী বিপ্লবী আদর্শের বিস্তার এবং ইসলামী জাগরণের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইসলামী জাগরণের ধারা সূচিত হওয়ায় পাশ্চাত্যে পড়াশোনা করা অনেক বুদ্ধিজীবীও এখন ইসলামপন্থীদের সারিতে যোগ দিয়েছেন এবং সেক্যুলারিজমের বিরোধিতা করছেন। এসব চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরাও পাশ্চাত্যের সেক্যুলার দেশগুলোর আচরণে এখন স্ববিরোধিতার প্রমাণ পাচ্ছেন এবং ইসলাম সম্পর্কে সঠিক গবেষণার মাধ্যমে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌছতে সক্ষম হচ্ছেন যে, ইসলাম, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সাফল্যের ক্ষেত্রে কোন বাধা নয় বরং সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। ইরানের বিখ্যাত লেখক জালাল অলআহমাদ এমনই একজন ইরানি বুদ্ধিজীবী,যিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগেই পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করাকে এক ধরনের রোগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, পাশ্চাত্যের শিল্প ও প্রযুক্তির কাছে নিজেকে শপে দেয়া ঠিক হবে না বরং তা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।
বিশ্বখ্যাত ফিলিস্তিনী চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড সাঈদ নিজে খ্রিস্টান ছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেছেন। কিন্তু নিজের স্বকীয়তা ও পরিচিতি বিকিয়ে দেননি। তিনি তার বিখ্যাত ওরিয়েন্টালিজম বইয়ে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদদের ঔপনিবেশিক পদক্ষেপগুলো ফাঁস করে দিয়েছেন। ইসলামী জাগরণ সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্বে এ ধরনের চিন্তাবিদদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেক্যুলারিজমের প্রতি আগ্রহ কমার একটি বড় কারণ হলো, ইউরোপ তথা পাশ্চাত্য প্রাচ্যের দেশ ও জাতিগুলো বিশেষকরে মুসলমানদের অবমাননা করছে। ঔপনিবেশিক আমলে ইউরোপীয়রা অইউরোপীয়দের অসভ্য এমনকি জঙ্গী বলে আখ্যায়িত করতো। ওরিয়েন্টালিজম বইয়ে এডওয়ার্ড সাঈদ লিখেছেন, ইউরোপীয়দের দৃষ্টিতে পাচ্যের মানুষ যুক্তি, শান্তি ও উদারতার বিরোধী এবং তারা সব সময় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মধ্যে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও চিন্তাবিদ পিটার এল বার্গার তার সেক্যুলারিজম ইন রিট্রিট বইয়ে লিখেছেন, এ কথা ঠিক নয় যে, সেক্যুলারাইজেশনের মাধ্যমেই আধুনিকতার আগমন ঘটে। তিনি বর্তমান বিশ্বকে ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন এবং ইউরোপকে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ইসলামপন্থীদের শক্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবার কারণে সেক্যুলাররা তাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতি যেমন গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের নীতি থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। আলজেরিয়ার মতো অনেক মুসলিম দেশেই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে যে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসবে,তা তারা ভালোই করেই জানে। সেক্যুলারদের এ অবস্থান তাদের নিজেদের স্ববিরোধিতাকেই ফুটিয়ে তুলছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজম ক্রমেই কোনঠাসা হয়ে পড়ছে।
২য় পর্ব
গত পর্বে আমরা বলেছি, সেক্যুলারিজমে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। এই মতবাদ অনুযায়ী, ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয় এবং ব্যক্তির গন্ডিতেই তা সীমাবদ্ধ। পাশাপাশি পাশ্চাত্যে সেক্যুলারিজমের উৎপত্তি ও মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব বিস্তারের ইতিহাস নিয়েও আগের আসরে আমরা খানিকটা আলোচনা করেছি।
আজ আমরা মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের প্রভাব হ্রাস পাবার কারণ সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করবো।
আসলে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ভুল ধারনার কারণে পাশ্চাত্যপন্থী কোন কোন চিন্তাবিদ সেক্যুলারিজমের প্রতি ঝুকে পড়েছেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে এ ধরনের ভুল ধারনা ছড়িয়ে দেয়ার পেছনেও পাশ্চাত্যের দেশগুলোই মুল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এসব প্রচারণায় সবাই বিভ্রান্ত হননি। মধ্যযুগে গীর্জার বিরুদ্ধে সেক্যুলারদের অবস্থানের একটা বড় কারণ ছিলো, তারা বিশ্বাস করতো পোপ বা খ্রীষ্ট্রান ধর্মযাজক এবং তার সহযোগীরা, খ্রীষ্ট্রান ধর্মের নামে মানুষের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে হরণ করেছে। এ কারণে তারা রাজনীতিকে সম্পূর্ণরূপে ধর্মের প্রভাবমুক্ত করেছিল। এটা ঠিক যে, মুসলিম বিশ্বের কোন কোন দেশের শাসক শ্রেনীও স্বৈরাচারী আচরণ করছিল। আর তা দেখেই মুসলিম বিশ্বের পাশ্চাত্যপন্থীদের মনে এই ভুল ধারনার সৃষ্টি হয় যে, ইসলাম ধর্মও মানুষের স্বাধীনতার বিরোধী এবং এ অজুহাতে তারা ধর্মকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আলাদা করার চেষ্টা শুরু করে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসলাম ধর্মে মানুষের স্বাধীনতাকে আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার বলে মনে করা হয় এবং এই ঐশী অনুগ্রহ মানুষের কাছ থেকে কোনভাবেই ছিনিয়ে নেয়া যাবে না। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুসলমানরা সব সময় স্বৈরাচারী ও জুলুমবাজ শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। ফলে ইসলাম ধর্ম মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে বলে সেক্যুলাররা যে প্রচারণা চালাচ্ছে তার কোন ভিত্তি নেই। ইসলাম হচ্ছে সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ এক ঐশী ধর্ম। ইসলাম ধর্ম সমাজ,রাজনীতি সহ সব বিষয়েই পথ নির্দেশনা দিয়েছে। অন্য ভাবে বলা যায়, বর্তমানে প্রচলিত খ্রীষ্ট্রান ধর্মের মতো ইসলাম ধর্ম ব্যক্তির গণ্ডিতে আবদ্ধ নয় বরং ইসলাম ধর্ম সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচী বাতলে দিয়েছে। এসব কর্মসূচীর কোন কোনটি
কেবল শাসন ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমেই বাস্তবায়নযোগ্য। কাজেই ইসলাম ও রাজনীতি আলাদা কিছু নয়।
মুসলিম বিশ্বের সেক্যুলাররা অপর যে ভুল ধারনাটি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে তা হলো, তারা বলছে কেবল সেক্যুলারিজম তথা পাশ্চাত্য মতবাদই উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করে। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, মধ্যযুগে খ্রীষ্টান ধর্মযাজকদের আচার আচরণে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, খ্রীষ্ট্রান ধর্ম উন্নয়ন ও অগ্রগতির বিরোধী। এ অবস্থায় সেক্যুলারিজম জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলে ইউরোপীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। মুসলিম বিশ্বের সেক্যুলাররাও পশ্চিমা মডেল অনুসরণের মাধ্যমে এটা তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে যে, মুসলিম বিশ্বের বর্তমান পশ্চাৎপদ অবস্থা মুল কারণ হচ্ছে ইসলাম। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসলাম ধর্ম জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরোধীতো নয়ই বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও প্রসারের উপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য জ্ঞান অর্জনকে অবশ্য কর্তব্য হিসেবে ঘোষণা করেছে ইসলাম। সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সা:) এ সম্পর্কে বলেছেন, জ্ঞান অর্জন সব মুসলমান নারী ও পুরুষের জন্য ফরজ।
পবিত্র কোরানের বিভিন্ন আয়াতেও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এ গুরুত্ব উপলব্ধি করার কারণে এক সময় মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান ক্ষেত্রে নেতৃত্বের অবস্থানে চলে যেতে পেরেছিলেন। ইসলামের দিকনির্দেশনার কারণে মুসলমানরা সমৃদ্ধ ইসলামি সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে পাশ্চাত্যের অনেক বড় বড় চিন্তাবিদও এটা স্বীকার করছেন যে, ধর্ম মানা বা না মানার সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি ও অগ্রগতির কোন সম্পর্ক নেই এবং যে দেশ ও জাতি উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য পরিকল্পনা ও চেষ্টা চালায় তারাই কল্যাণ অর্জন করে ও লাভবান হয়। আমেরিকার বোস্টন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পিটার এল.বার্গার তার বই সেক্যুলারিজম ইন রিট্টিট এ লিখেছেন, সেক্যুলারিজম ও নব উদ্ভাবন, এর একটার সঙ্গে অপরটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে যে ধারনা প্রচলিত তা সঠিক নয় এবং তা এখন প্রমাণিত।
এটা ঠিক যে, ইউরোপীয়রা এখন বাহ্যত প্রাচুর্য্যময় জীবনযাপন করেন, কিন্তু তারা এটাও অস্বীকার করতে পারবে না যে, অন্য দেশ ও জাতির সম্পদ লুট ও সেখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাসহ দুই বৃহৎ যুদ্ধ অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধানোর পেছনে ই্উরোপীয় দেশগুলোই মূল ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে ইউরোপীয় দেশগুলো নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন এবং এসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্যই। এটম বোমা ও রাসায়নিক বোমার মতো গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার এবং অশ্লীলতা ও বেলাল্লাপনা ছড়িয়ে দিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো নানা ঘটনাই প্রমাণ করছে, পশ্চিমারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে কেবল নিজের স্বার্থেই ব্যবহার করছে।এ কারণে তারা ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে প্রত্যাখ্যান করছে।
লিবারেলিজম ও সেক্যুলারিজম কেবলি বস্তুবাদের ওপর গুরুত্ব দেয় এবং মুনাফা অর্জন ও চরমপন্থায় আনন্দ প্রাপ্তির সংস্কৃতিও ছড়িয়ে দেয় এই দুই মতবাদ। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের দৈহিক চাহিদার পাশাপাশি মানষিক চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন এবং মানুষের জীবনে উভয় বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে ইসলাম ধর্ম, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে মানবসেবার প্রতিশ্রুতির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় এবং মানুষের ইহকাল ও পরকাল এই উভয় জগতে কল্যাণ ও সুখ নিশ্চিত করার কথা বলে। কাজেই এটাই স্বাভাবিক যে, মুসলমানদের কাছে যেহেতু পরিপূর্ণ ধর্ম রয়েছে, ফলে তারা অপূর্ণ মতবাদের পেছনে দৌড়াবে না। এছাড়া, সেক্যুলারিজম, পাশ্চাত্য ও মুসলিম বিশ্বে গ্রহণযোগ্য কোন অর্জন বা অবদান তুলে ধরতে পারেনি।
পাশ্চাত্যের সরকারগুলো যারা নিজেদেরকে সেক্যুলারিজমের ধারক বলে মনে করে তারা আজ মহা সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এসব দেশে অশ্লীলতা ও ব্যভিচার ক্রমেই বাড়ছে। পারিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ছে, অন্যায় ও অপরাধ বাড়ছে এবং এলকোহল তথা মাদক দ্রব্যের প্রতি আসক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সেক্যুলারিজমে সব সময় মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার শ্লোগান দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে পাশ্চাত্যের দেশগুলো নিজেই কেবল মানবাধিকার লংঘন করছে না, তারা তাদের মিত্র দেশগুলোর মানবাধিকার লংঘনকেও উপেক্ষা করছে। পশ্চিমারা শুধুমাত্র তাদের নীতির বিরোধী সরকার ও দেশগুলোর মানবাধিকার লংঘনের বিষয়ে স্পর্শকাতর এবং এ বিষয়ে তারা প্রচার চালায়।
পাশ্চাত্যের সেক্যুলার সরকারগুলোর দৃষ্টিতে বিশ্বের কোন দেশে গণতান্ত্রিক নীতিমালা পালন করা হচ্ছে কী না, তা নির্ধারণ করা হয় পাশ্চাত্যের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে। মধ্যপ্রাচ্যে পাশ্চাত্যের ঘনিষ্ট এমন কয়েকটি দেশ আছে, যেখানে গণতন্ত্রের সর্বনিম্ন মাপকাঠিও মেনে চলা হচ্ছে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আর ইরানের মতো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশগুলোতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবার পরও তেহরানের সমালোচনা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে মার্কিন লেখিকা শিরিন হান্টার ইসলাম ও পাশ্চাত্যের ভবিষ্যত শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, পাশ্চাত্যের দেশগুলো মুসলিম দেশগুলোতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে আগ্রহী নয়, কারণ পাশ্চাত্য এ সিদ্ধান্তে পৌছেছে যে, এটা হলে অনেক দেশেই পাশ্চাত্যপন্থী সরকারগুলোর পতন ঘটবে অথবা অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে।
মুসলিম বিশ্বে কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর সেক্যুলারিজমের প্রতি ঝোক প্রবণতা, সব মুসলমানের চিন্তা-দর্শনের প্রতিফলন নয়। পিটার এল বার্গারও তার বইয়ে এ কথাই বলেছেন। বার্গারের মতে, বিভিন্ন দেশে সেক্যুলারিজমের প্রতি এই ঝোক প্রবণতা ওই সব ব্যক্তির মাঝেই বেশি লক্ষ্য করা যায়, যারা পাশ্চাত্যে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পাশ্চাত্যপন্থী যেসব বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ, ধর্ম ও সেক্যুলারিজমের মধ্যে সমন্বয় সাধনের যে চেষ্টা করেছিলেন, তারাও ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই ইমাম খোমেনী(রহ:) এর মতো বিশিষ্ট মুসলিম চিন্তাবিদদের পুর্বাভাস অনুযায়ী, মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের প্রভাব ভবিষ্যতে আরও হ্রাস পাবে।
=============================
চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব  ভালবাসা নিভিয়ে দেয় হিংসার আগুন  মহান মুক্তিযুদ্ধঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি  রহস্যের পর্দা সরিয়ে দ্যুতিময় এমিলি ডিকিনসন  বেগম রোকেয়াঃ নারী জাগরণের বিস্ময়কর প্রতিভা  শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট  বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা  বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড  মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না


লেখাটি রেডিও তেহরান এক সৌজন্যে

এই লিখা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.