আলোচনা- শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত by বকুল আশরাফ

পুলিশ লাঠিপেটা করছে একজন নারী শ্রমিককে। শ্রমিকরা রাস্তায় আন্দোলন করেছে সরকার ঘোষিত নির্ধারিত বেতন পরিশোধের দাবীতে। ভাঙ্গচুর করেছে কারখানার একাংশ এবং গাড়ী জ্বালিয়েছে বেশ কয়েকটি। নিহত হয়েছে তিন থেকে চার জন। এসবই এই বিজয়ের মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকের ঘটনা। বাংলাদেশে সব মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে এইসব ঘটনা। পত্রিকায় ছবি ছেপেছে ।
এতে অনেক সাধারণ মানুষের এক ধরনের নেগেটিভ ধারণা হয়েছে। কেউ শ্রমিকদের দোষ দিয়েছেন। কেউ মালিক পক্ষকে দোষারোপ করেছেন। আবার কেউ বলেছেন সরকার সফলতার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করে সামাল দিতে পেরেছে। এইসবই ভাবনার কথা। এর নেপথ্যের বাস্তবতা কিন্তু ভিন্নরূপের। এবং তা ঈর্ষণীয়ভাবে অহংকার করার দাবী রাখে ।
বাংলাদেশে প্রায় চার হাজারের মত তৈরী পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে। এবং সেই সব শিল্পের অঞ্চল ভিত্তিক মূল অবস্থান হচ্ছে ঢাকা ইপিজেড, সাভার, গাজীপুর, টঙ্গী, মিরপুর, মালিবাগ-রামপুরা, তেঁজগাও, মোহাম্মদপুর-শ্যামলী, ফতুলস্না, নারায়ণগঞ্জ ও রুপগঞ্জ। অপরদিকে চট্টগ্রামে ইপিজেড ও অন্যান্য শিল্পাঞ্চল। অথচ বর্ধিত বেতন কাঠামোর দাবীতে শ্রমিকরা যে সব অঞ্চলগুলোতে দাবী আদায়ের নামে আন্দোলনে নেমেছে সেগুলো হলো, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ইপিজেড, রূপনগরের একটি কারখানার শ্রমিক।
সাভারে ও গাজীপুর অঞ্চলে দু'একটি কারখানার শ্রমিক এবং তেজগাঁও কুড়িল এলাকায় দু'একটি কারখানার শ্রমিক। সব মিলিয়ে চলিস্নশ থেকে পঞ্চাশ হাজার শ্রমিক রাজপথে নেমে এসেছে। ধরা যাক এই সংখ্যা এক লক্ষ। তবে পঁচিশ-ছাবি্বশ লক্ষ শ্রমিকের মধ্যে শতকরা হারে দাঁড়ায় চার ভাগ শ্রমিক। অর্থাৎ বাকি ছিয়ানব্বই ভাগ শ্রমিক সঠিক হারে বর্ধিত বেতন কাঠামোতে বেতন পেয়েছেন ধরে নিতে পারি। আর যদি ধরেই নিতে হবে তবে মালিক পক্ষকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। কেননা মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে দুইটি ঈদ বোনাস তাদের দিতে হয়েছে এবং বর্ধিত বেতন কাঠামোতে (যা কোন কোন ভাগে শতকরা ৮৬ ভাগ থেকে ৭৫ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে) বেতন দিতে হয়েছে। ছোটখাট কোন অসন্তোষ থাকতেই পারে সেই ৯৬ শতাংশ শ্রমিকদের মধ্যে যা আলোচনা করে কেস টু কেস পর্যায়ে সমাধান করা সম্ভব। অথবা এতদিনে সমাধান হয়েও গেছে।
আর যে সব শ্রমিক পথে নেমে এসেছে সে সব শ্রমিক কিছু উলেস্নখযোগ্য নামকরা কারখানায় চাকরি করেন। যেমন ইয়াংওয়ান, নাসাগ্রুপ, রবিনটেক্স, গিভেন্সি গ্রুপ ইত্যাদি। এদের মূল দাবী ছিল নতুন বেতন কাঠামোর কারণে যে সব সুবিধাদি বাতিল করা হয়েছে তা পুনরায় চালু করা। পুরানো বা দক্ষ শ্রমিকদের বেতন তুলনামূলকভাবে নতুনদের বা অদক্ষদের চেয়ে কম বেড়েছে এর মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করা। দাবীগুলো কিন্তু যৌক্তিক দাবী। কেননা যদি কোন কারখানা শ্রমিকদেরকে আইন বহির্ভূত কোন সুবিধা বা ভাতা দিয়ে থাকে তা কোনভাবেই কমাতে বা তা হ্রাস করতে পারবে না। ২০০৬ সালে ঘোষিত শ্রমিকদের বেতন কাঠামো বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় খুবই অপ্রতুল হওয়ায় অনেক কারখানার কতর্ৃপক্ষ বিভিন্ন সুবিধাদি বা ভাতা প্রদান করে আসছিলেন। তাদের এই মানবিক গুণাবলি আজ তাদেরই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্যই তা মালিক পক্ষের বা ব্যবস্থাপনা পক্ষের অদূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। তারা হয় অতি উৎসাহী ছিলেন বা অন্যদের তুলনায় নিজেকে এগিয়ে রাখছিলেন । আমার ধারণা এই দাবীটি মেনে নিয়েই কর্তৃপক্ষ আবার কারখানা চালু করেছেন। দক্ষ শ্রমিকদের বা পুরানো শ্রমিকদের বেতন কেন কম এই দাবীটির পেছনেও যথোপযুক্ত যুক্তি রয়েছে। কেননা সরকার যেভাবে পাঁচটি ধাপে শ্রমিকদের বেতন কাঠামো বিন্যস্ত করছেন তা হলো ৭ম গ্রেডের শ্রমিকরা পাবেন ১৬৬২ টাকার পরিবর্তে ৩০০০ টাকা, যা প্রায় ৮১ ভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৬ষ্ঠ গ্রেডের শ্রমিকরা পাবেন ১৮৫১ এর পরিবর্তে ৩৩২২ টাকা, যা ৮০ ভাগ বেশী , পঞ্চম গ্রেডে বৃদ্ধি পেয়েছে ২০৪৬ টাকা থেকে ৩৫৫৩ টাকা, যা ৭৪ ভাগ বেশী , চতুর্থ গ্রেডে বৃদ্ধি করা হয়েছে ২২৫০ থেকে ৩৮৬১ টাকা, যা ৭২ ভাগ বেশী এবং সর্বোচ্চ গ্রেড তৃতীয় গ্রেডে বৃদ্ধি করা হয়েছে ২৪৪৯ থেকে ৪২১৮ টাকায় অর্থাৎ ৭২ ভাগ বেশী। কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে তৈরী পোশাক কারখানাগুলোতে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের অনুপাত হচ্ছে ৭৭ এবং ২৩ অর্থাৎ দক্ষ বা কাজ জানা শ্রমিকের আধিক্য বেশী। এই ৭৭ ভাগ শ্রমিককেই সরকার ঘোষিত নিয়ম অনুযায়ী বেতন দেয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের কাজের পারদর্শিতা বা অভিজ্ঞতা বা কাজে যোগদানের বয়স বিবেচনায় আনা হয় নাই বলেই শ্রমিকরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বা বিক্ষোভ করেছে। ২৪৪৯ টাকায় গত দুই বছর যাবৎ কখনোই কোন দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায়নি। যদিও ২০০৬ সালের ঘোষিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিকের নূ্যনতম বেতন হওয়া উচিত ছিল ২৪৪৯ টাকা। কিন্তু বাজার মূল্যের সাথে তাল রেখে আমার জানামতে প্রায় সবগুলো কারখানাতেই দক্ষ শ্রমিকদের নিয়োগ হতো ৩০০০ টাকা থেকে প্রায় ৪৫০০ টাকা পর্যন্ত। যা সবগুলো কারখানাই নিজস্ব পর্যালোচনা, মানবিক বিবেচনায়, শ্রমিকদের চাহিদানুযায়ী বা শ্রমিকস্বল্পতার কারণে নিয়োগ শুরু করেছে ৩০০০ থেকে ৪০০০ পর্যন্ত কেউ কেউ ৪৫০০ পর্যন্ত মজুির দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নূ্যনতম বেতন কাঠামোতে বলা আছে ৪২১৮ টাকা হচ্ছে একজন দক্ষ বা তৃতীয় গ্রেডের শ্রমিকের নির্ধারিত নূ্যনতম মজুির।
এখানে যে ঘটনাটা হয়েছে তা হলো কেউ কেউ ৩০০০ থেকে ৪০০০ পর্যন্ত সকলেই ৪২১৮ টাকায় ফিক্সড করে দিয়েছেন। এখানেই হয়েছে যত গন্ডোগোল বা কেউ কেউ দ'ুতিন ধাপে ফিক্সড করেছেন। ধরা যাক ৩০০০ থেকে ৩৪০০ টাকা পর্যন্ত করা হয়েছে ৪২১৮ টাকা, ৩৫০০ থেকে ৩৯০০ কে করা হয়েছে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৪২৬৮ টাকা। আবার ৩৯০০ থেকে বেশী যারা পেতেন তাদের করা হয়েছে ৪৩১৮ টাকা। আমি পূর্বে উলেস্নখ করেছি যে, দক্ষ বা কাজ জানা শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ শ্রমনিবিড় কারখানার প্রায় তিন-চতুথর্াংশ হচ্ছে দক্ষ বা কাজ জানা শ্রমিক। সুতরাং কাজ জানাটাই হচ্ছে সে শ্রমিকের গর্বের কারণ বা কয়েক বৎসর যাবৎ অর্জিত অভিজ্ঞতাই হচ্ছে তাঁর গর্বের কারণ। সেক্ষেত্রে প্রতিটি ধাপের বা ভাগের শ্রমিকদের বেতন গড়পড়তায় মিলিয়ে ফেলা সঠিক হয়নি। একজন শ্রমিকের সাথে দক্ষতা বা অভিজ্ঞতার কারণে অন্য এক শ্রমিকের যেরূপ পার্থক্য ছিল তা সঠিকভাবে নতুন প্রদেয় কাঠামোতে প্রতিফলিত করতে পারেনি কারখানার কর্তৃপক্ষ বা মালিকপক্ষ। তাই এই অসন্তোষ বা বিক্ষোভ। সুতারং পুন:পর্যালোচনা করে তা অবশ্যই করতে হবে ।
বিক্ষোভ যেন ভাংচুর বা জ্বালাও-পোড়াও না হয় সেদিকে অবশ্যই শ্রমিকদের খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি সরকার শিল্পপুলিশ বা আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তা খেয়াল রাখতে হবে। সর্বোপরি যে কোন সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে হওয়া উচিত। এবং এই আলোচনা বা দর কষাকষির জন্য অবশ্যই প্রতিটি কারখানার শ্রমিক কল্যাণ কমিটি বা শ্রমিকদের অংশগ্রহণসহ কমিটি থাকা অতি প্রয়োজন। ২০০৬ সালের পোশাক তৈরী শিল্পের রপ্তানি আয় বেড়ে বর্তমানে প্রায় দ্বিগুণ । যা উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাবে আগামীতে । সুতরাং কারখানা পরিচালনার জন্য যেমন দক্ষ শ্রমিক দরকার তেমনি দরকার ব্যবস্থাপনা পরিষদ বা দক্ষ ব্যবস্থাপক ।
=========================
জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব  ভালবাসা নিভিয়ে দেয় হিংসার আগুন  মহান মুক্তিযুদ্ধঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি  রহস্যের পর্দা সরিয়ে দ্যুতিময় এমিলি ডিকিনসন  বেগম রোকেয়াঃ নারী জাগরণের বিস্ময়কর প্রতিভা  শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট  বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা  বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড  মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ বকুল আশরাফ


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.