বাংলাদেশের উন্নয়ন-বিভ্রাট by হানিফ মাহমুদ
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে। গেল কয়েকটি বছর আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বড় ধরনের মন্দা থাকলেও বাংলাদেশ বড় ধরনের কোনো আঘাতের সম্মুখীন হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে রিজার্ভ আছে তা হয়তো দেশের এই মুহূর্তের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার চেয়ে কিছুটা বেশি। বাংলাদেশ গত এক দশকে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে চলনসই ও মধ্যবিত্তরা একটু চাপে আছে। তবে আন্তর্জাতিক বিচারে এ চাপ খুব বেশি নয়। সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু আর্থিক প্রসার আর উন্নয়ন এক জিনিস নয়, যদিও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন-প্রক্রিয়ারই একটি দিক।
শুধু সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীল অবস্থা ও প্রবৃদ্ধির হার সমাজের বিপুল অংশের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটায় না। এখনও জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের প্রয়োজনীয় খাদ্য নেই, স্বাস্থ্য-পরিষেবা নেই, ভালো আবাসন নেই, কর্মসংস্থান নেই, শিক্ষা নেই। অনেকেই এ কথা মানতে নারাজ যে, বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত মৌলিক সুযোগ-সুবিধা পরিবীক্ষণ জরিপে এ চিত্রই উঠে এসেছে। জনগোষ্ঠীর ৪১ শতাংশের বেশি, অর্থাৎ বাংলাদেশের ১৬ কোটির মানুষের মধ্যে ৬ কোটি এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে। ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো অক্ষরজ্ঞানহীন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ খাদ্যঝুঁকিতে থাকে। খাদ্যঝুঁকির শিকার মানুষদের অধিকাংশই দীর্ঘমেয়াদি সংকটে আছে। সরকারি জরিপে খাদ্যসংকটে আক্রান্ত পরিবারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাদের এই করুণ অবস্থার কারণ কী। বেশির ভাগ পরিবার বলেছে দুটি প্রধান কারণের কথা: আয় অপর্যাপ্ত এবং চাষবাসের জমির সংকট।
স্বাধীন বাংলাদেশের এতগুলো বছরে কতগুলো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হলো, দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কত কথাই তো সরকার বছর বছর প্রচার করে যাচ্ছে। তার পরও জীবনের ন্যূনতম উপকরণ-বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা কমছে না।
দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত একটি জেলা কুড়িগ্রামের উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। দারিদ্র্য ও অসচেতনতার মধ্যে কুড়িগ্রামের চরে হাজার হাজার পরিবার আধপেটা খেয়ে অপুষ্টির সঙ্গে লড়াই করছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সরকার ও অর্ধশতাধিক এনজিও বিপুল অর্থ ব্যয় করে এদের আর্থিক অবস্থা উন্নতির চেষ্টা করেছে। কিন্তু দৃশ্যত তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। কাজের সন্ধানে এখনো হাজার হাজার মানুষ কুড়িগ্রাম ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। এখানে উপার্জন এতই কম যে, ক্ষুধা নিবারণ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাসস্থান জোটাতে বাড়তি অর্থ থাকে না। ফলে বাধ্য হয়ে নিজ এলাকা ছেড়ে কেউ বা থাকছে মাসের পর মাস, আবার অনেকে থাকছে সপ্তাহ বা ১৫ দিন।
কুড়িগ্রামে গত এক দশকে দারিদ্র্যের হার কমাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে এলাকাটি ঘুরে দেখা গেছে, প্রকল্পগুলোতে সবকিছু ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রবল। প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার কোনো সামর্থ্য দেখা যায় না। প্রকল্পগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে এসব প্রকল্পে যে সেবা ও সম্পদের লেনদেন হয় তা প্রকৃত দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারের কাছে যায় না।
কুড়িগ্রামের সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক এনামুল হক চৌধুরীর অভিমত, কুড়িগ্রাম জেলায় গত এক দশকে যে পরিমাণ অর্থ এসেছে, তা মুদ্রা (কয়েন) করে ছেড়ে দিলে কুড়িগ্রাম জেলা তিন ফুট উঁচু হয়ে যেত। কিন্তু এখানে টেকসই কোনো উন্নয়ন হয়নি। রাস্তা মেরামত ও বাঁধ রক্ষার কাজ হয়। কিছুদিন পরই এসব কাজের আর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর মত, কুড়িগ্রামে যেসব প্রকল্প আসছে, সেগুলো যারা নাড়াচাড়া করছে তাদের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু হতদরিদ্র মানুষ সেই তিমিরেই পড়ে থাকছে।
অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান তাঁর প্রবন্ধ সংকলন আমার সমালোচক আমার বন্ধু গ্রন্থের এক জায়গায় বলছেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সমস্যা যতটা-না সম্পদের অভাবের কারণে, তার চেয়ে বেশি পরিচালনা-পদ্ধতির দুর্বলতার কারণে, আর পরিচালনা-পদ্ধতির সংকট নিহিত রয়েছে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে এমন দিকনির্দেশনাপূর্ণ একটি ভিশনের অভাবের মধ্যে।’
আলাপকালে স্থানীয় অনেকেই অভিমত দিয়েছেন, এ ধরনের কর্মসূচিভিত্তিক প্রকল্প দিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার উন্নয়ন হবে না। ওই অঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে পরিবর্তন আনতে হলে মানুষের আয়বর্ধক ভৌত অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু এ রকম দুটি সেচ প্রকল্পের কাজ শুরু হচ্ছে না পাঁচ বছর ধরে। অনুমোদন থেকে শুরু করে টাকা বরাদ্দ রাখা—সবকিছুই হয়েছে। শুধু কাজের অগ্রগতি শূন্যের কোটায়। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জেলার ৭৫ হাজার হেক্টর এলাকা সেচের আওতায় আসবে। ধান, গম, শাক-সবজি ও মাছের উৎপাদন বাড়বে। নিয়মিত কর্মসংস্থান হবে লক্ষাধিক লোকের। দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এ ধরনের ভৌত অবকাঠামোর প্রকল্প অনুমোদনের পাঁচ বছর পরও নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি। শুধু এটিই একমাত্র উদাহরণ নয়। মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও দারিদ্র্য নিরসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এ রকম শত প্রকল্প আছে, যেগুলোর সরকারি অনুমোদন হয়েছে, অর্থ বরাদ্দ আছে, কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি নেই।
২০১০-১১ অর্থবছরের যে মধ্যমেয়াদি বাজেটকাঠামোর সরকারি দলিল তৈরি হয়েছে, সেখানেও এই দুরবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, দারিদ্র্য নিরসনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো খাতে (স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, পরিবহন ও যোগাযোগ) বিনিয়োগ ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এটা ২ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। কারণ হিসেবে সরকারি দলিলেই বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ও পানি উন্নয়নের মতো ভৌত অবকাঠামো খাতে গৃহীত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন পুরোদমে শুরু না হওয়ার কারণেই ব্যয় হ্রাসের এ ঘটনা ঘটেছে। আরও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে খরচ ক্রমান্বয়ে কমছে।
রেলের মতো একটি মৌলিক খাতকে আমরা পঙ্গু করে রেখেছি দীর্ঘদিন। নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। ব্যবস্থাপনায় কোনো উন্নতি হচ্ছে না। কাগজে-কলমে রেলওয়েতে বর্তমানে ৩৪টি প্রকল্প চালু রয়েছে। কিন্তু রেলওয়ের সেবা সম্প্রসারণ ও যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর জন্য নেওয়া এসব প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের দূরদৃষ্টির অভাবে পাটের মতো সম্ভাবনাময় খাতকে অনেকটাই বিদায় করার উদ্যোগ নেওয়া হয় নব্বইয়ের দশকে। অথচ সরকারি মিলের ৫০ বছরের পুরোনো যন্ত্রপাতি কিনে উত্তরবঙ্গের উদ্যোক্তারা স্থাপন করেছেন ছোট ছোট পাটকল। আর এভাবেই বদলাতে শুরু করেছে উত্তরবঙ্গের পাটচাষির ভাগ্য। ২০০১ সালে উত্তরবঙ্গের মাত্র দুটি কারখানায় সারা বছর পাট ব্যবহূত হতো দুই থেকে আড়াই হাজার বেল। আর এখন ব্যবহূত হয় আড়াই লাখ বেল। গড়ে উঠেছে ২০টির বেশি পাটকল। এবার পাটের মূল্য যে অবস্থায় গিয়েছে, শুধু পাট চাষ করেই অনেক কৃষক পরিবার দরিদ্র অবস্থা থেকে উঠে আসতে পারবে। কিন্তু প্রবৃদ্ধিভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশ অনেক মৌলিক জায়গা থেকে ছিটকে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, শুধু প্রবৃদ্ধি দিয়েই উন্নয়ন বা দারিদ্র্য বিমোচন হয় না। দারিদ্র্য নিরসন করতে হলে প্রান্তিক মানুষের স্বত্বাধিকার ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জনসাধারণের সক্ষমতার বিকাশেই উন্নয়ন। সেটি করতে গেলে দারিদ্র্য বিমোচনের কিছু কর্মসূচি এবং রাস্তা মেরামতের কাজ দিয়ে হবে না। কর্মক্ষম জনগণের বেশির ভাগকে প্রয়োজনীয় মজুরি দেওয়া যায় এমন কাজের সংস্থান করতে হবে, যে মজুরি বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে। প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো, উন্নত যোগযোগ ব্যবস্থা, সবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, দেশীয় শিল্পের বিকাশ এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই জনসাধারণের সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে পারে।
হানিফ মাহমুদ: সাংবাদিক।
শুধু সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীল অবস্থা ও প্রবৃদ্ধির হার সমাজের বিপুল অংশের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটায় না। এখনও জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের প্রয়োজনীয় খাদ্য নেই, স্বাস্থ্য-পরিষেবা নেই, ভালো আবাসন নেই, কর্মসংস্থান নেই, শিক্ষা নেই। অনেকেই এ কথা মানতে নারাজ যে, বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত মৌলিক সুযোগ-সুবিধা পরিবীক্ষণ জরিপে এ চিত্রই উঠে এসেছে। জনগোষ্ঠীর ৪১ শতাংশের বেশি, অর্থাৎ বাংলাদেশের ১৬ কোটির মানুষের মধ্যে ৬ কোটি এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে। ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো অক্ষরজ্ঞানহীন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ খাদ্যঝুঁকিতে থাকে। খাদ্যঝুঁকির শিকার মানুষদের অধিকাংশই দীর্ঘমেয়াদি সংকটে আছে। সরকারি জরিপে খাদ্যসংকটে আক্রান্ত পরিবারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাদের এই করুণ অবস্থার কারণ কী। বেশির ভাগ পরিবার বলেছে দুটি প্রধান কারণের কথা: আয় অপর্যাপ্ত এবং চাষবাসের জমির সংকট।
স্বাধীন বাংলাদেশের এতগুলো বছরে কতগুলো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হলো, দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কত কথাই তো সরকার বছর বছর প্রচার করে যাচ্ছে। তার পরও জীবনের ন্যূনতম উপকরণ-বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা কমছে না।
দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত একটি জেলা কুড়িগ্রামের উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। দারিদ্র্য ও অসচেতনতার মধ্যে কুড়িগ্রামের চরে হাজার হাজার পরিবার আধপেটা খেয়ে অপুষ্টির সঙ্গে লড়াই করছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সরকার ও অর্ধশতাধিক এনজিও বিপুল অর্থ ব্যয় করে এদের আর্থিক অবস্থা উন্নতির চেষ্টা করেছে। কিন্তু দৃশ্যত তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। কাজের সন্ধানে এখনো হাজার হাজার মানুষ কুড়িগ্রাম ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। এখানে উপার্জন এতই কম যে, ক্ষুধা নিবারণ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাসস্থান জোটাতে বাড়তি অর্থ থাকে না। ফলে বাধ্য হয়ে নিজ এলাকা ছেড়ে কেউ বা থাকছে মাসের পর মাস, আবার অনেকে থাকছে সপ্তাহ বা ১৫ দিন।
কুড়িগ্রামে গত এক দশকে দারিদ্র্যের হার কমাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে এলাকাটি ঘুরে দেখা গেছে, প্রকল্পগুলোতে সবকিছু ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রবল। প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার কোনো সামর্থ্য দেখা যায় না। প্রকল্পগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে এসব প্রকল্পে যে সেবা ও সম্পদের লেনদেন হয় তা প্রকৃত দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারের কাছে যায় না।
কুড়িগ্রামের সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক এনামুল হক চৌধুরীর অভিমত, কুড়িগ্রাম জেলায় গত এক দশকে যে পরিমাণ অর্থ এসেছে, তা মুদ্রা (কয়েন) করে ছেড়ে দিলে কুড়িগ্রাম জেলা তিন ফুট উঁচু হয়ে যেত। কিন্তু এখানে টেকসই কোনো উন্নয়ন হয়নি। রাস্তা মেরামত ও বাঁধ রক্ষার কাজ হয়। কিছুদিন পরই এসব কাজের আর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর মত, কুড়িগ্রামে যেসব প্রকল্প আসছে, সেগুলো যারা নাড়াচাড়া করছে তাদের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু হতদরিদ্র মানুষ সেই তিমিরেই পড়ে থাকছে।
অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান তাঁর প্রবন্ধ সংকলন আমার সমালোচক আমার বন্ধু গ্রন্থের এক জায়গায় বলছেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সমস্যা যতটা-না সম্পদের অভাবের কারণে, তার চেয়ে বেশি পরিচালনা-পদ্ধতির দুর্বলতার কারণে, আর পরিচালনা-পদ্ধতির সংকট নিহিত রয়েছে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে এমন দিকনির্দেশনাপূর্ণ একটি ভিশনের অভাবের মধ্যে।’
আলাপকালে স্থানীয় অনেকেই অভিমত দিয়েছেন, এ ধরনের কর্মসূচিভিত্তিক প্রকল্প দিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার উন্নয়ন হবে না। ওই অঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে পরিবর্তন আনতে হলে মানুষের আয়বর্ধক ভৌত অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু এ রকম দুটি সেচ প্রকল্পের কাজ শুরু হচ্ছে না পাঁচ বছর ধরে। অনুমোদন থেকে শুরু করে টাকা বরাদ্দ রাখা—সবকিছুই হয়েছে। শুধু কাজের অগ্রগতি শূন্যের কোটায়। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জেলার ৭৫ হাজার হেক্টর এলাকা সেচের আওতায় আসবে। ধান, গম, শাক-সবজি ও মাছের উৎপাদন বাড়বে। নিয়মিত কর্মসংস্থান হবে লক্ষাধিক লোকের। দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এ ধরনের ভৌত অবকাঠামোর প্রকল্প অনুমোদনের পাঁচ বছর পরও নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি। শুধু এটিই একমাত্র উদাহরণ নয়। মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও দারিদ্র্য নিরসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এ রকম শত প্রকল্প আছে, যেগুলোর সরকারি অনুমোদন হয়েছে, অর্থ বরাদ্দ আছে, কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি নেই।
২০১০-১১ অর্থবছরের যে মধ্যমেয়াদি বাজেটকাঠামোর সরকারি দলিল তৈরি হয়েছে, সেখানেও এই দুরবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, দারিদ্র্য নিরসনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো খাতে (স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, পরিবহন ও যোগাযোগ) বিনিয়োগ ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এটা ২ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। কারণ হিসেবে সরকারি দলিলেই বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ও পানি উন্নয়নের মতো ভৌত অবকাঠামো খাতে গৃহীত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন পুরোদমে শুরু না হওয়ার কারণেই ব্যয় হ্রাসের এ ঘটনা ঘটেছে। আরও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে খরচ ক্রমান্বয়ে কমছে।
রেলের মতো একটি মৌলিক খাতকে আমরা পঙ্গু করে রেখেছি দীর্ঘদিন। নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। ব্যবস্থাপনায় কোনো উন্নতি হচ্ছে না। কাগজে-কলমে রেলওয়েতে বর্তমানে ৩৪টি প্রকল্প চালু রয়েছে। কিন্তু রেলওয়ের সেবা সম্প্রসারণ ও যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর জন্য নেওয়া এসব প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের দূরদৃষ্টির অভাবে পাটের মতো সম্ভাবনাময় খাতকে অনেকটাই বিদায় করার উদ্যোগ নেওয়া হয় নব্বইয়ের দশকে। অথচ সরকারি মিলের ৫০ বছরের পুরোনো যন্ত্রপাতি কিনে উত্তরবঙ্গের উদ্যোক্তারা স্থাপন করেছেন ছোট ছোট পাটকল। আর এভাবেই বদলাতে শুরু করেছে উত্তরবঙ্গের পাটচাষির ভাগ্য। ২০০১ সালে উত্তরবঙ্গের মাত্র দুটি কারখানায় সারা বছর পাট ব্যবহূত হতো দুই থেকে আড়াই হাজার বেল। আর এখন ব্যবহূত হয় আড়াই লাখ বেল। গড়ে উঠেছে ২০টির বেশি পাটকল। এবার পাটের মূল্য যে অবস্থায় গিয়েছে, শুধু পাট চাষ করেই অনেক কৃষক পরিবার দরিদ্র অবস্থা থেকে উঠে আসতে পারবে। কিন্তু প্রবৃদ্ধিভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশ অনেক মৌলিক জায়গা থেকে ছিটকে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, শুধু প্রবৃদ্ধি দিয়েই উন্নয়ন বা দারিদ্র্য বিমোচন হয় না। দারিদ্র্য নিরসন করতে হলে প্রান্তিক মানুষের স্বত্বাধিকার ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জনসাধারণের সক্ষমতার বিকাশেই উন্নয়ন। সেটি করতে গেলে দারিদ্র্য বিমোচনের কিছু কর্মসূচি এবং রাস্তা মেরামতের কাজ দিয়ে হবে না। কর্মক্ষম জনগণের বেশির ভাগকে প্রয়োজনীয় মজুরি দেওয়া যায় এমন কাজের সংস্থান করতে হবে, যে মজুরি বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে। প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো, উন্নত যোগযোগ ব্যবস্থা, সবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, দেশীয় শিল্পের বিকাশ এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই জনসাধারণের সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে পারে।
হানিফ মাহমুদ: সাংবাদিক।
No comments