প্রহরাবেষ্টিত ‘নিরাপদ’ ক্যাম্পাস by মশিউল আলম
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুব পাশে বিনোদপুর বাজারে আমের মৌসুমে আম আর বছরের অন্য সময় সবজির ব্যবসা করেন আতোয়ার রহমান (২৭)। পত্রপত্রিকা ও লোকমুখে জেনেছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের যে জনপদগুলোতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা সুসংগঠিতভাবে অবস্থান করেন, বিনোদপুর সেগুলোর অন্যতম। বিনোদপুরে শতাধিক বাড়ি আছে, যেগুলো ব্যবহূত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেস হিসেবে। সেসব মেসের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের ঘাঁটি আছে—এই ধারণা থেকে তেমন একটি ‘ঘাঁটি’ দেখতে গিয়েছিলাম গত বুধবার। সহযোগিতা চাইলাম আতোয়ার রহমানের, যাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিনোদপুরেই। কিন্তু তিনি তেমন কোনো মেসের সন্ধান দিতে পারলেন না। বললেন, মেসগুলোর শিক্ষার্থীরা কে কোন সংগঠন করে, এলাকার সাধারণ মানুষ তা জানে না। রাজনীতি আছে, তিনি বললেন, বিনোদপুরে সমর্থক বেশি বিএনপির; জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী ছাত্রশিবিরও সামান্য কিছু আছে, তবে তারা কাজ করে গোপনে। সাধারণ মানুষ তাদের তৎপরতা টের পায় না। ইসমাইল নামের এক দোকানি বললেন, শিবিরের ছেলেরা গা ঢাকা দিয়েছে। যেসব মেসে তারা ছিল, সেগুলোর কেয়ারটেকাররা তাদের কাছ থেকে ঘরের চাবি নিয়ে চলে যেতে বলেছে, কারণ পুলিশের লোকেরা হঠাৎ হঠাৎ মেসে ‘রেড দেয়’, মানে তল্লাশি করে।
বিনোদপুর গেট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢোকার মুখে তিন তরুণী শিক্ষার্থীকে বেরিয়ে আসতে দেখে তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম, কেমন চলছে বিশ্ববিদ্যালয়। একজন বললেন, ভালো। কোনো সমস্যা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘সমস্যা কিসের।’
‘চাপা অস্বস্তি অথবা ভয়, বা অন্ততপক্ষে অনিশ্চয়তা যে কখন আবার কী হয়—এ রকম অনুভব করেন কি?’ আমার এ প্রশ্নের উত্তরে পাশের তরুণী বললেন, কিছু ঘটলে আগে থেকে আভাস পাওয়া যায়। এবং নিশ্চিন্ত সুরে জানালেন, এখন সে রকম কোনো আভাস নেই।
গেটের ভেতরে গাছতলায় কয়েকটি বেঞ্চে বসে গল্প করছিলেন ‘আরএমপি’ লেখা স্টিকার লাগানো পোশাক-পরা রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের আটজন সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে একসঙ্গে কথা বলে উঠলেন তিনজন: ‘ভার্সিটি ঠিক আছে, কোনো গন্ডগোল নাই; কিন্তু আপনারা আমাদের কথা লেখেন না কেন? আমরা সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এখানে ডিউটি করি, পানি পর্যন্ত খাওয়ার ব্যবস্থা নাই’। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই, ইত্যাদি বলে তাঁরা নিজেদের দুঃখ-দুর্দশা প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে উঠলে তাড়াতাড়ি তাঁদের সালাম জানিয়ে ফিরে এলাম গেটে, আমার জন্য অপেক্ষমাণ রিকশাচালক ৭১ বছর বয়সী আশরাফ আলীর কাছে। আগেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আড়াআড়ি পার করিয়ে পুবের বিনোদপুর থেকে নিয়ে যাবেন পশ্চিমের মেহেরচন্ডি নামের পাড়ায়। সেখানেও প্রচুরসংখ্যক বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মেস। যেতে যেতে আশরাফ আলী জানালেন, তাঁর জন্ম বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন তালাইমারী মহল্লায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ভবন নির্মাণের কাজে তিনি রাজমিস্ত্রিদের জোগালির কাজ করেছেন। তাঁর মতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো দিনগুলো ছিল শহীদ ড. শামসুজ্জোহার সময়। তখন ছাত্ররা ভদ্র ছিল, শিক্ষকদের কথা শুনত, ভালোভাবে লেখাপড়া করত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমে রেলস্টেশনের গেটে আবারও দেখি অস্ত্রধারী পুলিশ। জিজ্ঞেস করলাম, নিরাপত্তার কোনো সমস্যা আছে কি না। তাঁরা মাথা নেড়ে বললেন, কোনো সমস্যা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি গেটে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা দুই শিফটে পালা করে পাহারা দিচ্ছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্যরা, প্রত্যেক শিফটে আটজন করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসের ভেতরে বোমা-ককটেল ফুটছে, শিবিরের ঝটিকা মিছিল বেরোচ্ছে—এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলেন না তাঁরা। শুধু বললেন, গেট ছাড়াও ক্যাম্পাসে ঢোকার অনেক পথ আছে।
আশরাফ আলী আমাকে নিয়ে গেলেন রেললাইনের পশ্চিম পাশের মেহেরচন্ডি উত্তরপাড়ায়। রিকশায় যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশের বাড়িগুলো দেখিয়ে বললেন, এগুলো সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেস। চারতলা একটি বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। রোজি ছাত্রাবাস। চারটি তলা মিলে ঘর আছে ৭০টি। ৭০ জন শিক্ষার্থী সেসব ঘরে ভাড়া থাকেন। মাসিক ভাড়া ঘরের আকারভেদে সাড়ে ৫০০ টাকা থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা। বাড়িটির নিচতলায় ছোট্ট একটি দোকান, বাড়ির মালিকের এক আত্মীয় সেটি চালাচ্ছেন। তিনি জানালেন, এই মেসের কোনো শিক্ষার্থী কোনো ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়, ঘর ভাড়া দেওয়ার সময় তাদের কাছে এই মর্মে অঙ্গীকারনামায় সই করিয়ে নেওয়া হয়। এ পাড়ায় মেসবাড়ি আছে ৬০-৭০টি। ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা কোন কোন মেসে থাকেন—এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কিন্তু এখানকার বাসিন্দা নয় এমন কেউ এ পাড়ায় বিয়েশাদি করেছেন কি না জানতে চাইলে একজন বললেন, এ রকম বিয়ে হয়েছে ৭০-৮০টি। আরেকজন তাঁর প্রতিবাদ করে বললেন, সংখ্যাটি অত বেশি হবে না, ৩০-৪০ হতে পারে। কিন্তু আগেরজন তাঁর বক্তব্যে অটল রইলেন এবং জানালেন, এ পাড়ার মেসগুলোতে পুলিশ মাঝেমধ্যে তল্লাশি চালাতে আসে। বলাবাহুল্য, জামায়াত-শিবিরের সন্ধানে।
ক্যাম্পাসের ভেতরেও জামায়াত-শিবিরের জন্য ফাঁদ পাতা আছে। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল ইসলাম অপু বললেন, তাঁরা রাত জেগে পাহারা দেন, তার মধ্যেও শিবিরের ছেলেরা হঠাৎ হঠাৎ ঝটিকা মিছিল বের করে, বোমা-ককটেল ফাটিয়ে পালিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন এমন চার যুবকের দেখা পাওয়া গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের পাশের রাস্তায়। তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিলেন জাতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোক বলে। তাঁরা জানালেন, ক্যাম্পাস এখন শান্ত, মোটের ওপর নিরাপদ, তবে অনিশ্চয়তা পুরোপুরি কাটেনি, কারণ দুষ্কৃতকারীরা সব সময়ই ওত পেতে আছে বিশৃঙ্খলা ঘটানোর জন্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহযোগী অধ্যাপক বললেন, ক্যাম্পাসে একটা নীরব ত্রাসের অনুভূতি নিরবচ্ছিন্নভাবে বিরাজমান আছে। মাদারবক্স আবাসিক হলের গেটে চার তরুণ শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁরা কোনো ভীতি বা অনিশ্চয়তা বোধ করেন কি না। একজন বললেন, অনিশ্চয়তা আছে, কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা মারামারি করবে না তো কি প্রাইমারি স্কুলের ছেলেরা মারামারি করবে?’
শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে আমগাছের নিচে চা-বিস্কুটের একটি দোকান (সুমনের দোকান) ঘিরে তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। গিটার বাজিয়ে গান গাইছেন কয়েকজন, একটি বেঞ্চে দাবা খেলতে বসেছেন দুজন, তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছেন আরও কয়েকজন। কিছুক্ষণ পর এক তরুণী এসে দুই দাবাড়ুর একজনের সঙ্গে শুরু করলেন খুনসুটি এবং সেটা গড়াল এমন পর্যায়ে যে তিনি দাবার ঘুুঁটিগুলো এলোমেলো করে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলেন। পাশের দুটি বেঞ্চে মুখোমুখি বসে চা খাচ্ছেন আর গল্পগুজব করছেন আট-দশজন তরুণ। তাঁদের বক্তব্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলো ইসলামী ছাত্রশিবিরের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয়েছে। তাঁরা সবাই ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিন্দা করলেন এবং শিবিরের আধিপত্য ও স্বেচ্ছাচারিতা কী ভয়ংকর মাত্রায় বেড়ে উঠেছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীরাও তাঁদের দ্বারা কীভাবে নিগৃহীত হতেন, সেসব বিবরণ তাঁরা দিতে লাগলেন। যেমন, একজন বললেন, এই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা প্রত্যেকটি আবাসিক হলে রাজত্ব করতেন। কোনো হলে নতুন কোনো ছাত্র এলে তাঁকে আলটিমেটাম পাঠানো হতো, রুমে ওঠার এক ঘণ্টার মধ্যে ওই হল শাখার শিবির সভাপতির কাছে গিয়ে দেখা করতে হবে। শিবির সভাপতি তাঁকে বলবেন, আমরা যেভাবে বলব, সেভাবে তোমাকে চলতে হবে, না-হলে হলে থাকতে পারবে না। শিবিরের নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা উপলক্ষে চাঁদা আদায় করতেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারির সহিংসতা ও ফারুক হত্যাকাণ্ডের পর শিবিরের সেই একচ্ছত্র আধিপত্য ও দাপটের অবসান হয়েছে। তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখন তৎপর ছাত্রসংগঠন বলতে আছে শুধু বাংলাদেশ ছাত্রলীগ; আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তারাও ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলোর দেখভালের দায়িত্ব পালন করছে। ছাত্রশিবির বিতাড়িত, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অস্তিত্বহীন। এমন অবস্থায় ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্ব স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা বিচিত্র নয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা যে জবরদস্তিমূলক আচরণ করতেন, এখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেই ভূমিকা নিয়েছেন কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য কাউকে ‘হ্যাঁ’ বলতে শোনা গেল না। শুধু একজন শিক্ষক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বললেন, ক্ষমতা ও দাপটের হাতবদল হয়েছে; ছাত্রলীগ পেয়েছে ছাত্রশিবিরের জায়গা। এবং ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের নামে বোমাবাজিসহ যেসব নেতিবাচক ঘটনা ঘটছে সেগুলো যে ছাত্রশিবিরই করছে, এমন নয়। ছাত্রলীগের মধ্যে কোন্দল আছে, আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের মধ্যেই অন্তত চারজন অধ্যাপক আছেন যাঁরা নিজেদেরকে উপাচার্যের চেয়ারে দেখতে চান। ওদিকে আছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র, যিনি আওয়ামী লীগের একজন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তিনিও দেখতে চান তাঁর পছন্দের কোনো অধ্যাপককে।
স্বল্প সময়ে সামান্য দেখেশুনে যা মনে হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রবেশ করেছে, যেখানে সাধারণ অর্থে নিরাপত্তার সংকট নেই, যেখানে ছাত্রশিবিরও আর কোনো বড় সমস্যা নয়। অদূর ভবিষ্যতে সমস্যা হয়ে উঠতে পারে ছাত্রলীগ নিজেই, কেননা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এখন তাদের হাতে। কে না জানে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে দূষিত করে।
রাজশাহী থেকে ফিরে
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
বিনোদপুর গেট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢোকার মুখে তিন তরুণী শিক্ষার্থীকে বেরিয়ে আসতে দেখে তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম, কেমন চলছে বিশ্ববিদ্যালয়। একজন বললেন, ভালো। কোনো সমস্যা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘সমস্যা কিসের।’
‘চাপা অস্বস্তি অথবা ভয়, বা অন্ততপক্ষে অনিশ্চয়তা যে কখন আবার কী হয়—এ রকম অনুভব করেন কি?’ আমার এ প্রশ্নের উত্তরে পাশের তরুণী বললেন, কিছু ঘটলে আগে থেকে আভাস পাওয়া যায়। এবং নিশ্চিন্ত সুরে জানালেন, এখন সে রকম কোনো আভাস নেই।
গেটের ভেতরে গাছতলায় কয়েকটি বেঞ্চে বসে গল্প করছিলেন ‘আরএমপি’ লেখা স্টিকার লাগানো পোশাক-পরা রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের আটজন সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে একসঙ্গে কথা বলে উঠলেন তিনজন: ‘ভার্সিটি ঠিক আছে, কোনো গন্ডগোল নাই; কিন্তু আপনারা আমাদের কথা লেখেন না কেন? আমরা সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এখানে ডিউটি করি, পানি পর্যন্ত খাওয়ার ব্যবস্থা নাই’। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই, ইত্যাদি বলে তাঁরা নিজেদের দুঃখ-দুর্দশা প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে উঠলে তাড়াতাড়ি তাঁদের সালাম জানিয়ে ফিরে এলাম গেটে, আমার জন্য অপেক্ষমাণ রিকশাচালক ৭১ বছর বয়সী আশরাফ আলীর কাছে। আগেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আড়াআড়ি পার করিয়ে পুবের বিনোদপুর থেকে নিয়ে যাবেন পশ্চিমের মেহেরচন্ডি নামের পাড়ায়। সেখানেও প্রচুরসংখ্যক বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মেস। যেতে যেতে আশরাফ আলী জানালেন, তাঁর জন্ম বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন তালাইমারী মহল্লায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ভবন নির্মাণের কাজে তিনি রাজমিস্ত্রিদের জোগালির কাজ করেছেন। তাঁর মতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো দিনগুলো ছিল শহীদ ড. শামসুজ্জোহার সময়। তখন ছাত্ররা ভদ্র ছিল, শিক্ষকদের কথা শুনত, ভালোভাবে লেখাপড়া করত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমে রেলস্টেশনের গেটে আবারও দেখি অস্ত্রধারী পুলিশ। জিজ্ঞেস করলাম, নিরাপত্তার কোনো সমস্যা আছে কি না। তাঁরা মাথা নেড়ে বললেন, কোনো সমস্যা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি গেটে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা দুই শিফটে পালা করে পাহারা দিচ্ছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্যরা, প্রত্যেক শিফটে আটজন করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসের ভেতরে বোমা-ককটেল ফুটছে, শিবিরের ঝটিকা মিছিল বেরোচ্ছে—এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলেন না তাঁরা। শুধু বললেন, গেট ছাড়াও ক্যাম্পাসে ঢোকার অনেক পথ আছে।
আশরাফ আলী আমাকে নিয়ে গেলেন রেললাইনের পশ্চিম পাশের মেহেরচন্ডি উত্তরপাড়ায়। রিকশায় যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশের বাড়িগুলো দেখিয়ে বললেন, এগুলো সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেস। চারতলা একটি বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। রোজি ছাত্রাবাস। চারটি তলা মিলে ঘর আছে ৭০টি। ৭০ জন শিক্ষার্থী সেসব ঘরে ভাড়া থাকেন। মাসিক ভাড়া ঘরের আকারভেদে সাড়ে ৫০০ টাকা থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা। বাড়িটির নিচতলায় ছোট্ট একটি দোকান, বাড়ির মালিকের এক আত্মীয় সেটি চালাচ্ছেন। তিনি জানালেন, এই মেসের কোনো শিক্ষার্থী কোনো ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়, ঘর ভাড়া দেওয়ার সময় তাদের কাছে এই মর্মে অঙ্গীকারনামায় সই করিয়ে নেওয়া হয়। এ পাড়ায় মেসবাড়ি আছে ৬০-৭০টি। ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা কোন কোন মেসে থাকেন—এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কিন্তু এখানকার বাসিন্দা নয় এমন কেউ এ পাড়ায় বিয়েশাদি করেছেন কি না জানতে চাইলে একজন বললেন, এ রকম বিয়ে হয়েছে ৭০-৮০টি। আরেকজন তাঁর প্রতিবাদ করে বললেন, সংখ্যাটি অত বেশি হবে না, ৩০-৪০ হতে পারে। কিন্তু আগেরজন তাঁর বক্তব্যে অটল রইলেন এবং জানালেন, এ পাড়ার মেসগুলোতে পুলিশ মাঝেমধ্যে তল্লাশি চালাতে আসে। বলাবাহুল্য, জামায়াত-শিবিরের সন্ধানে।
ক্যাম্পাসের ভেতরেও জামায়াত-শিবিরের জন্য ফাঁদ পাতা আছে। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল ইসলাম অপু বললেন, তাঁরা রাত জেগে পাহারা দেন, তার মধ্যেও শিবিরের ছেলেরা হঠাৎ হঠাৎ ঝটিকা মিছিল বের করে, বোমা-ককটেল ফাটিয়ে পালিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন এমন চার যুবকের দেখা পাওয়া গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের পাশের রাস্তায়। তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিলেন জাতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোক বলে। তাঁরা জানালেন, ক্যাম্পাস এখন শান্ত, মোটের ওপর নিরাপদ, তবে অনিশ্চয়তা পুরোপুরি কাটেনি, কারণ দুষ্কৃতকারীরা সব সময়ই ওত পেতে আছে বিশৃঙ্খলা ঘটানোর জন্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহযোগী অধ্যাপক বললেন, ক্যাম্পাসে একটা নীরব ত্রাসের অনুভূতি নিরবচ্ছিন্নভাবে বিরাজমান আছে। মাদারবক্স আবাসিক হলের গেটে চার তরুণ শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁরা কোনো ভীতি বা অনিশ্চয়তা বোধ করেন কি না। একজন বললেন, অনিশ্চয়তা আছে, কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা মারামারি করবে না তো কি প্রাইমারি স্কুলের ছেলেরা মারামারি করবে?’
শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে আমগাছের নিচে চা-বিস্কুটের একটি দোকান (সুমনের দোকান) ঘিরে তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। গিটার বাজিয়ে গান গাইছেন কয়েকজন, একটি বেঞ্চে দাবা খেলতে বসেছেন দুজন, তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছেন আরও কয়েকজন। কিছুক্ষণ পর এক তরুণী এসে দুই দাবাড়ুর একজনের সঙ্গে শুরু করলেন খুনসুটি এবং সেটা গড়াল এমন পর্যায়ে যে তিনি দাবার ঘুুঁটিগুলো এলোমেলো করে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলেন। পাশের দুটি বেঞ্চে মুখোমুখি বসে চা খাচ্ছেন আর গল্পগুজব করছেন আট-দশজন তরুণ। তাঁদের বক্তব্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলো ইসলামী ছাত্রশিবিরের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয়েছে। তাঁরা সবাই ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিন্দা করলেন এবং শিবিরের আধিপত্য ও স্বেচ্ছাচারিতা কী ভয়ংকর মাত্রায় বেড়ে উঠেছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীরাও তাঁদের দ্বারা কীভাবে নিগৃহীত হতেন, সেসব বিবরণ তাঁরা দিতে লাগলেন। যেমন, একজন বললেন, এই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা প্রত্যেকটি আবাসিক হলে রাজত্ব করতেন। কোনো হলে নতুন কোনো ছাত্র এলে তাঁকে আলটিমেটাম পাঠানো হতো, রুমে ওঠার এক ঘণ্টার মধ্যে ওই হল শাখার শিবির সভাপতির কাছে গিয়ে দেখা করতে হবে। শিবির সভাপতি তাঁকে বলবেন, আমরা যেভাবে বলব, সেভাবে তোমাকে চলতে হবে, না-হলে হলে থাকতে পারবে না। শিবিরের নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা উপলক্ষে চাঁদা আদায় করতেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারির সহিংসতা ও ফারুক হত্যাকাণ্ডের পর শিবিরের সেই একচ্ছত্র আধিপত্য ও দাপটের অবসান হয়েছে। তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখন তৎপর ছাত্রসংগঠন বলতে আছে শুধু বাংলাদেশ ছাত্রলীগ; আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তারাও ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলোর দেখভালের দায়িত্ব পালন করছে। ছাত্রশিবির বিতাড়িত, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অস্তিত্বহীন। এমন অবস্থায় ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্ব স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা বিচিত্র নয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা যে জবরদস্তিমূলক আচরণ করতেন, এখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেই ভূমিকা নিয়েছেন কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য কাউকে ‘হ্যাঁ’ বলতে শোনা গেল না। শুধু একজন শিক্ষক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বললেন, ক্ষমতা ও দাপটের হাতবদল হয়েছে; ছাত্রলীগ পেয়েছে ছাত্রশিবিরের জায়গা। এবং ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের নামে বোমাবাজিসহ যেসব নেতিবাচক ঘটনা ঘটছে সেগুলো যে ছাত্রশিবিরই করছে, এমন নয়। ছাত্রলীগের মধ্যে কোন্দল আছে, আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের মধ্যেই অন্তত চারজন অধ্যাপক আছেন যাঁরা নিজেদেরকে উপাচার্যের চেয়ারে দেখতে চান। ওদিকে আছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র, যিনি আওয়ামী লীগের একজন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তিনিও দেখতে চান তাঁর পছন্দের কোনো অধ্যাপককে।
স্বল্প সময়ে সামান্য দেখেশুনে যা মনে হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রবেশ করেছে, যেখানে সাধারণ অর্থে নিরাপত্তার সংকট নেই, যেখানে ছাত্রশিবিরও আর কোনো বড় সমস্যা নয়। অদূর ভবিষ্যতে সমস্যা হয়ে উঠতে পারে ছাত্রলীগ নিজেই, কেননা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এখন তাদের হাতে। কে না জানে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে দূষিত করে।
রাজশাহী থেকে ফিরে
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments