তালেবানের শক্তিবৃদ্ধি ও পেট্রাউসের নতুন কৌশল by আহমেদ রশিদ
মার্কিন জেনারেল স্ট্যানলি ম্যাকক্রিস্টালের বিস্ময়কর ও দ্রুত পতনকে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্ররা যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে, তার আরও এক নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছেআফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে। সেখানে তারা মনে হয় এক অজেয় সংঘাতে লিপ্ত।
এই জেনারেলের পদচ্যুতিকে আফগান তালেবান তাদের সামরিক বিজয় হিসেবে বর্ণনা করছে। তালেবানের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণের এক চূড়ান্ত মুহূর্তে এটি ঘটেছে। কাবুল ও ইসলামাবাদের আশপাশে গুজব ছড়িয়েছে, ম্যাকক্রিস্টাল নিজেই চেয়েছিলেন তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হোক। কারণ যে যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, তার দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিতে চাননি। ম্যাকক্রিস্টালের পতনের এক সপ্তাহ পর ব্রিটিশরা দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশের অন্তর্গত দুর্গম ও অত্যন্ত ভয়ানক সানজিন এলাকা থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেওয়ার পর তালেবানরা আরও এক বিজয়ের দাবি জানাল। অবশ্য সেখানে ব্রিটিশ সেনাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন মার্কিন মেরিন সেনারা। ব্রিটেনের মোতায়েন করা নয় হাজার সেনার মধ্যে হেলমান্দে ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩১২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এঁদের মধ্যে সানজিনেই নিহত হয়েছেন প্রায় ১০০ জন।
এসব কারণে আফগানিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা দ্রুত গতিতে মিইয়ে যাচ্ছে—এমন শঙ্কা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরু করার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ওবামার বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পার হতে এখন এক বছরেরও কম বাকি আছে—এতে কাবুলে ধীরে ধীরে আতঙ্ক বাড়ছে। অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র নিজ থেকেই ক্রমশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার সত্যিকারের আশঙ্কার মধ্য দিতে যেতে হচ্ছে—সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক অভিজাততন্ত্র পাকিস্তানি তালেবানের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে অথবা বেসামরিক ব্যক্তিদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
গত ছয় সপ্তাহে আফগানিস্তানে ১২৫ জন মার্কিন ও ন্যাটো সেনা নিহত হয়েছেন। এটি এ সংঘাতে নিহতের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ১১ জুলাইয়েই ছয় মার্কিন সেনা, ১৪ আফগান পুলিশ এবং ১৫ বেসামরিক ব্যক্তি কয়েকটি ঘটনায় নিহত হয়েছেন। অপেক্ষাকৃত শান্ত উত্তর আফগানিস্তানে তালেবান পুলিশের চৌকির দখল নেওয়ার সময় এ পুলিশেরা মারা যান। তালেবান এখন এতটা শক্তি অর্জন করেছে যে দক্ষিণের কুন্দুজ ও বাদাখশান প্রদেশে এবং পশ্চিমের হেরাতে তাদের আক্রমণের আওতা বাড়াতে পারছে।
অন্যদিকে সেই ছয় সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানে ধারাবাহিক আত্মঘাতী বোমা হামলা ও হত্যাযজ্ঞে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৮০০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন; জনগণের মনোবল ভেঙে পড়েছে। ৯ জুলাই আফগান সীমান্তবর্তী উপজাতীয় এলাকায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় বহু নারী ও শিশুসহ মোট ১০৩ জন নিহত এবং আরও ১১৫ জন আহত হয়েছেন। এর পরপর মাত্র কয়েক দিন আগে লাহোরের দাতা গঞ্জ বকশের মাজারে ভয়ানক দুটি বোমা হামলা হয়েছে। দাতা গঞ্জ বকশ এলাকাটির সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সুফি সাধক ছিলেন। হামলায় ৩৫ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন শত শত। এই হামলার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে লাহোরে আহমদি সম্প্রদায়ের দুটি মসজিদে বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন ৯৫ জন।
এসব হামলা এবং এগুলোর বাইরে নানা হামলায় স্পষ্ট হয়েছে, পাকিস্তানি তালেবান তাদের অস্ত্রের নিশানা সেনা ও পুলিশ হত্যার থেকে ঘুরিয়ে দিয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মধ্যপন্থী মুসলমানদের দিকে। মুসলমান ও অমুসলমান, শিয়া ও সুন্নি এবং সুন্নিদের অভ্যন্তরে তারা নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়িয়ে দিতে মরিয়া। তাদের লক্ষ্য আধুনিক রাষ্ট্রকে উৎখাত করে ইসলামি আমিরাত প্রতিষ্ঠা। আন্তধর্মীয় যুদ্ধ কোনো সীমা, মাত্রা বা মানবিকতার ধার ধারে না। ইউরোপের অভিজ্ঞতায় তেমনটাই দেখা গেছে।
আর পাকিস্তানের অন্য প্রান্ত বন্দরনগর করাচিতে রাজনৈতিক, জাতিগত, সাম্প্রদায়িক ও মাফিয়াদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে প্রতিদিন প্রায় ৫-১০ জন নিহত হন। কারও বোঝার সাধ্যি নেই, এসব সহিংসতার পেছনে কী কাজ করছে। উপজাতীয় অঞ্চল এবং ইসলামাবাদ ও লাহোর নগরে জঙ্গি হামলা থেকে এসব সহিংসতার কারণ ভিন্ন বলেই মনে হয়। তবে এসব হামলা নগরবাসীর মনে ক্রমাগত বদ্ধমূল হতে থাকা নৈরাশ্যবাদ ও রোষকেই চাগিয়ে তুলছে।
এমন এক সময়ে সহিংসতাগুলো ঘটছে, যখন কাবুল ও ইসলামাবাদের সরকারগুলোকে দুর্বল মনে হচ্ছে—এরা রাজনৈতিক শত্রু ও প্রতিপক্ষ দ্বারা চারদিক থেকে আক্রান্ত; দুর্নীতির কলঙ্ক, মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটে অসহায় এবং অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনে দুর্বল। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির কর্মক্ষমতা খর্ব হচ্ছে তাঁর প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফ, অবাধ্য বিচারবিভাগ ও সেনাবাহিনীর কারণে। সেনাবাহিনী তাঁর বিদেশি নীতি পরিচালনা করে তাঁকে অবহিত না করেই। আর প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের দেশের ভেতর কুখ্যাতি ও ব্যর্থতা এতটাই প্রচারিত যে এখানে নতুন করে আর তার বিবরণ দেওয়ার দরকার নেই।
নতুন মার্কিন কমান্ডার জেনারেল ডেভিড পেট্রাউসের সঙ্গে কারজাইকে এখন বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হবে। তালেবানের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণে যখন প্রতিদিন হতাহতের ঘটনা ঘটছে, তখন এটা কোনো সহজ কাজ নয়। এখন কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে ভাবনাচিন্তার চেয়ে মাথায় ভর করে থাকে এসব হতাহতের চিন্তা। তালেবানের শক্ত ঘাঁটি কান্দাহার ও হেলমান্দে মার্কিন সেনাদের জড়ো করা কি আসলে কাজে আসছে, নাকি নতুন কৌশল প্রয়োজন—এ ব্যাপারে পেট্রাউসকে শিগগিরই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। এ বিষয়ক নীতি পর্যালোচনা করার জন্য নির্ধারিত ডিসেম্বর মাসের আগেই গোপনে ওবামা এ কাজটি করে ফেলার সম্ভাবনাই অনেক বেশি।
পেট্রাউসের সামনে আরেকটি সম্ভাব্য সংকট আছে। সেপ্টেম্বর মাসে আফগান সংসদের নিম্নকক্ষের ২৪৯টি আসনের জন্য আড়াই হাজার নারী-পুরুষ সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এর প্রভাবে আরও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে ব্যাপক জালিয়াতি ও সহিংসতা ঘটেছে, তাতে কারজাই, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ নির্বাচনেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটা খুবই সম্ভব। কেননা কারজাই অনেক নমনীয় একটি পার্লামেন্ট পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এ নির্বাচনেও জালিয়াতির ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি আবারও নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়, তবে আফগানরা একে পশ্চিমাদের আরেকটি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই গন্য করবে। আর তালেবান এটিকে তাদের আরেকটি বিজয় হিসেবে দেখাবে। বারবার জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। নির্বাচনে জালিয়াতি না দেখার ভান করে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এতে তাদের সম্মতির জানান দিয়েছে। তেমনাটা ঘটলে তালেবানের কর্তৃত্বের অধীনেই রয়ে যাবে কান্দাহার ও হেলমান্দ। আর বর্তমানে যেসব আফগান কৃষক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁরা তালেবানের দিকে ভিড়ে যাবেন।
আফগান সরকারের সুপরিচিত দুর্নীতি ছাড়াও চার বিলিয়নের বেশি ডলার কাবুল বিমানবন্দর হয়ে বাইরে পাচার হয়েছে, যার অধিকাংশ হয়েছে মার্কিন ঠিকাদার, ত্রাণকর্মী ও মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে—এমন খবরে প্রকাশ পেয়েছে। তাই মার্কিন কংগ্রেস অথবা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট আরও সহায়তা দেবে, সে আশাও ক্ষীণ। আফগান অর্থনীতি এখনো অগোছালো; জনগণের কাছে পণ্য ও সেবা পৌঁছে দেওয়ার সামর্থ্য এর নেই।
পাকিস্তানে তালেবান যে হুমকি তৈরি করেছে, তার মোকাবিলা যথাযথভাবে করতে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। আর এখন তারা কেন উত্তর ওয়াজিরিস্তান বা পাঞ্জাবে অপারেশন চালাতে পারবে না, সে ব্যাপারে নানা অজুহাত খাড়া করছে। আসলে দেশটির সেনাবাহিনী এবং এর ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে আচ্ছন্ন হয়ে নয়; সংস্থাটির মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছে আফগান, ন্যাটো ও আমেরিকানদের টেক্কা দিয়ে কারজাই ও তালেবানের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদনে মধ্যস্থতা করার বাসনা।
আইএসআই কারজাইকে দিয়ে জালালুদ্দিন হাক্কানি ও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন দুটি নব্য তালেবান গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ দুটি নব্য তালেবান গোষ্ঠীকে আইএসআই ২০০১ সাল থেকেই শক্ত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে। আফগান জনগণ এদের অপছন্দ করে। পাশাপাশি, আইএসআই গ্রেপ্তার, চাপ প্রয়োগ ও ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে আফগান তালেবান মূলধারাকেও প্রভাবিত করতে চেষ্টা করছে, যাতে তারা কারজাইয়ের সঙ্গে দেনদরবারে আইএসআইয়ের স্বার্থে অনুগত থাকে। আর এভাবে সংস্থাটি আফগানিস্তানে ভারতের উপস্থিতির পথ বন্ধ করতে কিংবা খুব কমিয়ে আনতে চায়।
আইএসআই জানে, আফগানিস্তান প্রশ্নে রাশিয়া, চীন, ভারত, সৌদি আরব, ইরানসহ সব আঞ্চলিক শক্তির চেয়ে পাকিস্তানের হাতে অনেক বেশি কার্ড আছে। আর এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে আইএসআইয়ের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে এসব শক্তির তেমন কিছু করার নেই। তবুও এদের অধিকাংশই কাবুলে আইএসআই-তালেবান কর্তৃত্বের সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়াকে সহ্য করবে না। ফলে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হবে। এ অঞ্চলে আরও গোলযোগ সৃষ্টি হবে।
তা ছাড়া আইএসআই যে কখনো তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সে সম্ভাবনাও খুব কম। ১৯৯২ সালে কাবুলের পতনের পরিণতি কিংবা ১৯৯৪ সালে তালেবানের উত্থান নিয়ন্ত্রণ করতে সংস্থাটি ব্যর্থ হয়েছিল। আর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঠিক আগে আগে এটি তালেবানের ওপর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। আইএসআই যদি দৃষ্টিভঙ্গি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটু সংযত করতে পারত আর কারজাইকে সত্যিকারে সহায়তা করত (উদাহরণস্বরূপ আফগানদের এমন একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে দিন, যা পাকিস্তানের চেয়ে বরং আফগানিস্তানের স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ), তাহলে পাকিস্তানের জন্যই অনেক বড় একটা কাজ করা হতো।
তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, কারজাইকে ঠেকা দিয়ে রাখা, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রতি ভালো আচরণ এবং ইউরোপীয় মিত্র ও নিজ দেশের কংগ্রেসকে খুশি রাখার পাশাপাশি ওবামা প্রশাসন এসব সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করবে, সে ব্যাপারে তারা মনে হয় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আফগানিস্তানে যে আগুন জ্বলছে, তা মোকাবিলা করতে পেট্রাউসের সাফল্য বা ব্যর্থতাই নির্ধারণ করে দেবে, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ভবিষ্যতে কী হবে।
নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. আহমেদ রশিদ: পাকিস্তানি প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক।
এই জেনারেলের পদচ্যুতিকে আফগান তালেবান তাদের সামরিক বিজয় হিসেবে বর্ণনা করছে। তালেবানের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণের এক চূড়ান্ত মুহূর্তে এটি ঘটেছে। কাবুল ও ইসলামাবাদের আশপাশে গুজব ছড়িয়েছে, ম্যাকক্রিস্টাল নিজেই চেয়েছিলেন তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হোক। কারণ যে যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, তার দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিতে চাননি। ম্যাকক্রিস্টালের পতনের এক সপ্তাহ পর ব্রিটিশরা দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশের অন্তর্গত দুর্গম ও অত্যন্ত ভয়ানক সানজিন এলাকা থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেওয়ার পর তালেবানরা আরও এক বিজয়ের দাবি জানাল। অবশ্য সেখানে ব্রিটিশ সেনাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন মার্কিন মেরিন সেনারা। ব্রিটেনের মোতায়েন করা নয় হাজার সেনার মধ্যে হেলমান্দে ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩১২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এঁদের মধ্যে সানজিনেই নিহত হয়েছেন প্রায় ১০০ জন।
এসব কারণে আফগানিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা দ্রুত গতিতে মিইয়ে যাচ্ছে—এমন শঙ্কা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরু করার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ওবামার বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পার হতে এখন এক বছরেরও কম বাকি আছে—এতে কাবুলে ধীরে ধীরে আতঙ্ক বাড়ছে। অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র নিজ থেকেই ক্রমশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার সত্যিকারের আশঙ্কার মধ্য দিতে যেতে হচ্ছে—সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক অভিজাততন্ত্র পাকিস্তানি তালেবানের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে অথবা বেসামরিক ব্যক্তিদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
গত ছয় সপ্তাহে আফগানিস্তানে ১২৫ জন মার্কিন ও ন্যাটো সেনা নিহত হয়েছেন। এটি এ সংঘাতে নিহতের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ১১ জুলাইয়েই ছয় মার্কিন সেনা, ১৪ আফগান পুলিশ এবং ১৫ বেসামরিক ব্যক্তি কয়েকটি ঘটনায় নিহত হয়েছেন। অপেক্ষাকৃত শান্ত উত্তর আফগানিস্তানে তালেবান পুলিশের চৌকির দখল নেওয়ার সময় এ পুলিশেরা মারা যান। তালেবান এখন এতটা শক্তি অর্জন করেছে যে দক্ষিণের কুন্দুজ ও বাদাখশান প্রদেশে এবং পশ্চিমের হেরাতে তাদের আক্রমণের আওতা বাড়াতে পারছে।
অন্যদিকে সেই ছয় সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানে ধারাবাহিক আত্মঘাতী বোমা হামলা ও হত্যাযজ্ঞে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৮০০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন; জনগণের মনোবল ভেঙে পড়েছে। ৯ জুলাই আফগান সীমান্তবর্তী উপজাতীয় এলাকায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় বহু নারী ও শিশুসহ মোট ১০৩ জন নিহত এবং আরও ১১৫ জন আহত হয়েছেন। এর পরপর মাত্র কয়েক দিন আগে লাহোরের দাতা গঞ্জ বকশের মাজারে ভয়ানক দুটি বোমা হামলা হয়েছে। দাতা গঞ্জ বকশ এলাকাটির সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সুফি সাধক ছিলেন। হামলায় ৩৫ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন শত শত। এই হামলার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে লাহোরে আহমদি সম্প্রদায়ের দুটি মসজিদে বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন ৯৫ জন।
এসব হামলা এবং এগুলোর বাইরে নানা হামলায় স্পষ্ট হয়েছে, পাকিস্তানি তালেবান তাদের অস্ত্রের নিশানা সেনা ও পুলিশ হত্যার থেকে ঘুরিয়ে দিয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মধ্যপন্থী মুসলমানদের দিকে। মুসলমান ও অমুসলমান, শিয়া ও সুন্নি এবং সুন্নিদের অভ্যন্তরে তারা নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়িয়ে দিতে মরিয়া। তাদের লক্ষ্য আধুনিক রাষ্ট্রকে উৎখাত করে ইসলামি আমিরাত প্রতিষ্ঠা। আন্তধর্মীয় যুদ্ধ কোনো সীমা, মাত্রা বা মানবিকতার ধার ধারে না। ইউরোপের অভিজ্ঞতায় তেমনটাই দেখা গেছে।
আর পাকিস্তানের অন্য প্রান্ত বন্দরনগর করাচিতে রাজনৈতিক, জাতিগত, সাম্প্রদায়িক ও মাফিয়াদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে প্রতিদিন প্রায় ৫-১০ জন নিহত হন। কারও বোঝার সাধ্যি নেই, এসব সহিংসতার পেছনে কী কাজ করছে। উপজাতীয় অঞ্চল এবং ইসলামাবাদ ও লাহোর নগরে জঙ্গি হামলা থেকে এসব সহিংসতার কারণ ভিন্ন বলেই মনে হয়। তবে এসব হামলা নগরবাসীর মনে ক্রমাগত বদ্ধমূল হতে থাকা নৈরাশ্যবাদ ও রোষকেই চাগিয়ে তুলছে।
এমন এক সময়ে সহিংসতাগুলো ঘটছে, যখন কাবুল ও ইসলামাবাদের সরকারগুলোকে দুর্বল মনে হচ্ছে—এরা রাজনৈতিক শত্রু ও প্রতিপক্ষ দ্বারা চারদিক থেকে আক্রান্ত; দুর্নীতির কলঙ্ক, মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটে অসহায় এবং অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনে দুর্বল। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির কর্মক্ষমতা খর্ব হচ্ছে তাঁর প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফ, অবাধ্য বিচারবিভাগ ও সেনাবাহিনীর কারণে। সেনাবাহিনী তাঁর বিদেশি নীতি পরিচালনা করে তাঁকে অবহিত না করেই। আর প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের দেশের ভেতর কুখ্যাতি ও ব্যর্থতা এতটাই প্রচারিত যে এখানে নতুন করে আর তার বিবরণ দেওয়ার দরকার নেই।
নতুন মার্কিন কমান্ডার জেনারেল ডেভিড পেট্রাউসের সঙ্গে কারজাইকে এখন বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হবে। তালেবানের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণে যখন প্রতিদিন হতাহতের ঘটনা ঘটছে, তখন এটা কোনো সহজ কাজ নয়। এখন কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে ভাবনাচিন্তার চেয়ে মাথায় ভর করে থাকে এসব হতাহতের চিন্তা। তালেবানের শক্ত ঘাঁটি কান্দাহার ও হেলমান্দে মার্কিন সেনাদের জড়ো করা কি আসলে কাজে আসছে, নাকি নতুন কৌশল প্রয়োজন—এ ব্যাপারে পেট্রাউসকে শিগগিরই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। এ বিষয়ক নীতি পর্যালোচনা করার জন্য নির্ধারিত ডিসেম্বর মাসের আগেই গোপনে ওবামা এ কাজটি করে ফেলার সম্ভাবনাই অনেক বেশি।
পেট্রাউসের সামনে আরেকটি সম্ভাব্য সংকট আছে। সেপ্টেম্বর মাসে আফগান সংসদের নিম্নকক্ষের ২৪৯টি আসনের জন্য আড়াই হাজার নারী-পুরুষ সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এর প্রভাবে আরও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে ব্যাপক জালিয়াতি ও সহিংসতা ঘটেছে, তাতে কারজাই, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ নির্বাচনেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটা খুবই সম্ভব। কেননা কারজাই অনেক নমনীয় একটি পার্লামেন্ট পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এ নির্বাচনেও জালিয়াতির ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি আবারও নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়, তবে আফগানরা একে পশ্চিমাদের আরেকটি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই গন্য করবে। আর তালেবান এটিকে তাদের আরেকটি বিজয় হিসেবে দেখাবে। বারবার জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। নির্বাচনে জালিয়াতি না দেখার ভান করে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এতে তাদের সম্মতির জানান দিয়েছে। তেমনাটা ঘটলে তালেবানের কর্তৃত্বের অধীনেই রয়ে যাবে কান্দাহার ও হেলমান্দ। আর বর্তমানে যেসব আফগান কৃষক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁরা তালেবানের দিকে ভিড়ে যাবেন।
আফগান সরকারের সুপরিচিত দুর্নীতি ছাড়াও চার বিলিয়নের বেশি ডলার কাবুল বিমানবন্দর হয়ে বাইরে পাচার হয়েছে, যার অধিকাংশ হয়েছে মার্কিন ঠিকাদার, ত্রাণকর্মী ও মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে—এমন খবরে প্রকাশ পেয়েছে। তাই মার্কিন কংগ্রেস অথবা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট আরও সহায়তা দেবে, সে আশাও ক্ষীণ। আফগান অর্থনীতি এখনো অগোছালো; জনগণের কাছে পণ্য ও সেবা পৌঁছে দেওয়ার সামর্থ্য এর নেই।
পাকিস্তানে তালেবান যে হুমকি তৈরি করেছে, তার মোকাবিলা যথাযথভাবে করতে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। আর এখন তারা কেন উত্তর ওয়াজিরিস্তান বা পাঞ্জাবে অপারেশন চালাতে পারবে না, সে ব্যাপারে নানা অজুহাত খাড়া করছে। আসলে দেশটির সেনাবাহিনী এবং এর ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে আচ্ছন্ন হয়ে নয়; সংস্থাটির মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছে আফগান, ন্যাটো ও আমেরিকানদের টেক্কা দিয়ে কারজাই ও তালেবানের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদনে মধ্যস্থতা করার বাসনা।
আইএসআই কারজাইকে দিয়ে জালালুদ্দিন হাক্কানি ও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন দুটি নব্য তালেবান গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ দুটি নব্য তালেবান গোষ্ঠীকে আইএসআই ২০০১ সাল থেকেই শক্ত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে। আফগান জনগণ এদের অপছন্দ করে। পাশাপাশি, আইএসআই গ্রেপ্তার, চাপ প্রয়োগ ও ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে আফগান তালেবান মূলধারাকেও প্রভাবিত করতে চেষ্টা করছে, যাতে তারা কারজাইয়ের সঙ্গে দেনদরবারে আইএসআইয়ের স্বার্থে অনুগত থাকে। আর এভাবে সংস্থাটি আফগানিস্তানে ভারতের উপস্থিতির পথ বন্ধ করতে কিংবা খুব কমিয়ে আনতে চায়।
আইএসআই জানে, আফগানিস্তান প্রশ্নে রাশিয়া, চীন, ভারত, সৌদি আরব, ইরানসহ সব আঞ্চলিক শক্তির চেয়ে পাকিস্তানের হাতে অনেক বেশি কার্ড আছে। আর এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে আইএসআইয়ের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে এসব শক্তির তেমন কিছু করার নেই। তবুও এদের অধিকাংশই কাবুলে আইএসআই-তালেবান কর্তৃত্বের সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়াকে সহ্য করবে না। ফলে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হবে। এ অঞ্চলে আরও গোলযোগ সৃষ্টি হবে।
তা ছাড়া আইএসআই যে কখনো তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সে সম্ভাবনাও খুব কম। ১৯৯২ সালে কাবুলের পতনের পরিণতি কিংবা ১৯৯৪ সালে তালেবানের উত্থান নিয়ন্ত্রণ করতে সংস্থাটি ব্যর্থ হয়েছিল। আর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঠিক আগে আগে এটি তালেবানের ওপর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। আইএসআই যদি দৃষ্টিভঙ্গি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটু সংযত করতে পারত আর কারজাইকে সত্যিকারে সহায়তা করত (উদাহরণস্বরূপ আফগানদের এমন একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে দিন, যা পাকিস্তানের চেয়ে বরং আফগানিস্তানের স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ), তাহলে পাকিস্তানের জন্যই অনেক বড় একটা কাজ করা হতো।
তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, কারজাইকে ঠেকা দিয়ে রাখা, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রতি ভালো আচরণ এবং ইউরোপীয় মিত্র ও নিজ দেশের কংগ্রেসকে খুশি রাখার পাশাপাশি ওবামা প্রশাসন এসব সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করবে, সে ব্যাপারে তারা মনে হয় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আফগানিস্তানে যে আগুন জ্বলছে, তা মোকাবিলা করতে পেট্রাউসের সাফল্য বা ব্যর্থতাই নির্ধারণ করে দেবে, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ভবিষ্যতে কী হবে।
নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. আহমেদ রশিদ: পাকিস্তানি প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক।
No comments