গৌড় কোথায় বলতে পারেন by মৃত্যুঞ্জয় রায়
সোনামসজিদ স্থলবন্দরে পৌঁছে একজন চা-দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, গৌড় কোথায় বলতে পারেন? জবাব পেলাম, সে তো বাড়ি নেই। আম বেচতে শিবগঞ্জের হাটে গেছে। সত্যিই তাই। প্রাচীনকালের সমৃদ্ধ এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ এখন সে জায়গার লোকদের কাছেই অচেনা। গৌড় রাজ্য অনেক আগেই হাটে বিক্রি হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। পাকা রাস্তা থেকে নেমে বিশাল বিশাল আমগাছের এক বাগানে ঢুকে পড়লাম। আম পাড়ার পর সেখানেই ঝুড়িভর্তি চলছে। সাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারের দুই পাশে দুটো মস্ত আমভর্তি ঝুড়ি নিয়ে আম-ব্যবসায়ীরা রওনা দিয়েছেন। পাকা রাস্তায় ট্রাক দাঁড়িয়ে। হয়তো ওটাতেও আম ওঠানো হবে। চলে যাবে দূরদেশে, অন্য কোথাও। বড় বড় ফজলি আম। সবে উঠতে শুরু করেছে। দেখে মন ভরে যায়। আমবাগানের মধ্যে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমের কারবার দেখতে লাগলাম। কিন্তু ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার জোগাড়। এক্ষুনি গৌড়কে খুঁজে না পেলে ওর সঙ্গে হয়তো আর দেখাই হবে না। তাই ফের খুঁজতে শুরু করলাম গৌড় রাজ্যের প্রাচীন কোনো ধ্বংসাবশেষ বা নিদর্শন, যা দেখে কিছুটা হলেও গৌড়ের ঐশ্বর্য পরিমাপ করা যায়। কিন্তু কেউই সঠিক বলতে পারলেন না যে গৌড়টা আসলে কোথায়? যখন জিজ্ঞেস করলাম, খুব পুরোনো কোনো দালান আছে এ গাঁয়ে? সেটার অবশ্য একটা হদিস পাওয়া গেল। এ আমবাগান পেরিয়ে দীঘির পাড় ধরে হেঁটে গেলে একটা মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ চোখে পড়বে। সেটার নাম দারাসবাড়ি মাদ্রাসা। মিনিট ১৫ হাঁটার পর সেখানে পৌঁছে খুব অবাক হলাম, আরও বেশি বিস্মিত হলাম দারাসবাড়ি মসজিদটি দেখে। কী অপূর্ব স্থাপত্য! ওগুলো দেখে গৌড় সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহই রইল না।
একসময় গৌড় শহরে প্রবেশের একটা তোরণ ছিল। শহরে প্রবেশের সেই মূল তোরণটি পরিচিত ছিল ‘কোতোয়ালি দরওয়াজা’ নামে। সোনামসজিদ স্থলবন্দর সীমান্তে বিশাল বালিয়াদীঘির কাছে বাংলাদেশ চেকপোস্টের উত্তর সীমানায় পৌঁছাতেই সেটা নজরে এল। তবে ইতিহাসে ওই দরজা বা তোরণের যে বর্ণনা পাই, তার এখন আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই কথিত যে এই দরজা দিয়েই ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলায় প্রবেশ করে মুসলিম যুগের সূচনা করেছিলেন। সে জন্য লোকেরা এ দরজাকে ‘দখল দরওয়াজা’ও বলে। এটি এ দেশে প্রথম মুসলিম যুগের স্থাপত্যকীর্তির এক অনন্য নিদর্শন। ভারতের মালদা জেলায় প্রবেশ করতে বা মালদা থেকে এ দেশে আসতে এ তোরণ বা দরজা পার হতে হয়। প্রাচীন গৌড় নগরে প্রবেশ করতে হলে দক্ষিণ নগর উপকণ্ঠের অধিবাসীদের এ তোরণ পার হয়ে সে শহরে ঢুকতে হতো। কোতোয়াল বা নগর দ্বাররক্ষকেরা তোরণটি পাহারা দিতেন বলে এর নাম হয় ‘কোতোয়ালি দরওয়াজা’। জেনারেল কানিংহাম এটিকে প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গের সুলতান নাসিরউদ্দিন মহম্মদ শাহের আমলে বাংলার রাজধানী পাণ্ডুয়া থেকে গৌড় স্থানান্তরিত হওয়ার পর গৌড়ের রাজধানীর নগরদ্বার হিসেবে এটি নির্মিত হয়। এর কাছেই গাছগাছালির মধ্যে অবহেলা-অনাদরে পড়ে আছে গৌড় জনপদের দুটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি—দারাসবাড়ি মাদ্রাসা ও দারাসবাড়ি মসজিদ।
মধ্যযুগে গৌড় ছিল ভারতবর্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। গৌড় নগরের অবস্থান ছিল এখনকার মালদা জেলার দক্ষিণে গঙ্গা ও মহানন্দা নদীর মাঝখানে। সেই গঙ্গা ও মহানন্দা নদী আজও বয়ে চলেছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো গৌড় নগর। প্রায় কুড়ি মাইল লম্বা ও চার মাইল প্রস্থ নিয়ে ছিল সেকালের গৌড় নগরের অবস্থান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৫০ থেকে ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গৌড় ছিল তৎকালীন বাংলার রাজধানী। তাই সে সময়ে গৌড় নগরে গড়ে ওঠে নানা রকম স্থাপনা ও স্থাপত্য। কিন্তু ১৫৭৫ সালে এক ভয়াবহ মহামারি প্লেগ রোগে সে নগর পরিত্যক্ত হয়, পরিণত হয় এক মৃত নগরে। আজও সে নগরের প্রাচীন পথে হাঁটলে চোখে পড়ে সেসব প্রাচীন নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ, মাটি খুঁড়লেই পাওয়া যায় ইটের টুকরা ও নানা রকম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
রাজা বল্লাল সেন আর লক্ষ্মণ সেনের আমলে গৌড়ের নাম ছিল লক্ষ্মণাবতী। ১২ শতকে মুসলিম শাসন শুরু হলে এর নাম হয় লখ্নৌতি। গৌড়-লখ্নৌতির বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সে যুগে দারাসবাড়ি মসজিদটিই ছিল বৃহত্তম মসজিদ। শামসুদ্দিন আবুল মুজাফ্ফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক ১৪৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। সমৃদ্ধ গৌড় নগরে একসময় এ রকম আরও কত কিছু যে ছিল, সে কথা আজ আর প্রমাণ করার কিছু নেই। মাটিচাপা ইট-পাথরগুলো যেন গৌড়ের এক অভিশপ্ত নিদর্শন। ওগুলো দেখে দেখে ভাবলাম, এভাবে একদিন সবই হারায়। গৌড়ের হারিয়ে যাওয়ার কথা জে সি মার্শম্যান তাঁর হিস্ট্রি অব বেঙ্গল-এ যেভাবে লিখেছেন, তা পড়ে গৌড়ের জন্য আফসোস আরও বেড়ে যায়। তিনি লিখেছেন, দুই হাজার বছর ধরে এ শহরটির অস্তিত্ব ছিল এবং তারপর তা ধ্বংস হয়ে যায়। সারা ভারতের মধ্যে এ শহরটি ছিল সবচেয়ে বেশি জাঁকজমকপূর্ণ। বিরাট বিরাট ইমারতে শহরটি পূর্ণ ছিল। এক শত রাজার রাজধানী এ শহর ছিল সম্পদ ও বিলাসিতার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়। গৌড় হারিয়ে যায় কালের অতল গর্ভে।
একসময় গৌড় শহরে প্রবেশের একটা তোরণ ছিল। শহরে প্রবেশের সেই মূল তোরণটি পরিচিত ছিল ‘কোতোয়ালি দরওয়াজা’ নামে। সোনামসজিদ স্থলবন্দর সীমান্তে বিশাল বালিয়াদীঘির কাছে বাংলাদেশ চেকপোস্টের উত্তর সীমানায় পৌঁছাতেই সেটা নজরে এল। তবে ইতিহাসে ওই দরজা বা তোরণের যে বর্ণনা পাই, তার এখন আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই কথিত যে এই দরজা দিয়েই ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলায় প্রবেশ করে মুসলিম যুগের সূচনা করেছিলেন। সে জন্য লোকেরা এ দরজাকে ‘দখল দরওয়াজা’ও বলে। এটি এ দেশে প্রথম মুসলিম যুগের স্থাপত্যকীর্তির এক অনন্য নিদর্শন। ভারতের মালদা জেলায় প্রবেশ করতে বা মালদা থেকে এ দেশে আসতে এ তোরণ বা দরজা পার হতে হয়। প্রাচীন গৌড় নগরে প্রবেশ করতে হলে দক্ষিণ নগর উপকণ্ঠের অধিবাসীদের এ তোরণ পার হয়ে সে শহরে ঢুকতে হতো। কোতোয়াল বা নগর দ্বাররক্ষকেরা তোরণটি পাহারা দিতেন বলে এর নাম হয় ‘কোতোয়ালি দরওয়াজা’। জেনারেল কানিংহাম এটিকে প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গের সুলতান নাসিরউদ্দিন মহম্মদ শাহের আমলে বাংলার রাজধানী পাণ্ডুয়া থেকে গৌড় স্থানান্তরিত হওয়ার পর গৌড়ের রাজধানীর নগরদ্বার হিসেবে এটি নির্মিত হয়। এর কাছেই গাছগাছালির মধ্যে অবহেলা-অনাদরে পড়ে আছে গৌড় জনপদের দুটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি—দারাসবাড়ি মাদ্রাসা ও দারাসবাড়ি মসজিদ।
মধ্যযুগে গৌড় ছিল ভারতবর্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। গৌড় নগরের অবস্থান ছিল এখনকার মালদা জেলার দক্ষিণে গঙ্গা ও মহানন্দা নদীর মাঝখানে। সেই গঙ্গা ও মহানন্দা নদী আজও বয়ে চলেছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো গৌড় নগর। প্রায় কুড়ি মাইল লম্বা ও চার মাইল প্রস্থ নিয়ে ছিল সেকালের গৌড় নগরের অবস্থান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৫০ থেকে ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গৌড় ছিল তৎকালীন বাংলার রাজধানী। তাই সে সময়ে গৌড় নগরে গড়ে ওঠে নানা রকম স্থাপনা ও স্থাপত্য। কিন্তু ১৫৭৫ সালে এক ভয়াবহ মহামারি প্লেগ রোগে সে নগর পরিত্যক্ত হয়, পরিণত হয় এক মৃত নগরে। আজও সে নগরের প্রাচীন পথে হাঁটলে চোখে পড়ে সেসব প্রাচীন নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ, মাটি খুঁড়লেই পাওয়া যায় ইটের টুকরা ও নানা রকম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
রাজা বল্লাল সেন আর লক্ষ্মণ সেনের আমলে গৌড়ের নাম ছিল লক্ষ্মণাবতী। ১২ শতকে মুসলিম শাসন শুরু হলে এর নাম হয় লখ্নৌতি। গৌড়-লখ্নৌতির বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সে যুগে দারাসবাড়ি মসজিদটিই ছিল বৃহত্তম মসজিদ। শামসুদ্দিন আবুল মুজাফ্ফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক ১৪৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। সমৃদ্ধ গৌড় নগরে একসময় এ রকম আরও কত কিছু যে ছিল, সে কথা আজ আর প্রমাণ করার কিছু নেই। মাটিচাপা ইট-পাথরগুলো যেন গৌড়ের এক অভিশপ্ত নিদর্শন। ওগুলো দেখে দেখে ভাবলাম, এভাবে একদিন সবই হারায়। গৌড়ের হারিয়ে যাওয়ার কথা জে সি মার্শম্যান তাঁর হিস্ট্রি অব বেঙ্গল-এ যেভাবে লিখেছেন, তা পড়ে গৌড়ের জন্য আফসোস আরও বেড়ে যায়। তিনি লিখেছেন, দুই হাজার বছর ধরে এ শহরটির অস্তিত্ব ছিল এবং তারপর তা ধ্বংস হয়ে যায়। সারা ভারতের মধ্যে এ শহরটি ছিল সবচেয়ে বেশি জাঁকজমকপূর্ণ। বিরাট বিরাট ইমারতে শহরটি পূর্ণ ছিল। এক শত রাজার রাজধানী এ শহর ছিল সম্পদ ও বিলাসিতার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়। গৌড় হারিয়ে যায় কালের অতল গর্ভে।
No comments