ঘাতকদের বিচার এবার শুরু হোক - শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের উত্সব উদ্যাপনের ঠিক আগেই আমাদের সামনে চলে আসে গভীর বেদনায় ভরা একটি দিন: ১৪ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত বিজয়শিখরে পৌঁছাবে, ঠিক তার প্রাক্কালে শেষ আঘাতটা হেনেছিল দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় সহযোগীরা—রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। সে আঘাত ছিল বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদের ওপর। তারা সুপরিকল্পিতভাবে বেছে বেছে হত্যা করেছিল শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিত্সকদের। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যেন মেধায়-মননে দীন হয়ে পড়ে, যেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে—এ-ই ছিল ঘাতকদের দূরপ্রসারী লক্ষ্য। আর তাত্ক্ষণিক লক্ষ্য ছিল আসন্ন পরাজয়ের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। সন্দেহ নেই এ এক চরম কাপুরুষতা।
আজ আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে স্মরণ করছি তাঁদের, যাঁদের আমরা হারিয়েছি একদম শেষ মুহূর্তে। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি অধ্যাপক জি সি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশেদুল হাসান, ড. আনোয়ার পাশা, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলিম চৌধুরী, সাহিত্যিক সেলিনা পারভীনসহ স্বাধীনতাযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি।
বুদ্ধিজীবী নিধনের এই ঘৃণ্যতম অপরাধটির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, দেশেরই কিছু মানুষ তা ঘটানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে। রাজাকার, আলবদর আর আলশামস বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে এমন লক্ষ্যভেদী হত্যাযজ্ঞ চালানো এতটা ব্যাপক মাত্রায় সম্ভব ছিল না। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও আলবদর বাহিনী সদস্যরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের উঠিয়ে এনেছে; তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে, কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে নিজেরাই। আর কী গ্লানির বিষয় যে সেই বিশ্বাসঘাতকদের অনেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজে ও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন, এমনকি মন্ত্রিত্বও পেয়েছেন। সেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা আজও স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সক্রিয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বাংলাদেশের চেতনাকে নস্যাত্ করার জন্য আজও তারা ষড়যন্ত্র করে চলেছে।
এ বছর আমরা যখন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও মহান বিজয় দিবস উদ্যাপন করছি, তখন দেশজুড়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ধ্বনিত হচ্ছে। সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড জঘন্যতম যুদ্ধাপরাধের দৃষ্টান্ত। এবং এই জঘন্যতম অপরাধযজ্ঞের অগ্রভাগে ছিল এ দেশেরই কিছু কুসন্তান: রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের বিচার দিয়েই শুরু হোক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সামগ্রিক প্রক্রিয়া। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রতিটি ঘটনার তদন্ত শুরু হোক; যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছিল, বিচার চলেছিল বা অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে বা রাজনৈতিক কারণে মামলা নষ্ট করা হয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা, পুনঃ তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হোক।
এভাবেই আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি।

No comments

Powered by Blogger.