শিক্ষা কখনো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়নি -প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি by এমাজউদ্দীন আহমদ
আমাদের দুর্ভাগ্য, দেশে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে সেই অতীতে, ব্রিটিশ আমলে, ব্রিটিশ আমলের পরে পাকিস্তান আমলে, এমনকি বাংলাদেশের জন্মের পরও, তার সমাপ্তি যেন হতে চায় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই গতি অব্যাহত রয়েছে প্রায় ২০০ বছর ধরে। তখনো যেসব বিষয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল, এখনো তা প্রাণবন্ত রয়েছে।
১৭৯২ সালের চার্লস গ্র্যান্টের শিক্ষাসংক্রান্ত সুপারিশমালা থেকে যার শুরু ১৮১৩ সালের কোম্পানি সনদে শিক্ষাবিষয়ক সুপারিশ, ১৮৩৫ সালের লর্ড মেকলে কমিটি, ১৮৫৪ সালের চার্লস উডের শিক্ষাবিষয়ক ডেসপ্যাচ, ১৮৮২ সালের হান্টার কমিশন, ১৯৩৪ সালের সাপ্রু কমিটি, ১৯৪৪ সালের সার্জেন্ট কমিটিতে তার সমাপ্তি ঘটেনি। পাকিস্তান আমলেও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার রকমফের ও প্রকৃতি নিয়ে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত রইল। ১৯৪৯ সালের পূর্ববঙ্গ শিক্ষা পুনর্গঠন কমিটি, ১৯৫২ সালের মওলানা আকরম খাঁ কমিটি, ১৯৫৭ সালের আতাউর রহমান খানের এডুকেশন রিফর্ম কমিশন, ১৯৫৯ সালের নূর খান কমিশনের প্রতিবেদন—এই অব্যাহত ধারার কিছু খণ্ডচিত্র।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল স্বপ্ন নিয়ে মাথা উঁচু করলেও এ ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি। আজ পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারা কিন্তু অব্যাহত রয়েছে। ১৯৭৪ সালের ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষানীতি, ১৯৭৭ সালের কাজী জাফর আহমদ শিক্ষা কমিটি, ১৯৮৩ সালের মজিদ খান কমিশন, ১৯৮৭ সালের মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিটির প্রতিবেদন, ২০০০ সালের শিক্ষানীতি, ২০০২ সালের শিক্ষা সংস্কার কমিটি এবং ২০০৩ সালের মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন এই ধারাবাহিকতার অংশ। সবশেষে প্রকাশিত হলো জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯।
এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা উল্লেখযোগ্য। এক. উল্লিখিত কমিটি বা কমিশনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই অভিজ্ঞ, প্রবীণ ও বহুদর্শী। তাঁদের অনেকেই জনপ্রিয় এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকও। শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কিন্তু তাঁদের নেতৃত্বে পরিচালিত কমিশনগুলো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যেসব সুপারিশ করেছে তা জীবনকে, তা ব্যক্তিগত হোক আর সামষ্টিক হোক, কীভাবে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারে, কীভাবে সাবলীল, সক্ষম ও সৃষ্টিশীল হতে সহায়তা করতে পারে, বিশেষ করে ব্যক্তিগত উত্কর্ষের ঊর্ধ্বে উঠে সামগ্রিকতার আশীর্বাদ লাভ করে সুষ্ঠু জীবনবোধের অধিকারী করে তুলতে পারে, তার পূর্ণ প্রকাশ কোনোটিতে ঘটেনি। দুই. এসব কমিটি বা কমিশনের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ লিপিবদ্ধ হয়েছে খণ্ডিতরূপে, তা পর্যালোচনা করলে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ ঘটে। কিন্তু সার্বিকভাবে কোনোটিতে জীবনঘনিষ্ঠ, ঐক্যবদ্ধ, সুসমন্বিত ব্যবস্থার ছবি উপস্থাপিত হয়নি। সুপারিশগুলোর কোনো কোনোটি উত্তম হলেও একটির সঙ্গে আর একটির আত্মিক যোগসূত্র লক্ষ করা যায় না। তাছাড়া বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করতে গিয়ে এমন কিছু সুপারিশ উপস্থাপিত হয়েছে বা অনেকটা অ্যাডহক টাইপের, রাজনৈতিক স্লোগানসর্বস্ব। দীর্ঘকালীন পরিসরে জাতীয় জীবনকে এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্য সুসমন্বিত কোনো ব্যবস্থার অনুপস্থিতি খুব পীড়াদায়ক। এর কারণও অবশ্য সুস্পষ্ট। যখনই নতুন কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হয়, তখন রাজনৈতিক ইতিহাসে নাম লেখাতে কিছু বরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে বেশ কিছু অনুগত চেনা মুখের সমাহার ঘটিয়ে নিজেদের উচ্চারণগুলোকে বা কমিশনের প্রতিবেদনও গ্রন্থাগারের এক কোণে স্থান লাভ করে, এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে এক ছোট্ট ফুটনোট রূপে।
দুই.
বেশ কয় বছর আগে জাপান ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য জাপানের কিছু সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য জাপান গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে এক ব্রিফিং অনুষ্ঠানে জাপানি রাষ্ট্রদূত অনেকটা আত্মতুষ্টির সঙ্গে বলেছিলেন, ‘জাপানে আমরা ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্বখ্যাত শিক্ষাঙ্গন সৃষ্টি করতে পারিনি বটে, কিন্তু আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গনগুলো অতুলনীয়। বিশ্বের সমতুল্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তা শ্রেষ্ঠতর। আমারও অভিজ্ঞতা ঠিক তেমনি। টোকিও, কিয়োটো এবং আরও কয়েকটি মহানগরের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি মাধ্যমিক এবং একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠক্রম দেখে, ওই সব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে, বিশেষ করে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা দেখে আমার এই প্রতীতি দৃঢ় হয়েছে যে জাপানের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা সত্যই অত্যন্ত উন্নতমানের। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সচেতন, সত্, আত্মপ্রত্যয়ী, সৃজনশীল নাগরিক সৃষ্টির জন্য এই বয়সের কিশোর-কিশোরীদের যা জানা দরকার, যা শেখা দরকার এবং জীবনব্যাপী যা চর্চা করা দরকার, তার প্রায় সবই জাপানের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যায়তনে সরবরাহ করা হয়।
তারপরও ভেবে অবাক হই, ২০০০ সালের ২২ ডিসেম্বর জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য গঠিত একটি কমিশন সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গতানুগতিক চিহ্নিত করে তার আমূল সংস্কারের জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ পেশ করে। কোনো দলীয় কর্মী বা দলের অনুগতদের দ্বারা নয়, বরং ২৬ জন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সভাপতি ছিলেন পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক আর ইসাকি। এই কমিশনের সুপারিশমালা দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হয়। এক. জাপানের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তি খাতের সৃজনশীলতা ধারণ করতে সক্ষম নয়। দুই. বর্তমান যুগের দ্রুত প্রসারমাণ কিশোর অপরাধের এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের গতিরোধে অক্ষম। এই দুটি প্রধান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কমিশনের সুপারিশ ছিল: এক. বর্তমান যুগের চাহিদা মেটাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সৃজনশীল মন বিনির্মাণ। দুই. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর শিক্ষাব্যবস্থায় শুধু তীব্র প্রতিযোগিতায় প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে শত্রু নিধনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সবার সঙ্গে সহযোগিতার বন্ধন প্রতিষ্ঠা করে বন্ধুত্বের সুখদ পরিবেশ সৃষ্টির কোনো শিক্ষা দেওয়া হয়নি। তাই নতুন শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষাদানের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এই কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধোত্তর জাপানি শিক্ষাব্যবস্থায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য দক্ষ জনশক্তি গঠন ছিল মূল লক্ষ্য। তাই শিক্ষার্থীরা সব তথ্য মুখস্থ করে, বিদ্যমান প্রযুক্তির সবটুকু আয়ত্তে এনে, বর্তমানের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে, সবার ওপর মাথা উঁচু করার শিক্ষা লাভ করেছিল। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান তার দক্ষ, সক্ষম ও সচেতন কর্মীদের মাধ্যমে বিশ্বে এক অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু শিক্ষা কমিশনের সংশয় হলো—আজকের জন্য এই শিক্ষাব্যবস্থা ফলপ্রসূ বটে, কিন্তু আগামীকাল এর পরিণতি কী? বিদ্যমান প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটে উপযোগী হলেও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এর উপযোগিতা কতটুকু? যে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সে ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা উপযোগী হলেও যে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজন হবে, সে ক্ষেত্রে এর ব্যর্থতা প্রকট নয় কি?
তিন.
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বেহাল অবস্থায় রয়েছে। এটি না সচেতন, না আধুনিক। বাংলাদেশের শিক্ষায় না আছে ব্যক্তিত্ব গঠনের সূত্র, নেই জাতি গঠনের চিত্শক্তিও। বিভিন্ন কালের সংগৃহীত উপাদানগুলোর আলগা সংযোজনে গড়ে ওঠা কিম্ভূতকিমাকার এক ব্যবস্থা এটি। হিন্দু ভারতের টোল-চতুষ্পাঠীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে মুসলিম ভারতের মক্তব-মাদ্রাসা এবং তার সঙ্গে আলগাভাবে জড়িত হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের সাধারণ শিক্ষা। এই শিক্ষা সবাইকে এক সূত্রে গ্রথিত করে না। সবার জন্য মিলনের ক্ষেত্রও রচে না। বরং সবাই যেন ভিন্ন অবস্থানে অনড় থাকে, তার ব্যবস্থা পাকা করেছে। এই শিক্ষা না উচ্চারণ করে সহযোগিতার মন্ত্র, না সৃজন করে আত্মার বন্ধন। খণ্ডছিন্ন, বিভেদ-সূচক, নিরানন্দ। আমাদের দেশের শিক্ষা একদিকে যেমন প্রাণহীন, অন্যদিকে তেমনি গতিশীল জীবনের জন্য অর্থহীন। তাই উচ্চতর ডিগ্রিধারী এবং অর্ধশিক্ষিতদের কেউ কোনো সৃজনশীল উদ্যোগে এখন পর্যন্ত তেমন সফল হলো না, কেননা এদের কাউকে সৃজনশীলতার জাদু স্পর্শ করতে পারেনি। শিক্ষিত হয়েও অনেকে প্রশিক্ষিত মনের অধিকারী হতে পারেননি।
একুশ শতকে কিন্তু প্রতিযোগিতা হবে মেধার, পেশির নয়। এই প্রতিযোগিতা হবে মননের, সৃজনশীলতার, বাচালতার নয়। এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে হলে প্রয়োজন হবে সৃষ্টিশীল মস্তিষ্কের, বিরাট বপুর নয়। প্রয়োজন হবে উদার অন্তকরণের, বুকভরা হিংসা বা প্রতিহিংসার নয়। আমার মনে হয়েছে, দেশে যে শিক্ষা চালু রয়েছে, বর্তমানের জন্য আংশিকভাবে তা ফলপ্রসূ হলেও ভবিষ্যতের জন্য, বিশেষ করে এই শতকের মহাসমারোহে মর্যাদার সঙ্গে টিকে থাকার জন্য তা মোটেই উপযোগী নয়। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে নির্দিষ্ট পাঠক্রম সাধারণ ভাবনা-চিন্তার দুর্গে প্রবেশ করার জন্য উপযোগী হলেও যে দুর্গ আত্মরক্ষা এবং নিরাপত্তার দুর্ভেদ্য কেন্দ্ররূপে চিহ্নিত, সেখানে প্রবেশাধিকার দান করবে না। এই শিক্ষা শুধু কর্মজীবনের সাধারণ গৃহে প্রবেশে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু যে গৃহ সাফল্যের অন্তঃপুর, যা হাজারো উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন, যা ভবিষ্যতের বন্ধুর পথে সাবলীলভাবে পথচলার নির্দেশক এবং উন্নত জীবনের কাঙ্ক্ষিত কেন্দ্র, সেই গৃহে প্রবেশের সাহস বা সামর্থ্য জোগায় না। এ জন্যই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার অপরিহার্য।
শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার অপরিহার্য হলেও এবং এ সম্পর্কে সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়ন কিন্তু যথেষ্ট নয়। এ জন্য প্রয়োজন জাতির সার্বিক প্রস্তুতি। প্রয়োজন জাতির রাজনৈতিক দৃঢ় প্রকল্প। ২০০৯ সালের শিক্ষানীতি ঘোষিত হওয়ার আগে যেসব প্রস্তাব এসেছিল তার সবই কি অর্থহীন ছিল? ছিল কি অপ্রাসঙ্গিক? সেগুলোর কোনো অংশ কি গ্রহণযোগ্য ছিল না? সেগুলো গৃহীত হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে আসত। হয়নি, কেননা এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে ক্ষমতাসীন দল শুধু দলীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমেই শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করতে চায়। অন্যান্য দেশে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় বিশেষজ্ঞদের ওপর। তাছাড়া আরও একটি কারণে বাংলাদেশে শিক্ষানীতি কোনো দিন বাস্তবায়িত হয়নি। গত ৩৮ বছরে কোনো সরকার শিক্ষা কার্যক্রমকে কোনো সময়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকাররূপে গ্রহণ করেনি। কয়েকটি দিকে তাকালে তা সুস্পষ্ট হবে। এক. কোনো সরকারের আমলে যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়; কিন্তু সাধারণভাবে দেখা গেছে, কাউকে মন্ত্রী করতে হবে অথচ তাঁর জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পোর্টফোলিও পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তাঁকে শিক্ষামন্ত্রী করা হলো। দুই. বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিযোগ সব সময় হয়েছে অতি অল্প। বেশ কয়েক বছর থেকে একটু বেড়েছে বটে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য যা প্রয়োজন তার ধারেকাছে কোনো দিন এই বিনিয়োগ আসেনি।
কোনো উন্নত দেশের দিকে না তাকিয়ে যদি আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকাই, তাহলেই চলবে। যে ক্ষেত্রে ওই সব দেশ মোট জাতীয় উত্পাদনের শতকরা ৪.৫ থেকে ৬ ভাগ শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় করছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যয় করছে শতকরা ২ ভাগের মতো। যে উচ্চশিক্ষা সমগ্র শিক্ষাক্ষেত্রকে প্রণোদিত করে থাকে, সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ একেবারেই অপ্রতুল। তাই বলি, অতীতে প্রণীত শিক্ষানীতি যে বাস্তবায়িত হয়নি তা পীড়াদায়ক নিশ্চয়ই, কিন্তু তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রও তৈরি হয়নি কোনো সময়। তাছাড়া যখনই কোনো আন্দোলনের সূচনা হয় দেশে, তখন সেই আন্দোলনের প্রথম শিকার হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন এ ক্ষেত্রে সংযম প্রদর্শন করেনি; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের মতো চলতে দেয়নি।
আগামীকাল: কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন
এমাজউদ্দীন আহমদ: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৭৯২ সালের চার্লস গ্র্যান্টের শিক্ষাসংক্রান্ত সুপারিশমালা থেকে যার শুরু ১৮১৩ সালের কোম্পানি সনদে শিক্ষাবিষয়ক সুপারিশ, ১৮৩৫ সালের লর্ড মেকলে কমিটি, ১৮৫৪ সালের চার্লস উডের শিক্ষাবিষয়ক ডেসপ্যাচ, ১৮৮২ সালের হান্টার কমিশন, ১৯৩৪ সালের সাপ্রু কমিটি, ১৯৪৪ সালের সার্জেন্ট কমিটিতে তার সমাপ্তি ঘটেনি। পাকিস্তান আমলেও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার রকমফের ও প্রকৃতি নিয়ে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত রইল। ১৯৪৯ সালের পূর্ববঙ্গ শিক্ষা পুনর্গঠন কমিটি, ১৯৫২ সালের মওলানা আকরম খাঁ কমিটি, ১৯৫৭ সালের আতাউর রহমান খানের এডুকেশন রিফর্ম কমিশন, ১৯৫৯ সালের নূর খান কমিশনের প্রতিবেদন—এই অব্যাহত ধারার কিছু খণ্ডচিত্র।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল স্বপ্ন নিয়ে মাথা উঁচু করলেও এ ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি। আজ পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারা কিন্তু অব্যাহত রয়েছে। ১৯৭৪ সালের ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষানীতি, ১৯৭৭ সালের কাজী জাফর আহমদ শিক্ষা কমিটি, ১৯৮৩ সালের মজিদ খান কমিশন, ১৯৮৭ সালের মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিটির প্রতিবেদন, ২০০০ সালের শিক্ষানীতি, ২০০২ সালের শিক্ষা সংস্কার কমিটি এবং ২০০৩ সালের মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন এই ধারাবাহিকতার অংশ। সবশেষে প্রকাশিত হলো জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯।
এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা উল্লেখযোগ্য। এক. উল্লিখিত কমিটি বা কমিশনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই অভিজ্ঞ, প্রবীণ ও বহুদর্শী। তাঁদের অনেকেই জনপ্রিয় এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকও। শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কিন্তু তাঁদের নেতৃত্বে পরিচালিত কমিশনগুলো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যেসব সুপারিশ করেছে তা জীবনকে, তা ব্যক্তিগত হোক আর সামষ্টিক হোক, কীভাবে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারে, কীভাবে সাবলীল, সক্ষম ও সৃষ্টিশীল হতে সহায়তা করতে পারে, বিশেষ করে ব্যক্তিগত উত্কর্ষের ঊর্ধ্বে উঠে সামগ্রিকতার আশীর্বাদ লাভ করে সুষ্ঠু জীবনবোধের অধিকারী করে তুলতে পারে, তার পূর্ণ প্রকাশ কোনোটিতে ঘটেনি। দুই. এসব কমিটি বা কমিশনের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ লিপিবদ্ধ হয়েছে খণ্ডিতরূপে, তা পর্যালোচনা করলে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ ঘটে। কিন্তু সার্বিকভাবে কোনোটিতে জীবনঘনিষ্ঠ, ঐক্যবদ্ধ, সুসমন্বিত ব্যবস্থার ছবি উপস্থাপিত হয়নি। সুপারিশগুলোর কোনো কোনোটি উত্তম হলেও একটির সঙ্গে আর একটির আত্মিক যোগসূত্র লক্ষ করা যায় না। তাছাড়া বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করতে গিয়ে এমন কিছু সুপারিশ উপস্থাপিত হয়েছে বা অনেকটা অ্যাডহক টাইপের, রাজনৈতিক স্লোগানসর্বস্ব। দীর্ঘকালীন পরিসরে জাতীয় জীবনকে এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্য সুসমন্বিত কোনো ব্যবস্থার অনুপস্থিতি খুব পীড়াদায়ক। এর কারণও অবশ্য সুস্পষ্ট। যখনই নতুন কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হয়, তখন রাজনৈতিক ইতিহাসে নাম লেখাতে কিছু বরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে বেশ কিছু অনুগত চেনা মুখের সমাহার ঘটিয়ে নিজেদের উচ্চারণগুলোকে বা কমিশনের প্রতিবেদনও গ্রন্থাগারের এক কোণে স্থান লাভ করে, এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে এক ছোট্ট ফুটনোট রূপে।
দুই.
বেশ কয় বছর আগে জাপান ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য জাপানের কিছু সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য জাপান গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে এক ব্রিফিং অনুষ্ঠানে জাপানি রাষ্ট্রদূত অনেকটা আত্মতুষ্টির সঙ্গে বলেছিলেন, ‘জাপানে আমরা ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্বখ্যাত শিক্ষাঙ্গন সৃষ্টি করতে পারিনি বটে, কিন্তু আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গনগুলো অতুলনীয়। বিশ্বের সমতুল্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তা শ্রেষ্ঠতর। আমারও অভিজ্ঞতা ঠিক তেমনি। টোকিও, কিয়োটো এবং আরও কয়েকটি মহানগরের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি মাধ্যমিক এবং একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠক্রম দেখে, ওই সব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে, বিশেষ করে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা দেখে আমার এই প্রতীতি দৃঢ় হয়েছে যে জাপানের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা সত্যই অত্যন্ত উন্নতমানের। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সচেতন, সত্, আত্মপ্রত্যয়ী, সৃজনশীল নাগরিক সৃষ্টির জন্য এই বয়সের কিশোর-কিশোরীদের যা জানা দরকার, যা শেখা দরকার এবং জীবনব্যাপী যা চর্চা করা দরকার, তার প্রায় সবই জাপানের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যায়তনে সরবরাহ করা হয়।
তারপরও ভেবে অবাক হই, ২০০০ সালের ২২ ডিসেম্বর জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য গঠিত একটি কমিশন সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গতানুগতিক চিহ্নিত করে তার আমূল সংস্কারের জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ পেশ করে। কোনো দলীয় কর্মী বা দলের অনুগতদের দ্বারা নয়, বরং ২৬ জন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সভাপতি ছিলেন পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক আর ইসাকি। এই কমিশনের সুপারিশমালা দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হয়। এক. জাপানের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তি খাতের সৃজনশীলতা ধারণ করতে সক্ষম নয়। দুই. বর্তমান যুগের দ্রুত প্রসারমাণ কিশোর অপরাধের এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের গতিরোধে অক্ষম। এই দুটি প্রধান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কমিশনের সুপারিশ ছিল: এক. বর্তমান যুগের চাহিদা মেটাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সৃজনশীল মন বিনির্মাণ। দুই. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর শিক্ষাব্যবস্থায় শুধু তীব্র প্রতিযোগিতায় প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে শত্রু নিধনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সবার সঙ্গে সহযোগিতার বন্ধন প্রতিষ্ঠা করে বন্ধুত্বের সুখদ পরিবেশ সৃষ্টির কোনো শিক্ষা দেওয়া হয়নি। তাই নতুন শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষাদানের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এই কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধোত্তর জাপানি শিক্ষাব্যবস্থায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য দক্ষ জনশক্তি গঠন ছিল মূল লক্ষ্য। তাই শিক্ষার্থীরা সব তথ্য মুখস্থ করে, বিদ্যমান প্রযুক্তির সবটুকু আয়ত্তে এনে, বর্তমানের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে, সবার ওপর মাথা উঁচু করার শিক্ষা লাভ করেছিল। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান তার দক্ষ, সক্ষম ও সচেতন কর্মীদের মাধ্যমে বিশ্বে এক অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু শিক্ষা কমিশনের সংশয় হলো—আজকের জন্য এই শিক্ষাব্যবস্থা ফলপ্রসূ বটে, কিন্তু আগামীকাল এর পরিণতি কী? বিদ্যমান প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটে উপযোগী হলেও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এর উপযোগিতা কতটুকু? যে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সে ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা উপযোগী হলেও যে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজন হবে, সে ক্ষেত্রে এর ব্যর্থতা প্রকট নয় কি?
তিন.
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বেহাল অবস্থায় রয়েছে। এটি না সচেতন, না আধুনিক। বাংলাদেশের শিক্ষায় না আছে ব্যক্তিত্ব গঠনের সূত্র, নেই জাতি গঠনের চিত্শক্তিও। বিভিন্ন কালের সংগৃহীত উপাদানগুলোর আলগা সংযোজনে গড়ে ওঠা কিম্ভূতকিমাকার এক ব্যবস্থা এটি। হিন্দু ভারতের টোল-চতুষ্পাঠীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে মুসলিম ভারতের মক্তব-মাদ্রাসা এবং তার সঙ্গে আলগাভাবে জড়িত হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের সাধারণ শিক্ষা। এই শিক্ষা সবাইকে এক সূত্রে গ্রথিত করে না। সবার জন্য মিলনের ক্ষেত্রও রচে না। বরং সবাই যেন ভিন্ন অবস্থানে অনড় থাকে, তার ব্যবস্থা পাকা করেছে। এই শিক্ষা না উচ্চারণ করে সহযোগিতার মন্ত্র, না সৃজন করে আত্মার বন্ধন। খণ্ডছিন্ন, বিভেদ-সূচক, নিরানন্দ। আমাদের দেশের শিক্ষা একদিকে যেমন প্রাণহীন, অন্যদিকে তেমনি গতিশীল জীবনের জন্য অর্থহীন। তাই উচ্চতর ডিগ্রিধারী এবং অর্ধশিক্ষিতদের কেউ কোনো সৃজনশীল উদ্যোগে এখন পর্যন্ত তেমন সফল হলো না, কেননা এদের কাউকে সৃজনশীলতার জাদু স্পর্শ করতে পারেনি। শিক্ষিত হয়েও অনেকে প্রশিক্ষিত মনের অধিকারী হতে পারেননি।
একুশ শতকে কিন্তু প্রতিযোগিতা হবে মেধার, পেশির নয়। এই প্রতিযোগিতা হবে মননের, সৃজনশীলতার, বাচালতার নয়। এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে হলে প্রয়োজন হবে সৃষ্টিশীল মস্তিষ্কের, বিরাট বপুর নয়। প্রয়োজন হবে উদার অন্তকরণের, বুকভরা হিংসা বা প্রতিহিংসার নয়। আমার মনে হয়েছে, দেশে যে শিক্ষা চালু রয়েছে, বর্তমানের জন্য আংশিকভাবে তা ফলপ্রসূ হলেও ভবিষ্যতের জন্য, বিশেষ করে এই শতকের মহাসমারোহে মর্যাদার সঙ্গে টিকে থাকার জন্য তা মোটেই উপযোগী নয়। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে নির্দিষ্ট পাঠক্রম সাধারণ ভাবনা-চিন্তার দুর্গে প্রবেশ করার জন্য উপযোগী হলেও যে দুর্গ আত্মরক্ষা এবং নিরাপত্তার দুর্ভেদ্য কেন্দ্ররূপে চিহ্নিত, সেখানে প্রবেশাধিকার দান করবে না। এই শিক্ষা শুধু কর্মজীবনের সাধারণ গৃহে প্রবেশে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু যে গৃহ সাফল্যের অন্তঃপুর, যা হাজারো উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন, যা ভবিষ্যতের বন্ধুর পথে সাবলীলভাবে পথচলার নির্দেশক এবং উন্নত জীবনের কাঙ্ক্ষিত কেন্দ্র, সেই গৃহে প্রবেশের সাহস বা সামর্থ্য জোগায় না। এ জন্যই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার অপরিহার্য।
শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার অপরিহার্য হলেও এবং এ সম্পর্কে সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়ন কিন্তু যথেষ্ট নয়। এ জন্য প্রয়োজন জাতির সার্বিক প্রস্তুতি। প্রয়োজন জাতির রাজনৈতিক দৃঢ় প্রকল্প। ২০০৯ সালের শিক্ষানীতি ঘোষিত হওয়ার আগে যেসব প্রস্তাব এসেছিল তার সবই কি অর্থহীন ছিল? ছিল কি অপ্রাসঙ্গিক? সেগুলোর কোনো অংশ কি গ্রহণযোগ্য ছিল না? সেগুলো গৃহীত হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে আসত। হয়নি, কেননা এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে ক্ষমতাসীন দল শুধু দলীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমেই শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করতে চায়। অন্যান্য দেশে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় বিশেষজ্ঞদের ওপর। তাছাড়া আরও একটি কারণে বাংলাদেশে শিক্ষানীতি কোনো দিন বাস্তবায়িত হয়নি। গত ৩৮ বছরে কোনো সরকার শিক্ষা কার্যক্রমকে কোনো সময়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকাররূপে গ্রহণ করেনি। কয়েকটি দিকে তাকালে তা সুস্পষ্ট হবে। এক. কোনো সরকারের আমলে যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়; কিন্তু সাধারণভাবে দেখা গেছে, কাউকে মন্ত্রী করতে হবে অথচ তাঁর জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পোর্টফোলিও পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তাঁকে শিক্ষামন্ত্রী করা হলো। দুই. বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিযোগ সব সময় হয়েছে অতি অল্প। বেশ কয়েক বছর থেকে একটু বেড়েছে বটে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য যা প্রয়োজন তার ধারেকাছে কোনো দিন এই বিনিয়োগ আসেনি।
কোনো উন্নত দেশের দিকে না তাকিয়ে যদি আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকাই, তাহলেই চলবে। যে ক্ষেত্রে ওই সব দেশ মোট জাতীয় উত্পাদনের শতকরা ৪.৫ থেকে ৬ ভাগ শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় করছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যয় করছে শতকরা ২ ভাগের মতো। যে উচ্চশিক্ষা সমগ্র শিক্ষাক্ষেত্রকে প্রণোদিত করে থাকে, সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ একেবারেই অপ্রতুল। তাই বলি, অতীতে প্রণীত শিক্ষানীতি যে বাস্তবায়িত হয়নি তা পীড়াদায়ক নিশ্চয়ই, কিন্তু তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রও তৈরি হয়নি কোনো সময়। তাছাড়া যখনই কোনো আন্দোলনের সূচনা হয় দেশে, তখন সেই আন্দোলনের প্রথম শিকার হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন এ ক্ষেত্রে সংযম প্রদর্শন করেনি; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের মতো চলতে দেয়নি।
আগামীকাল: কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন
এমাজউদ্দীন আহমদ: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments