একটি মৃত্যু ও কিছু ভাবনা -সময়ের প্রেক্ষিত by মনজুরুল হক

মৃত্যুর সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গ বসবাস। মৃত্যুর এই নিকট সান্নিধ্য সত্ত্বেও মানুষের মৃত্যুতে আমরা হই ব্যথিত। আর সেই মৃত্যু যদি হয় পরিচিত কিংবা আপন কারও মৃত্যু, বেদনার ভার সেখানে সংগত কারণেই হয়ে থাকে আরও অনেক বেশি। কিছুদিন আগে আমার এক সহকর্মী নারীকে নীরবে চোখের জল ফেলতে দেখে আমি জানতে চেয়েছিলাম, কেন তাঁর সেই কান্না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আট বছর ধরে বাড়িতে বসবাস করা বিড়ালের মৃত্যুতে বিষণ্নতায় তিনি আক্রান্ত এবং নীরব কান্না তাঁর জন্য হচ্ছে সেই বেদনার বোঝা লাঘবের জুতসই পথ। বিড়ালের মৃত্যুতে কান্না অদ্ভুত শোনালেও সেই কান্নাও তো হচ্ছে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেখা দেওয়া বিচ্ছেদে বেদনাহত হওয়ার প্রকাশ। জন্মালে মরতে হবে—শৈশবের সেই বোধোদয়ের সময় থেকেই কথাটা জানা থাকলেও মৃত্যুভয়ে অনেকেই আমরা তাড়িত এবং আপনজনের মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে আমরা অপারগ। পরিচিত সবার মৃত্যুই যে আবার আমাদের মনকে বিষণ্নতায় ভরিয়ে দেয়, তা তো নয়। এমন মৃত্যুও তো আছে, যে মৃত্যুসংবাদে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি, মনে হয় ভারী এক পাথর বুঝি গড়িয়ে নেমে গেছে অতলে, আর আমাদের তা করে দিয়ে গেছে ভারমুক্ত।
বাঙালি জাতিসত্তার এ-যুগের কলঙ্কিত মোশতাক আহমদের মৃত্যুর বিষয়টি একবার ভেবে দেখুন, তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে মৃত্যু কখনো কখনো আমাদের শঙ্কামুক্তও করে থাকে। বিড়ালের মৃত্যুতে অঝোর ধারায় চোখের জল ফেলা আর একজন মানুষের মৃত্যুতে ভারমুক্ত বোধ করা—এ যেন আমাদের বৈচিত্র্যভরা মানবজীবনেরই চমত্কার প্রতিফলন। এর পরও বলতে হয়, সব মানুষই ইতিহাসের খলনায়কের মতো তেমন দুর্ভাগা নয়। আর তাই মানুষের চলে যাওয়ায় বেদনাহত হওয়াটাই মানবের সহজাত ধর্ম। তবে যে প্রশ্ন থেকে যায় তা হলো, মৃত্যুতে মনোবেদনায় ভরিয়ে তোলার মতো কাছের মানুষ হয়ে উঠতে ঠিক কতটা সময়ের দরকার? সাম্প্রতিক একটি মৃত্যুর ঘটনায় প্রশ্নটি আবারও আমার মনে দেখা দিয়েছে এবং প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি।

দুই.
স্যাম নোদা নামের মানুষটি কিছুটা খাটো হলেও ছিলেন বিশাল দেহী। আগে বার কয়েক প্রেসক্লাবে দেখা-সাক্ষাত্ হলেও আলাপ মোটেও হয়নি, আর তাই আমার অপরিচিতই তিনি থেকে গিয়েছিলেন। তবে প্রেসক্লাবের নির্বাচনে সভাপতি পদে আমি জয়লাভ করার কিছুদিন পর তিনি কাছে এসে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, সময় আর সুযোগ হলে আমি যেন তাঁর সঙ্গে একদিন কথা বলি। প্রথম সেই আলাপের আন্তরিকতাতেই আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি, বিশাল দেহের সেই মানুষটির ভেতর রয়ে গেছে খুবই বিনয়ী আর কোমল এক ব্যক্তিত্ব। সে রাতে বাড়ি ফিরে তাঁর ই-মেইল আমি পাই, যেখানে আবারও তিনি বলতে ভোলেননি যে, আমার সঙ্গে তাঁর কিছু কথা আছে। ফলে ই-মেইল আদান-প্রদানে সাক্ষাতের একটি সময় আমরা অচিরেই ঠিক করে ফেলি।
আমার ধারণা ছিল, ক্লাবের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর ব্যক্তিগত রেষারেষি থেকে দেখা দেওয়া ছোটখাটো কিছু সমস্যার সমাধানে পথনির্দেশিকা তিনি হয়তো আমাকে দেখিয়ে দেবেন। তিনি যে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ক্লাবের সদস্য, তা আমি আগেই জানতে পেরেছি। অন্যদিকে আমার নিজের ক্লাব-জীবনের স্থায়িত্ব হচ্ছে এর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ।
নির্দিষ্ট দিনে ক্লাবে আমাদের পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাতের শুরুতেই তিনি বলেছিলেন, প্রায় আট বছর আগে জাপানের এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক সংকলনে আমার যে লেখা ছাপা হয়েছিল, সেটা তিনি পড়েছেন এবং জাপানের সঙ্গে বঙ্গভূমির সম্পর্কের অতীত ইতিহাসের অনেক কিছু এর মধ্য দিয়ে তিনি জানতে পেরেছেন। আলাপচারিতার শুরুতেই এ-রকম এক প্রশংসাসূচক অভিমত শুনে যতটা না আনন্দিত হয়েছিলাম, বরং সেটা তার চেয়ে বেশি আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। আমার সেই আট বছর আগের রচনায় যে এমন এক গুণমুগ্ধ পাঠক থেকে থাকতে পারে, সেই চিন্তা আমার মাথায় একেবারেই ছিল না। আর সে-কারণেই আমার অবাক হওয়া।
সেদিনের সেই প্রথম দীর্ঘ আলাপে অনেক কথা আমরা বলে থাকলেও ক্লাব প্রসঙ্গে কোনো রকম মন্তব্য নোদা সাহেব একেবারেই করেননি। বরং আরও তিনি যা বলেছিলেন তা হলো, তাঁর এক স্কুল সহপাঠী বর্তমানে প্রামাণ্য ছবি তৈরিতে জড়িত এবং ছবি তৈরির কাজে বাংলাদেশে সেই নারী একাধিকবার গেছেন। ফলে আমি যেন সেই নারীর সঙ্গে অবশ্যই যোগাযোগ করি। কেননা সুন্দরবনের ওপর যে চমত্কার ছবি তিনি তৈরি করেছেন, সেটা আমার অবশ্যই দেখা উচিত।
সেদিনের সেই সাক্ষাতের পর দৈনন্দিন জীবনের কর্মব্যস্ততায় আমি আবারও জড়িয়ে পড়ি। যথারীতি ভুলে গিয়েছিলাম নোদা সাহেবের দেওয়া ঠিকানায় বাংলাদেশের ওপর ছবি তৈরি করা নারীর সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করতে। তবে আমি ভুলে গেলেও হঠাত্ পরিচয়ে আমার বন্ধু হয়ে ওঠা জাপানি ভদ্রলোক কিন্তু ভুলে যাননি তাঁর দায়িত্ববোধের কথা।
কিসের যেন এক তাড়া স্যাম নোদা অনুভব করেছিলেন, যা বুঝে ওঠার সাধ্য আমার ছিল না। আমি কেবল অবাক হয়ে দেখছিলাম, কতটা আপনজনের মতো আমাকে খুশি করায় তিনি ব্যস্ত—কোনো রকম প্রতিদানের বিনিময়ে তা নয়, বরং স্রেফ নতুন হয়ে যাওয়া বন্ধুত্বের খাতিরে। এ ছাড়া প্রতিদান দেওয়ার মতো অবস্থানে আমি তো মোটেও নেই। স্যাম নোদা দীর্ঘদিন জাপানের নেতৃস্থানীয় একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন নির্বাহী পদে চাকরি করেছেন, চাকরিসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন জীবনের বড় একটা সময় এবং সেখানে একটি অঙ্গরাজ্যের গভর্নরের উপদেষ্টা পদেও নিয়োজিত ছিলেন। ফলে আমার কাছ থেকে প্রাপ্তির কোনো প্রত্যাশা তাঁর থাকার কথা নয় এবং তা ছিলও না।
এর মধ্যেই এক রাতে তাঁর পাঠানো ই-মেইলে আমি জানতে পারি, স্কুলের সেই সহপাঠী বন্ধুকে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ক্লাবে আসতে রাজি করিয়েছেন এবং ক্যানসারের চিকিত্সার জন্য সামনের কয়েকটি দিন তাঁকে হাসপাতালে কাটাতে হবে বলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই বন্ধুকে নিয়ে তিনি ক্লাবে আসবেন। সেই প্রথম আমার জানার সুযোগ হয় যে, ক্যানসারের মতো মারাত্মক এক অসুখে তিনি ভুগছেন। অথচ সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকা অত্যন্ত বিনয়ী ও অমায়িক সেই মানুষটি দেখে কিন্তু বুঝে ওঠার কোনোই উপায় নেই যে, মরণ এক ব্যাধি তাঁর দেহে বাসা বেঁধে বসে আছে।
হাসপাতাল থেকেই আরেকটি ই-মেইল কয়েক দিন পর তিনি আমাকে পাঠান। যেখানে উল্লেখ ছিল, সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখে হাসপাতাল থেকে তিনি ছাড়া পাচ্ছেন এবং আমার সময় হলে ১৭ তারিখ দুপুরে বন্ধুকে নিয়ে তিনি ক্লাবে আসবেন। এবার অবশ্য দেরি না করে তাঁকে আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম, সময় আমার হবে এবং টোকিওতে অবস্থানরত বাংলাদেশি চলচ্চিত্রনির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলকেও আমি ওই নারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আগ্রহী। আমার সেই প্রস্তাবে খুবই খুশি হয়েছিলেন স্যাম নোদা। এরপর কথামতো সেপ্টেম্বর মাসের ১৭ তারিখ দুপুরে আমরা আলোচনায় বসি।
স্যাম নোদা সেদিন কিছুটা আগেই চলে এসেছিলেন এবং আমাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় বসেছিলেন। নানা রকম কথাবার্তায় তাঁর বিচিত্র জীবন সম্পর্কেই কেবল আমরা জানতে পারিনি, শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেছেন। এবং বলেছিলেন, চিকিত্সা-প্রক্রিয়া ভালোভাবেই এগিয়ে চলেছে, যদিও খাওয়া-দাওয়ার আগ্রহ তিনি একেবারেই হারিয়ে ফেলছেন। একইভাবে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে ক্ষুধার অনীহা দেহের ওজন হ্রাসে অবশ্যই সহায়ক হবে বলে খুব একটা উদ্বিগ্ন এতে তিনি নন। আমাদের আলাপ চলতে থাকার মুখে যথাসময়ে সেখানে এসে উপস্থিত হন স্যাম নোদার স্কুলজীবনের সহপাঠী, প্রামাণ্য ছায়াছবির নির্মাতা ইওকো মিউরা। সঙ্গে তিনি নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের ওপর তৈরি তাঁর দুটি ছবির ডিভিডি। আমাদের হাতে সেই ডিভিডি তুলে দেওয়ার সময় তৃপ্তির এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছিল স্যাম নোদার মুখজুড়ে। তানভীর মোকাম্মেল সুন্দরবনের ওপর তাঁর নিজের তৈরি প্রামাণ্য ছবির একটি কপি জাপানি চলচ্চিত্রনির্মাতাকে দিয়ে স্যাম নোদাকেও সেই ছবি দেখার অনুরোধ করেছিলেন। নোদা সাহেব বলেছিলেন, ছবিটি যে তিনি কেবল দেখবেন তা-ই নয়, সময় হলে আর শরীরে কুলালে অচিরেই বাংলাদেশ ভ্রমণেও তিনি যাবেন। ইওকো মিউরা যখন তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছিলেন বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিকতার কথা, তা শুনে স্যাম নোদার বাংলাদেশ ভ্রমণের ইচ্ছা তখন যেন আরও প্রবল হয়ে ওঠে, যা আমরা লক্ষ করি।
স্যাম নোদাকে পছন্দ হয়েছিল তানভীর মোকাম্মেলেরও। আর তাই বিদায় নেওয়ার আগে তানভীর বলেছিলেন, আগে থেকে সময় ঠিক করে নিয়ে সামনের কোনো একদিন দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে তিনি আগ্রহী। নোদা সাহেবও খুশি হয়েছিলেন সেই প্রস্তাবে। আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আবারও সাক্ষাতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এরপর ধীরে বার থেকে বের হয়ে যান বিশাল দেহের নরম মনের সেই মানুষটি।

তিন.
তানভীর মোকাম্মেল আমাকে বলেছিলেন, দেশে ফিরে যাওয়ার আগে আবারও স্যাম নোদার সাক্ষাতের অপেক্ষায় তিনি থাকবেন। ভদ্রলোক যেন গল্প-উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক চরিত্র; যাঁর সাহচর্য মনে করিয়ে দেয়, আমাদের এই পৃথিবী এখনো ভালো মানুষহীন হয়ে যায়নি।
কাজের চাপে সাক্ষাতের তারিখ ঠিক করে নেওয়ার বিষয়টি আমি ভুলে গেলেও তানভীর একসময় আমাকে সেটা মনে করিয়ে দিলে নোদা সাহেবকে যে ই-মেইল পাঠাতে হবে, তা আমি টুকে রেখেছিলাম। এর ঠিক পরদিন সকালে ক্লাবে গিয়ে আমার মেইলবক্সে রাখা একটি বার্তা আমি খুঁজে পাই। ইওকো মিউরা নন, অন্য এক নারী এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে এবং আমাকে না পেয়ে সেই চিরকুট তিনি রেখে যান; যেখানে লেখা ছিল ‘আপনি নিশ্চয় শুনে বেদনাহত হবেন যে এ মাসের ১৯ তারিখে স্যাম নোদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’
চোখ আমার সহসাই ভিজে আসছিল এবং আমি ছুটে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলাম ঘরের অন্য এক প্রান্তে, যেখানে কেউ দেখবে না আমার চোখের জল ধরে রাখার প্রয়াস। তারিখের হিসাব বলে দেয়, আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার ঠিক দুই দিন পর সবকিছু ছেড়ে চলে গেছেন স্যাম নোদা। বিদায়ের আঁচ আগে থেকে করতে পেরেছিলেন বলেই কোনো এক তাড়ায় তিনি ভুগছিলেন কি? প্রশ্নের উত্তর জানা নেই আমার। তানভীরকে তখনই আমি ফোনে জানিয়ে দিই সেই দুঃসংবাদ। তানভীরও বাকহীন হয়ে পড়েছিলেন এবং আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি, চোখ দুটি তাঁরও ভিজে আসছিল এমন এক সুহূদ-বন্ধুকে স্মরণ করে, যাঁর সঙ্গে আমার নিজের পরিচয় মাস দুয়েকের, আর তানভীরের যাঁর সান্নিধ্যে আসা সাকুল্যে মাত্র একবার।
বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় কোনো বন্ধন নয়, যদি সেখানে থাকে আন্তরিকতা আর হূদয়ের উষ্ণতা। সে কথাটাই আবারও আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে একরাশ বেদনার বোঝা পেছনে রেখে চলে গেলেন আমাদের সেই নতুন বন্ধু। এখন হয়তো দূরে কোথাও আকাশ থেকে চোখ মেলে তিনি দেখছেন সবুজ চাদরে ঢাকা এক দেশ আর মায়াবী সুন্দরবন—প্রবল ইচ্ছা মনে থেকে যাওয়া সত্ত্বেও যেখানে যাওয়ার সময় তিনি করে উঠতে পারেননি।
টোকিও, ৫ অক্টোবর, ২০০৯
মনজুরুল হক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.