ক্যামেলিয়া আছেই -স্মরণ by সুমনা শারমীন
ডাক্তারভীতি ছিল তাঁর। সেই ভীতি ভাঙালেন যে ডাক্তার, তাঁর চেম্বারেই পড়ে গিয়েছিলেন ক্যামেলিয়া। গত বছর এই ১৯ অক্টোবরেই। অতঃপর ল্যাবএইড হাসপাতাল। চিকিত্সকদের শেষ চেষ্টা এবং ক্যামেলিয়া পারভীনের চলে যাওয়া।
আমাদের ক্যামেলিয়া আপা। চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে বিএফএ এবং এমএফএ পাস করেছিলেন। চমত্কার গান গাইতেন। রংপুরে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। সে সময় রংপুর বেতারে শিশুশিল্পী হিসেবে গানও করতেন। খুব ভালো ব্যাডমিন্টনও খেলতেন। শুনেছি ক্যামেলিয়া আপার মা (গুলনাহার হামিদ) এবং মামাও (১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত কর্নেল জামিল) গান করতেন। কিন্তু যখনই বলেছি, ‘ক্যামেলিয়া আপা, একটা গান করেন না,’ মৃদু হেসে বলতেন, ‘আরে ধুর! আমি না। আমার বোন (কুমকুম মীর্জা) ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়।’ বাবা আবদুল হামিদ মৃধা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা।
ক্যামেলিয়া আপা চলে যাওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে আমরা একসঙ্গে বেড়াতে গেলাম কুমিল্লার বার্ডে। ক্যামেলিয়া আপার সেজো ভাই তখন সেখানকার মহাপরিচালক। চার ভাই চার বোনের মধ্যে ক্যামেলিয়া আপাই সবচেয়ে ছোট। বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি, ছোট বোনটা ছিল খুবই আদরের ‘রত্না’। একসঙ্গে ঘুরে দেখেছি ময়নামতি বৌদ্ধবিহার, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরও রয়েছে বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন। ক্যামেলিয়া আপা বললেন, ‘কুটিলা মুড়াটা তোমরা অবশ্যই দেখবা। চমত্কার।’ আমরা একে-তাকে জিজ্ঞেস করে বার-কয়েক গাড়ির পাক খেয়ে খুুঁজে পেলাম কুটিলা মুড়া। গাড়িতে উঠে সবাই ধন্যবাদ দিচ্ছে ক্যামেলিয়া আপাকে, ‘আপনি না বললে দেখা হতো না।’
ক্যামেলিয়া এসএসসি পাস করেছিলেন এই কুমিল্লা থেকেই। মা মারা যান ১৯৮৬ সালে, তখন ক্যামেলিয়া চারুকলার ছাত্রী। ১৯৯০ সালে ক্যামেলিয়ার বিয়ে হয় শিশিরের সঙ্গে। শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য। আর ১৯৯৬ সালে জন্ম নেয় তাঁদের আদরের মেয়ে শ্রাবন্তী। ঢাকা শহরের কোনো গ্যালারিতে চলছে কোনো শিল্পীর প্রদর্শনী, চারুকলায় হচ্ছে বৈশাখের আয়োজন, অবধারিতভাবেই পাওয়া যাবে তিনজন মানুষকে—শিশির, ক্যামেলিয়া, শ্রাবন্তী।
একবার এক শীতে চার পরিবার মিলে গেলাম বেড়াতে সিলেটের লাউয়াছড়ায়। শিশিরভেজা শীতের সকালে সবাই কম্বল জড়িয়ে বাংলোর বারান্দায় এসে কুয়াশা দেখছে। ক্যামেলিয়া আপাও উঠে এলেন। দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে ধপাস! দলের একজন রসবোধসম্পন্ন সঙ্গী বলে উঠল, সকাল থেকে কত শিশির পড়ল কোনো শব্দ নেই, ক্যামেলিয়া একবার পড়ল তাতেই কত শব্দ!
হাসির রোল উঠল। ক্যামেলিয়ার শুধু নিঃশব্দ হাসি। কী আশ্চর্য! ক্যামেলিয়া আপা চলে যাওয়ার আগে আমি কখনো ক্যামেলিয়া ফুলের গাছ দেখিনি। তাঁর মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর আমরা ১৩ জনের বড় একটি দল গেলাম শিলং, চেরাপুঞ্জি। শ্রাবন্তী, শিশিরদা সঙ্গেই। টাকা ভাঙাতে ব্যাংকে যাচ্ছি—শিশিরদা শ্রাবন্তীকে দেখায়, ‘এই দ্যাখ, এটাই ক্যামেলিয়া গাছ।’
রবীন্দ্রনাথের বাড়ি জিত্ভূমিতে ঢুকছি, গেটের পাশেই ক্যামেলিয়া গাছ। যেন ক্যামেলিয়া আপাও ছিলেন আমাদের সঙ্গে।
ক্যামেলিয়া আপাকে কতজন বলেছে, ছবি আঁকছেন না কেন, কাজ করেন, কাজ জমান, প্রদর্শনী করেন। তাঁর ওই এক কথা, ‘সময় পাই না, শ্রাবন্তীর পড়াশোনা দেখতে হয় যে!’ অথচ আজ বিকেল পাঁচটায় ঢাকার গ্যালারি চিত্রকে ক্যামেলিয়ার পরিবারের সদস্যারা, বন্ধুবান্ধব—সবাই যখন একসঙ্গে হবে ক্যামেলিয়ারই জন্য, তখন সেখানে স্থান পাবে ক্যামেলিয়ার কিছু চিত্রকর্ম। সেই তো হলো, শুধু ক্যামেলিয়া নেই। ক্যামেলিয়ার বন্ধু ছোটনা কিংবা জেমরিনা ভুলতে পারেন না ক্যামেলিয়ার কথা। ক্যামেলিয়াকে নিয়ে জেমরিনার লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন কৃষ্ণকলি। ক্যামেলিয়া আছেই।
ক্যামেলিয়া আপা, আপনি যে শ্রাবন্তীর লেখাপড়া নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকতেন, দুশ্চিন্তায় থাকতেন, সেই শ্রাবন্তী শিলংয়ের একটি বোর্ডিং স্কুলে পরীক্ষায় প্রথম তিনজনের মধ্যে একজন হয়েছে। সেই শ্রাবন্তী গোটা স্কুলের মধ্যে ছবি আঁকায় দ্বিতীয় হয়েছে। নির্ভুল বানানে বাবাকে চিঠি দিয়েছে, তাও আবার ইংরেজিতে...।
এ কথা শুনে ক্যামেলিয়া আপা নিঃশব্দ হাসছেন আর বলছেন তাঁর চিরচেনা ভঙ্গিতে—তোমরা তো ভাবো সব এমনি এমনি হয়ে যায়। আমি তো শ্রাবন্তীর সঙ্গে থাকি ছায়ার মতো...তাই তো! শিলংয়ের ওই বোর্ডিং স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকেই তো দেখা মেলে ক্যামেলিয়া গাছের...
আমাদের ক্যামেলিয়া আপা। চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে বিএফএ এবং এমএফএ পাস করেছিলেন। চমত্কার গান গাইতেন। রংপুরে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। সে সময় রংপুর বেতারে শিশুশিল্পী হিসেবে গানও করতেন। খুব ভালো ব্যাডমিন্টনও খেলতেন। শুনেছি ক্যামেলিয়া আপার মা (গুলনাহার হামিদ) এবং মামাও (১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত কর্নেল জামিল) গান করতেন। কিন্তু যখনই বলেছি, ‘ক্যামেলিয়া আপা, একটা গান করেন না,’ মৃদু হেসে বলতেন, ‘আরে ধুর! আমি না। আমার বোন (কুমকুম মীর্জা) ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়।’ বাবা আবদুল হামিদ মৃধা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা।
ক্যামেলিয়া আপা চলে যাওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে আমরা একসঙ্গে বেড়াতে গেলাম কুমিল্লার বার্ডে। ক্যামেলিয়া আপার সেজো ভাই তখন সেখানকার মহাপরিচালক। চার ভাই চার বোনের মধ্যে ক্যামেলিয়া আপাই সবচেয়ে ছোট। বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি, ছোট বোনটা ছিল খুবই আদরের ‘রত্না’। একসঙ্গে ঘুরে দেখেছি ময়নামতি বৌদ্ধবিহার, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরও রয়েছে বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন। ক্যামেলিয়া আপা বললেন, ‘কুটিলা মুড়াটা তোমরা অবশ্যই দেখবা। চমত্কার।’ আমরা একে-তাকে জিজ্ঞেস করে বার-কয়েক গাড়ির পাক খেয়ে খুুঁজে পেলাম কুটিলা মুড়া। গাড়িতে উঠে সবাই ধন্যবাদ দিচ্ছে ক্যামেলিয়া আপাকে, ‘আপনি না বললে দেখা হতো না।’
ক্যামেলিয়া এসএসসি পাস করেছিলেন এই কুমিল্লা থেকেই। মা মারা যান ১৯৮৬ সালে, তখন ক্যামেলিয়া চারুকলার ছাত্রী। ১৯৯০ সালে ক্যামেলিয়ার বিয়ে হয় শিশিরের সঙ্গে। শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য। আর ১৯৯৬ সালে জন্ম নেয় তাঁদের আদরের মেয়ে শ্রাবন্তী। ঢাকা শহরের কোনো গ্যালারিতে চলছে কোনো শিল্পীর প্রদর্শনী, চারুকলায় হচ্ছে বৈশাখের আয়োজন, অবধারিতভাবেই পাওয়া যাবে তিনজন মানুষকে—শিশির, ক্যামেলিয়া, শ্রাবন্তী।
একবার এক শীতে চার পরিবার মিলে গেলাম বেড়াতে সিলেটের লাউয়াছড়ায়। শিশিরভেজা শীতের সকালে সবাই কম্বল জড়িয়ে বাংলোর বারান্দায় এসে কুয়াশা দেখছে। ক্যামেলিয়া আপাও উঠে এলেন। দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে ধপাস! দলের একজন রসবোধসম্পন্ন সঙ্গী বলে উঠল, সকাল থেকে কত শিশির পড়ল কোনো শব্দ নেই, ক্যামেলিয়া একবার পড়ল তাতেই কত শব্দ!
হাসির রোল উঠল। ক্যামেলিয়ার শুধু নিঃশব্দ হাসি। কী আশ্চর্য! ক্যামেলিয়া আপা চলে যাওয়ার আগে আমি কখনো ক্যামেলিয়া ফুলের গাছ দেখিনি। তাঁর মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর আমরা ১৩ জনের বড় একটি দল গেলাম শিলং, চেরাপুঞ্জি। শ্রাবন্তী, শিশিরদা সঙ্গেই। টাকা ভাঙাতে ব্যাংকে যাচ্ছি—শিশিরদা শ্রাবন্তীকে দেখায়, ‘এই দ্যাখ, এটাই ক্যামেলিয়া গাছ।’
রবীন্দ্রনাথের বাড়ি জিত্ভূমিতে ঢুকছি, গেটের পাশেই ক্যামেলিয়া গাছ। যেন ক্যামেলিয়া আপাও ছিলেন আমাদের সঙ্গে।
ক্যামেলিয়া আপাকে কতজন বলেছে, ছবি আঁকছেন না কেন, কাজ করেন, কাজ জমান, প্রদর্শনী করেন। তাঁর ওই এক কথা, ‘সময় পাই না, শ্রাবন্তীর পড়াশোনা দেখতে হয় যে!’ অথচ আজ বিকেল পাঁচটায় ঢাকার গ্যালারি চিত্রকে ক্যামেলিয়ার পরিবারের সদস্যারা, বন্ধুবান্ধব—সবাই যখন একসঙ্গে হবে ক্যামেলিয়ারই জন্য, তখন সেখানে স্থান পাবে ক্যামেলিয়ার কিছু চিত্রকর্ম। সেই তো হলো, শুধু ক্যামেলিয়া নেই। ক্যামেলিয়ার বন্ধু ছোটনা কিংবা জেমরিনা ভুলতে পারেন না ক্যামেলিয়ার কথা। ক্যামেলিয়াকে নিয়ে জেমরিনার লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন কৃষ্ণকলি। ক্যামেলিয়া আছেই।
ক্যামেলিয়া আপা, আপনি যে শ্রাবন্তীর লেখাপড়া নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকতেন, দুশ্চিন্তায় থাকতেন, সেই শ্রাবন্তী শিলংয়ের একটি বোর্ডিং স্কুলে পরীক্ষায় প্রথম তিনজনের মধ্যে একজন হয়েছে। সেই শ্রাবন্তী গোটা স্কুলের মধ্যে ছবি আঁকায় দ্বিতীয় হয়েছে। নির্ভুল বানানে বাবাকে চিঠি দিয়েছে, তাও আবার ইংরেজিতে...।
এ কথা শুনে ক্যামেলিয়া আপা নিঃশব্দ হাসছেন আর বলছেন তাঁর চিরচেনা ভঙ্গিতে—তোমরা তো ভাবো সব এমনি এমনি হয়ে যায়। আমি তো শ্রাবন্তীর সঙ্গে থাকি ছায়ার মতো...তাই তো! শিলংয়ের ওই বোর্ডিং স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকেই তো দেখা মেলে ক্যামেলিয়া গাছের...
No comments