বিলুপ্তির পথে ঐতিহাসিক নিদর্শন -সংরক্ষণ by এম সাখাওয়াত হোসেন
গত ২ অক্টোবর প্রথম আলোতে একটি বিশেষ প্রতিবেদন ‘বিলুপ্তির পথে ঐতিহাসিক বড় কাটরা’ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর আরও কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা একই বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমনকি কয়েকটি চ্যানেলও বিশেষভাবে ঢাকার বড় কাটরার ওপর প্রতিবেদন দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে। এসব প্রতিবেদন ছিল সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি যত্নবান প্রতিটি মানুষকে নাড়া দেওয়ার মতো। প্রতিবেদন পড়ে এবং টেলিভিশনের পর্দায় দেখে অন্তত আমি তাগিদ বোধ করি, পুরান ঢাকার চকবাজারের ছোট কাটরা ও বড় কাটরা দেখার জন্য। আমার মনে হয়েছিল, সত্যিই যদি অদূর ভবিষ্যতে এ স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ দখলের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে আমার আফসোস থেকে যাবে, আমি এ দুটি স্থাপনা অতীতে চেষ্টা করেও দেখতে পারিনি। অতঃপর পুরান ঢাকার একসময়ের বাসিন্দা, যার আদি বাড়ি এখনো ওই স্থানে রয়েছে, আমার বিশেষ বন্ধু শিল্পপতি আমানউল্লার সৌজন্যে ৯ অক্টোবরে এ দুটি স্থাপনা দেখতে যাই।
এই ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখার আমার আগ্রহ একটু বাড়তি ছিল। কারণ চার মাস আগে ভারতের ১৫তম লোকসভার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে মোগলদের রাজধানী শহরদ্বয় আগ্রা ও দিল্লির ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার সুযোগ হয়েছিল। সফর শেষে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ আর ভ্রমণের ওপর ভিত্তি করে একটি পুস্তকের পাণ্ডুলিপিও শেষ করেছি। হয়তো আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করতে পারব। পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতে গিয়ে আমাকে উপমহাদেশের ইতিহাসের ওপর রচিত বেশ কিছু বই পুস্তক, ম্যাগাজিন আর গাইড বই পড়তে হয়েছে। আগ্রার তাজমহল, আগ্রা ও দিল্লির দুর্গ, শাহজাহানাবাদ দেখার অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে ইতিহাসের পাতার কিছু অংশ আলোচনা করেছি। ওই আলোচনায় স্বভাবতই উঠে এসেছে সম্রাট শাহজাহান আর তাঁর চার পুত্র, দারাশিকো, শাহ সুজা, আওরঙ্গজেব আর মুরাদের নাম। সঙ্গে আলোচনা করেছি শাহজাদী জাহানারা আর রওশন আরার উপাখ্যান। আলোচনা করেছি সম্রাট শাহজাহানের জীবনের শেষাংশের দুঃখময় দিনগুলোর কথা। আলোচনা করেছি দিল্লির তথা আগ্রার মসনদ দখলের প্রচেষ্টায় রত শাহজাহানের চার পুত্র আর দুই কন্যার সংঘাতের বিষয়টি। ওই আলোচনায় উল্লিখিত হয়েছে তত্কালীন বাংলার সুবেদার বা গভর্নর, শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজার কথা।
আমি একপর্যায়ে তত্কালীন মোগল বাংলার রাজধানী ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগরের ঐতিহাসিক দলিলের খোঁজে আগারগাঁওয়ে স্থিত জাতীয় আর্কাইভেও গিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত সেখানে যেসব নথিপত্র রয়েছে তার সময়কাল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৩২ খ্রিষ্টাব্দ-উত্তর। মোগল বাংলার নথিপত্র নেই। হয়তো দিল্লির ভারতীয় জাতীয় আর্কাইভে আছে। এমনটা আমার কাছে মনে হওয়ার কারণ, ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পলের লাস্ট মোগল পড়ে জানলাম, দিল্লিতেই মোগল দরবারের নথিপত্র সংরক্ষিত আছে। মোগলদের সময়ের ঢাকার ওপরে লেখা মুনতাসীর মামুনের ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-এর প্রথম খণ্ডে এ দুটি স্থাপনা সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। আরও তথ্য পাওয়া যায় ঐতিহাসিক জে এন সরকার আর আব্দুল করিম সাহেবের লেখায়।
যা-ই হোক, চকবাজারের বড় কাটরার সঙ্গে শাহ সুজার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন মারফত পাঠকেরা জেনেছেন। শাহ সুজা মাঝের কিছু সময় ছাড়া ১৬৩৯ থেকে ১৬৬০ পর্যন্ত এ অঞ্চলের সুবাদার ছিলেন। তিনি বোধ করি একমাত্র মোগল শাহজাদা যিনি সরাসরি সুবে বাংলা শাসন করেছিলেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল এ সুরম্য ভবন, যার নির্মাণশৈলী সম্পূর্ণভাবে ইন্দো-ইসলামিক-মোগল স্থাপনার বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। একই ধরনের নির্মাণশৈলীর বহু নিদর্শন রয়েছে মূলত লাহোর, আগ্রা আর দিল্লিতে। এসব দেখতে আমরা বহু কসরত করে বহু অর্থের বিনিময়ে এসব শহর ভ্রমণ করি, অথচ উপমহাদেশের মোগল শাসকদের সবচেয়ে পূর্ব প্রান্তের মোগল শহর ঢাকায় এসব স্থাপনা সহজে দেখা সম্ভব হয় না। এখন হাতে গোনা যা ছিল সেগুলোও বিলুপ্তির পথে। এগুলো রয়েছে হয়তো অবৈধ দখলদারদের কবলে অথবা ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে দখল বৈধ করার প্রয়াসে।
শাহ সুজার পরাস্ত জীবনের শেষাংশও রচিত হয়েছিল এ পথেই। তিনি দিল্লিতে মসনদের দাবিদার হয়ে ঢাকা থেকেই বুড়িগঙ্গার পথে রওনা হয়ে প্রথমে দারাশিকোর বাহিনীর হাতে, পরে আওরঙ্গজেবের হাতে দারার পরাজয় ও প্রাণনাশের পর, ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর প্রদেশের যুদ্ধে শেষবারের মতো পরাজিত হন। ওই যুদ্ধে পরাজয়ের পর শাহ সুজা তাঁর পরিবার ও অনুসারীদের নিয়ে পুনরায় বাংলায় ফিরে আসেন। তবে তিনি সুবে বাংলায় আর আধিপত্য কায়েম করতে পারেননি। আওরঙ্গজেবের সিপাহসালার মীর জুমলার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হওয়ার আগেই তিনি ঢাকা ত্যাগ করে তত্কালীন নোয়াখালীর ভোলার নদীপথ হয়ে আরাকানের রাজধানী মরোহংয়ে পৌঁছান। তিনি ঢাকায় পৌঁছেছিলেন ১২ এপ্রিল ১৬৬০ এবং ৬ মে ১৬৬০-এ ঢাকা ত্যাগ করে ১২ মে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালীর নদীপথে আরাকানের রাজার জাহাজে চড়ে প্রথমে মক্কা শরিফ এবং পরে তুরস্কে যেতে আগ্রহী হলেও সমুদ্রের খারাপ আবহাওয়ার কারণে যেতে না পেরে অবশেষে তাঁর পরিবারসহ আরাকানের রাজার স্মরণাপন্ন হন। আরাকানেই কয়েক বছর বাস করার পর, রাজার সৈনিকদের হাতে পরিবারসহ নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরাকান রাজার উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ রয়েছে। সুজার পরিবার নিহত হওয়ার পর তাঁর কিছু অনুসারী আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন। হয়তো তাঁদের বংশধররা এখনো আরাকানেই আছেন।
যেহেতু বড় কাটরার ইতিহাস শাহ সুজার জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সে কারণেই আমি যত্সামান্য পটভূমি আলোচনা করলাম। মুনতাসীর মামুন তাঁর রচিত পূর্বোল্লিখিত বইয়ের প্রথম খণ্ডের ১৬৫-১৬৮ পৃষ্ঠায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন বিধায় এখানে বিষদভাবে উল্লেখ করলাম না।
আমি বড় কাটরার বর্তমান অবস্থা দেখতে গিয়ে প্রবেশপথের বিশাল আকারের দরজার শীর্ষে চড়ে বুড়িগঙ্গাসহ পুরান ঢাকার এ অংশটুকু দেখেছি। অনুরূপভাবে ছোট কাটরার শীর্ষেও চড়েছিলাম। ছোট কাটরা বানিয়েছিলেন আওরঙ্গজেবের নিয়োজিত বাংলার সুবাদার মীর্জা আবু তালেব ওরফে শায়েস্তা খাঁ। তাঁর সময়কেই সুবে বাংলার স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে।
আলোচ্য দুটি স্থাপনাই এখন বিলুপ্তির পথে। এ বিলুপ্তি শুরু হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে, উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ নামে খ্যাত সিপাহি বিদ্রোহের পর হতে। তত্কালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং উপমহাদেশ থেকে মুসলিম তথা মোগল ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি দিল্লির শাহজাহানাবাদ, বর্তমানের পুরান দিল্লি মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেই থেকে মোগলদের স্থাপনা, বিশেষ করে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপনা, সমাধি সৌধ, বহু মসজিদ এবং মন্দির ধ্বংস করার ইতিহাস রচিত হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো পরবর্তীকালে ব্রিটিশ-ভারত সরকার ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে বড় কাটরাকে মাদ্রাসায় পরিণত করতে হাফেজ মোহাম্মদকে দিয়ে থাকতে পারেন (প্রথম আলো, অক্টোবর ২, ২০০৯)। এখানে প্রশ্ন থাকে, মোগলদের স্থাপনা যা পর্যায়ক্রমে সরকারের হাতে থাকার কথা, তা ব্যক্তির নামে দেওয়া আইনসংগত ছিল কি না। দেওয়া হলে তার দালিলিক প্রমাণ অবশ্যই থাকবে। এ বিষয়ে হয়তো জাতীয় আর্কাইভে দলিলাদি খোঁজ করলে পাওয়া যেতেও পারে। আমি নিজেও বর্তমানের বড় কাটরার মাদ্রাসায় কয়েকজনকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করে সদুত্তর পাইনি। সবচেয়ে দুঃখজনক, যেভাবে এ এলাকা, বিশেষ করে স্থাপনাগুলো দখল হয়েছে তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। দেখলে মনে হয় দেশটি লুটপাট আর দখলদারির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। বড় কাটরার এককালের সুরম্য উঁচু দরজার ওপরের অংশে পাটাতন দিয়ে একটি কারখানা স্থাপন করা হয়েছে, যা যেকোনো সময়ে ভেঙে পড়তে পারে। এ রকম আশঙ্কার কথা আমাকে স্থানীয় জনগণই জানিয়েছে। অনেকে দুঃখ করে বলেছে, কোনো সরকারই এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখার প্রয়াস নেয়নি, অথচ অন্তত এ দুটি জায়গা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, সরকারের উচ্চপর্যায় এবং আদালতের হস্তক্ষেপে এখনো উদ্ধার করে সংস্কার করা সম্ভব। প্রয়োজনে সরকারের অনুরোধে ইউনেস্কোও এগিয়ে আসতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ পুরাকীর্তি দুটি সংরক্ষণে।
আমি ভারতের বহু শহরে বহু ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা দেখেছি এবং এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন সংস্কারের জন্য প্রচুর অর্থ জোগান দিয়েছে ইউনেস্কো। এমনকি দিল্লির বহু মোগল নিদর্শন ‘আগাখান ফাউন্ডেশন’ সংরক্ষণের জন্য অর্থায়ন করেছে। এমন একটি স্থাপনা হচ্ছে দিল্লির সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধ। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতও স্ব-উদ্যোগে বেশ কিছু বিখ্যাত নিদর্শন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এমনই একটি উদাহরণ আগ্রার তাজমহল। তাজমহলকে রাসায়নিক দূষণের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে আগ্রা থেকে সব বৃহত্ শিল্প-কারখানা সরিয়ে নিতে যে রায় উচ্চ আদালত দিয়েছিলেন তা উত্তর প্রদেশ সরকারকে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করেছে। আগ্রায় বর্তমানে কোনো ভারী শিল্প-কারাখানা নেই। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল ভারতের পরিবেশবাদীরা।
আমি কোনো ঐতিহাসিক নই, তবে ইতিহাস আমাকে সব সময়ই বিমোহিত করেছে। আমি বড় কাটরা আর ছোট কাটরার বর্তমান অবস্থা দেখে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি। এমনই নির্বোধ জাতি আমরা যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও আমরা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারছি না। মাত্র কয়েক মাস আগে পত্রিকায় পড়েছি যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শহীদ কর্নেল কাদেরের কবরের স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। আমরা জাতি হিসেবে কি এতই দীন যে আমরা আমাদের ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারব না? এগুলো দখলদারদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নীরব দর্শক-শ্রোতা হয়ে থাকব?
সত্য কথা বলতে, আমি অত্যন্ত অপরাধবোধ নিয়েই প্রথমবারের মতো এ দুটি স্থাপনা দেখতে গিয়ে নিজেকে আরও অপরাধী মনে করছি। আমার দুঃখের কারণ ছিল যে আমি নেপোলিয়ানের বিয়ার টেবিল, যে টেবিলে বসে বেলজিয়াম আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, দেখতে সুদূর জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরে এবং রাতের অন্ধকারে ‘বন’-এর অদূরে ‘রামাগামব্রিজ’ যে ব্রিজ বা পুল নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি হয়েছিল হলিউডের সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র এ ব্রিজ টু ফার দেখতে যেতে পারলাম, অথচ ঢাকায় বাস করেও ইতিপূর্বে এ দুটি ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে পারিনি। তবু সান্ত্বনা, অনেক দেরিতে হলেও সম্পূর্ণ বিলুপ্তির আগে দেখতে গিয়েছিলাম। অবশ্যই এর জন্য প্রথম আলোসহ অন্যান্য পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ধন্যবাদের দাবিদার। আমি তাদের জনসচেতনা বাড়ানোর প্রয়াসের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
যে জাতি ইতিহাস সংরক্ষণ করতে পারে না সে জাতি অনেক বেশি দীন। আমাদের ঐতিহ্য আর ইতিহাস রক্ষার দায়িত্ব যারা নিজ কাঁধে নিয়েছেন তাঁদের কাছে আমার অনুরোধ, তারা যেন এক্ষণি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন এসব স্থাপনা রক্ষার জন্য। ইতিহাস রক্ষা করার জন্য কোনো মূল্যই বেশি নয়। এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন যদি রক্ষা করতে না-ই পারা যায়, তাহলে ঢাকার ৪০০ বছর উদ্যাপন করে আমরা কতখানি লাভবান হব!
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন কমিশনার।
এই ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখার আমার আগ্রহ একটু বাড়তি ছিল। কারণ চার মাস আগে ভারতের ১৫তম লোকসভার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে মোগলদের রাজধানী শহরদ্বয় আগ্রা ও দিল্লির ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার সুযোগ হয়েছিল। সফর শেষে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ আর ভ্রমণের ওপর ভিত্তি করে একটি পুস্তকের পাণ্ডুলিপিও শেষ করেছি। হয়তো আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করতে পারব। পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতে গিয়ে আমাকে উপমহাদেশের ইতিহাসের ওপর রচিত বেশ কিছু বই পুস্তক, ম্যাগাজিন আর গাইড বই পড়তে হয়েছে। আগ্রার তাজমহল, আগ্রা ও দিল্লির দুর্গ, শাহজাহানাবাদ দেখার অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে ইতিহাসের পাতার কিছু অংশ আলোচনা করেছি। ওই আলোচনায় স্বভাবতই উঠে এসেছে সম্রাট শাহজাহান আর তাঁর চার পুত্র, দারাশিকো, শাহ সুজা, আওরঙ্গজেব আর মুরাদের নাম। সঙ্গে আলোচনা করেছি শাহজাদী জাহানারা আর রওশন আরার উপাখ্যান। আলোচনা করেছি সম্রাট শাহজাহানের জীবনের শেষাংশের দুঃখময় দিনগুলোর কথা। আলোচনা করেছি দিল্লির তথা আগ্রার মসনদ দখলের প্রচেষ্টায় রত শাহজাহানের চার পুত্র আর দুই কন্যার সংঘাতের বিষয়টি। ওই আলোচনায় উল্লিখিত হয়েছে তত্কালীন বাংলার সুবেদার বা গভর্নর, শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজার কথা।
আমি একপর্যায়ে তত্কালীন মোগল বাংলার রাজধানী ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগরের ঐতিহাসিক দলিলের খোঁজে আগারগাঁওয়ে স্থিত জাতীয় আর্কাইভেও গিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত সেখানে যেসব নথিপত্র রয়েছে তার সময়কাল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৩২ খ্রিষ্টাব্দ-উত্তর। মোগল বাংলার নথিপত্র নেই। হয়তো দিল্লির ভারতীয় জাতীয় আর্কাইভে আছে। এমনটা আমার কাছে মনে হওয়ার কারণ, ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পলের লাস্ট মোগল পড়ে জানলাম, দিল্লিতেই মোগল দরবারের নথিপত্র সংরক্ষিত আছে। মোগলদের সময়ের ঢাকার ওপরে লেখা মুনতাসীর মামুনের ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-এর প্রথম খণ্ডে এ দুটি স্থাপনা সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। আরও তথ্য পাওয়া যায় ঐতিহাসিক জে এন সরকার আর আব্দুল করিম সাহেবের লেখায়।
যা-ই হোক, চকবাজারের বড় কাটরার সঙ্গে শাহ সুজার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন মারফত পাঠকেরা জেনেছেন। শাহ সুজা মাঝের কিছু সময় ছাড়া ১৬৩৯ থেকে ১৬৬০ পর্যন্ত এ অঞ্চলের সুবাদার ছিলেন। তিনি বোধ করি একমাত্র মোগল শাহজাদা যিনি সরাসরি সুবে বাংলা শাসন করেছিলেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল এ সুরম্য ভবন, যার নির্মাণশৈলী সম্পূর্ণভাবে ইন্দো-ইসলামিক-মোগল স্থাপনার বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। একই ধরনের নির্মাণশৈলীর বহু নিদর্শন রয়েছে মূলত লাহোর, আগ্রা আর দিল্লিতে। এসব দেখতে আমরা বহু কসরত করে বহু অর্থের বিনিময়ে এসব শহর ভ্রমণ করি, অথচ উপমহাদেশের মোগল শাসকদের সবচেয়ে পূর্ব প্রান্তের মোগল শহর ঢাকায় এসব স্থাপনা সহজে দেখা সম্ভব হয় না। এখন হাতে গোনা যা ছিল সেগুলোও বিলুপ্তির পথে। এগুলো রয়েছে হয়তো অবৈধ দখলদারদের কবলে অথবা ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে দখল বৈধ করার প্রয়াসে।
শাহ সুজার পরাস্ত জীবনের শেষাংশও রচিত হয়েছিল এ পথেই। তিনি দিল্লিতে মসনদের দাবিদার হয়ে ঢাকা থেকেই বুড়িগঙ্গার পথে রওনা হয়ে প্রথমে দারাশিকোর বাহিনীর হাতে, পরে আওরঙ্গজেবের হাতে দারার পরাজয় ও প্রাণনাশের পর, ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর প্রদেশের যুদ্ধে শেষবারের মতো পরাজিত হন। ওই যুদ্ধে পরাজয়ের পর শাহ সুজা তাঁর পরিবার ও অনুসারীদের নিয়ে পুনরায় বাংলায় ফিরে আসেন। তবে তিনি সুবে বাংলায় আর আধিপত্য কায়েম করতে পারেননি। আওরঙ্গজেবের সিপাহসালার মীর জুমলার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হওয়ার আগেই তিনি ঢাকা ত্যাগ করে তত্কালীন নোয়াখালীর ভোলার নদীপথ হয়ে আরাকানের রাজধানী মরোহংয়ে পৌঁছান। তিনি ঢাকায় পৌঁছেছিলেন ১২ এপ্রিল ১৬৬০ এবং ৬ মে ১৬৬০-এ ঢাকা ত্যাগ করে ১২ মে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালীর নদীপথে আরাকানের রাজার জাহাজে চড়ে প্রথমে মক্কা শরিফ এবং পরে তুরস্কে যেতে আগ্রহী হলেও সমুদ্রের খারাপ আবহাওয়ার কারণে যেতে না পেরে অবশেষে তাঁর পরিবারসহ আরাকানের রাজার স্মরণাপন্ন হন। আরাকানেই কয়েক বছর বাস করার পর, রাজার সৈনিকদের হাতে পরিবারসহ নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরাকান রাজার উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ রয়েছে। সুজার পরিবার নিহত হওয়ার পর তাঁর কিছু অনুসারী আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন। হয়তো তাঁদের বংশধররা এখনো আরাকানেই আছেন।
যেহেতু বড় কাটরার ইতিহাস শাহ সুজার জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সে কারণেই আমি যত্সামান্য পটভূমি আলোচনা করলাম। মুনতাসীর মামুন তাঁর রচিত পূর্বোল্লিখিত বইয়ের প্রথম খণ্ডের ১৬৫-১৬৮ পৃষ্ঠায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন বিধায় এখানে বিষদভাবে উল্লেখ করলাম না।
আমি বড় কাটরার বর্তমান অবস্থা দেখতে গিয়ে প্রবেশপথের বিশাল আকারের দরজার শীর্ষে চড়ে বুড়িগঙ্গাসহ পুরান ঢাকার এ অংশটুকু দেখেছি। অনুরূপভাবে ছোট কাটরার শীর্ষেও চড়েছিলাম। ছোট কাটরা বানিয়েছিলেন আওরঙ্গজেবের নিয়োজিত বাংলার সুবাদার মীর্জা আবু তালেব ওরফে শায়েস্তা খাঁ। তাঁর সময়কেই সুবে বাংলার স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে।
আলোচ্য দুটি স্থাপনাই এখন বিলুপ্তির পথে। এ বিলুপ্তি শুরু হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে, উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ নামে খ্যাত সিপাহি বিদ্রোহের পর হতে। তত্কালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং উপমহাদেশ থেকে মুসলিম তথা মোগল ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি দিল্লির শাহজাহানাবাদ, বর্তমানের পুরান দিল্লি মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেই থেকে মোগলদের স্থাপনা, বিশেষ করে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপনা, সমাধি সৌধ, বহু মসজিদ এবং মন্দির ধ্বংস করার ইতিহাস রচিত হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো পরবর্তীকালে ব্রিটিশ-ভারত সরকার ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে বড় কাটরাকে মাদ্রাসায় পরিণত করতে হাফেজ মোহাম্মদকে দিয়ে থাকতে পারেন (প্রথম আলো, অক্টোবর ২, ২০০৯)। এখানে প্রশ্ন থাকে, মোগলদের স্থাপনা যা পর্যায়ক্রমে সরকারের হাতে থাকার কথা, তা ব্যক্তির নামে দেওয়া আইনসংগত ছিল কি না। দেওয়া হলে তার দালিলিক প্রমাণ অবশ্যই থাকবে। এ বিষয়ে হয়তো জাতীয় আর্কাইভে দলিলাদি খোঁজ করলে পাওয়া যেতেও পারে। আমি নিজেও বর্তমানের বড় কাটরার মাদ্রাসায় কয়েকজনকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করে সদুত্তর পাইনি। সবচেয়ে দুঃখজনক, যেভাবে এ এলাকা, বিশেষ করে স্থাপনাগুলো দখল হয়েছে তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। দেখলে মনে হয় দেশটি লুটপাট আর দখলদারির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। বড় কাটরার এককালের সুরম্য উঁচু দরজার ওপরের অংশে পাটাতন দিয়ে একটি কারখানা স্থাপন করা হয়েছে, যা যেকোনো সময়ে ভেঙে পড়তে পারে। এ রকম আশঙ্কার কথা আমাকে স্থানীয় জনগণই জানিয়েছে। অনেকে দুঃখ করে বলেছে, কোনো সরকারই এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখার প্রয়াস নেয়নি, অথচ অন্তত এ দুটি জায়গা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, সরকারের উচ্চপর্যায় এবং আদালতের হস্তক্ষেপে এখনো উদ্ধার করে সংস্কার করা সম্ভব। প্রয়োজনে সরকারের অনুরোধে ইউনেস্কোও এগিয়ে আসতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ পুরাকীর্তি দুটি সংরক্ষণে।
আমি ভারতের বহু শহরে বহু ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা দেখেছি এবং এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন সংস্কারের জন্য প্রচুর অর্থ জোগান দিয়েছে ইউনেস্কো। এমনকি দিল্লির বহু মোগল নিদর্শন ‘আগাখান ফাউন্ডেশন’ সংরক্ষণের জন্য অর্থায়ন করেছে। এমন একটি স্থাপনা হচ্ছে দিল্লির সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধ। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতও স্ব-উদ্যোগে বেশ কিছু বিখ্যাত নিদর্শন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এমনই একটি উদাহরণ আগ্রার তাজমহল। তাজমহলকে রাসায়নিক দূষণের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে আগ্রা থেকে সব বৃহত্ শিল্প-কারখানা সরিয়ে নিতে যে রায় উচ্চ আদালত দিয়েছিলেন তা উত্তর প্রদেশ সরকারকে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করেছে। আগ্রায় বর্তমানে কোনো ভারী শিল্প-কারাখানা নেই। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল ভারতের পরিবেশবাদীরা।
আমি কোনো ঐতিহাসিক নই, তবে ইতিহাস আমাকে সব সময়ই বিমোহিত করেছে। আমি বড় কাটরা আর ছোট কাটরার বর্তমান অবস্থা দেখে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি। এমনই নির্বোধ জাতি আমরা যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও আমরা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারছি না। মাত্র কয়েক মাস আগে পত্রিকায় পড়েছি যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শহীদ কর্নেল কাদেরের কবরের স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। আমরা জাতি হিসেবে কি এতই দীন যে আমরা আমাদের ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারব না? এগুলো দখলদারদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নীরব দর্শক-শ্রোতা হয়ে থাকব?
সত্য কথা বলতে, আমি অত্যন্ত অপরাধবোধ নিয়েই প্রথমবারের মতো এ দুটি স্থাপনা দেখতে গিয়ে নিজেকে আরও অপরাধী মনে করছি। আমার দুঃখের কারণ ছিল যে আমি নেপোলিয়ানের বিয়ার টেবিল, যে টেবিলে বসে বেলজিয়াম আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, দেখতে সুদূর জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরে এবং রাতের অন্ধকারে ‘বন’-এর অদূরে ‘রামাগামব্রিজ’ যে ব্রিজ বা পুল নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি হয়েছিল হলিউডের সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র এ ব্রিজ টু ফার দেখতে যেতে পারলাম, অথচ ঢাকায় বাস করেও ইতিপূর্বে এ দুটি ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে পারিনি। তবু সান্ত্বনা, অনেক দেরিতে হলেও সম্পূর্ণ বিলুপ্তির আগে দেখতে গিয়েছিলাম। অবশ্যই এর জন্য প্রথম আলোসহ অন্যান্য পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ধন্যবাদের দাবিদার। আমি তাদের জনসচেতনা বাড়ানোর প্রয়াসের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
যে জাতি ইতিহাস সংরক্ষণ করতে পারে না সে জাতি অনেক বেশি দীন। আমাদের ঐতিহ্য আর ইতিহাস রক্ষার দায়িত্ব যারা নিজ কাঁধে নিয়েছেন তাঁদের কাছে আমার অনুরোধ, তারা যেন এক্ষণি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন এসব স্থাপনা রক্ষার জন্য। ইতিহাস রক্ষা করার জন্য কোনো মূল্যই বেশি নয়। এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন যদি রক্ষা করতে না-ই পারা যায়, তাহলে ঢাকার ৪০০ বছর উদ্যাপন করে আমরা কতখানি লাভবান হব!
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন কমিশনার।
No comments