ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্তির শপথ -খাদ্য অধিকার by জোবাইদা নাসরীন
‘জাতীয় ঐক্য রুখবে দারিদ্র্য’—এই স্লোগান দিয়ে এবার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য নিরসন দিবসের সূচনা। সেই সঙ্গে ১৭ অক্টোবর অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ ওই দিনটিতেই দারিদ্র্যবিরোধী সমাবেশে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার শপথ নিয়েছে গোটা দেশ। দেশে এই প্রথম এ বিষয়ে এ ধরনের একটি শপথ নেওয়া হয়। সন্দেহ নেই, শপথটি অত্যন্ত আশাপ্রদ। শপথে বলা হয়, ‘আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে শপথ করছি—ক্ষুধা, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। আমরা ক্ষুধা, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব, ক্ষুধামুক্ত জাতি গড়ব। দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সব বাধা অতিক্রম করব। যত দিন বাংলাদেশ দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত হবে না, তত দিন আমরা আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমরা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়বই।’
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৩৮ বছর। দীর্ঘ ৩৮ বছরেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছে এবং দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করতে হচ্ছে। শুধু দেশেই নয়, বাইরেও বাংলাদেশের ইমেজ উপস্থাপিত হয় ‘দরিদ্র দেশ’ হিসেবেই এবং প্রতিবছরই এই দরিদ্রদের জন্য খাদ্য ঘাটতি দূর করতে খাদ্য সাহায্য আসে বিদেশ থেকে। শুধু সরকারেই নয়, সরকারের বাইরেও বাংলাদেশে ২০ হাজারেরও অধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও এ দেশে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প হাতে নিয়ে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার চেষ্টা করছে। যত দিন ধরে চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটি হিসাব করলে সহজেই বলা যায় যে এত দিনে দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এর চিত্র উল্টো। দরিদ্রের সংখ্যা কমেনি, বরং অনেক মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে এত প্রচেষ্টা? আমরা দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছি না কেন? এই দারিদ্র্যের আসল কারণ কী? মূল সংজ্ঞায়নে আসলে কাদের দরিদ্র বলা হচ্ছে? কতভাবে মানুষ আসলে দরিদ্র হচ্ছে? এসব নানা প্রশ্ন দেখা দেওয়াই সংগত।
জাতীয় দারিদ্র্যসীমা জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখনো ৪০ শতাংশ অথবা ৬০ মিলিয়ন মানুষ দরিদ্র। তার মধ্যে ২৫ শতাংশ মাত্রাতিরিক্ত অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। এর পরের তথ্যটি আরও ভয়াবহ। ১০ শতাংশ মানুষ প্রতিবছর দুই বেলা অথবা এর চেয়ে কম খেয়ে মাসের পর মাস অতিবাহিত করে (সেন এবং হাম ২০০৬, তথ্যসূত্র http://www.chronicpoverty.org/page/chronic-poverty-in-bangladesh)| অর্থাত্ ৬০ মিলিয়ন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কোটির হিসাবে দাঁড়ায় ছয় কোটি। আমরা যদি এটিকে মানুষের অধিকার ভোগের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখি, এই হিসাবটা হলো ১০ শতাংশ মানুষ পুরোপুরিভাবেই প্রধান মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখানে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন, কোনো রাষ্ট্রেই খাদ্যের অধিকার নাগরিকদের জন্য কোনো ধরনের সাহায্য কিংবা সুযোগের বিষয় হতে পারে না। এটি মানুষের প্রথম মৌলিক অধিকার। এটিই সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। কিন্তু কেন মানুষ সেই অধিকারটুকু পাচ্ছে না, সে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা দরকার। মানুষের মৌলিক অধিকারহীনতা কোনো রাষ্ট্রের জন্য সুস্থ লক্ষণ নয় এবং সেখানে গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে।
আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় এসেছে। একটি ক্ষুধা, আরেকটি দারিদ্র্য। একটির সঙ্গে সরাসরি জড়িত মানুষের খাদ্যের মতো মৌলিক অধিকারের মতো কিছু বিষয়, এটি কখনো সাহায্য কিংবা নিরাপত্তা হতে পারে না। এগুলোর পার্থক্য বোঝা জরুরি। বিশ্বব্যাংকের ‘খাদ্য সাহায্য’ (Food Aid) কিংবা ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ (Food Security) প্যাকেজটির সঙ্গে আত্মস্থতা আসলে আমাদের এই অধিকারের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়াকেই বোঝায়। তাই অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের কারণ নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার, খাদ্য গ্রহণের অধিকার এবং খাদ্য সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকারটিই। বাংলাদেশের সব মানুষ এই অধিকারটুকু ভোগ করতে পারছে কি না, না করলে কেন করতে পারছে না, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। এবং তা জানার অধিকার সব মানুষের রয়েছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, খাদ্য সহায়তাকে উত্সাহিত না করে এর পেছনের কারণ জেনে সেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
এ বছরের স্লোগানটি ও শপথটি চমক এবং নানা কারণে নানা ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি করলেও দুঃখজনকভাবে সত্য যে এটিতে কী প্রক্রিয়ায় দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা হবে, ক্ষুধামুক্ত করা হবে, সেই বিষয়ে কোনো ধরনের দিকনির্দেশনা নেই। এই ক্ষুধামুক্তির বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ধরন এবং প্রক্রিয়ার বিষয়টিও অনুপস্থিত। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে জানা যায়, দারিদ্র্য নিরসনে তারা প্রতিটি পরিবারে একজনকে চাকরি দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিও তাদের অঙ্গীকারের অংশ। কিন্তু দারিদ্র্য তৈরির নানা কারণকে কতটা সরকার গুরুত্ব দেবে সে বিষয়টির ওপর নির্ভর করছে ক্ষুধামুক্তি এবং দারিদ্র্য মুক্তি।
নানাভাবে দারিদ্র্য তৈরি হয়। সব দারিদ্র্যকেও একভাবে দেখা যাবে না এবং শুধু অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে এটিকে ব্যাখ্যা করলে হবে না। অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে যুক্ত আছে আরও নানা কারণ। সামাজিক অসমতা এর একটি প্রধানতম কারণ। এই অসমতার উপাদান নানামুখী। মানুষের প্রতি মানুষের মর্যাদাহীনতাও একটি কারণ। দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা, সামাজিকভাবে অস্পৃশ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি, এসব মিলেই বাংলাদেশে তীব্র দারিদ্র্য তৈরি হয়েছে।
দারিদ্র্যের ফলে সবচেয়ে বেশি প্রান্তিকতার শিকার হচ্ছে কৃষি মজুররা, বিধবা নারী, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমর্থন না থাকা বয়স্ক নারী ও পুরুষ (বিশেষ করে যারা চর এলাকায় থাকে), পথশিশু, যাযাবর, নির্মাণশ্রমিক, যৌনকর্মী, অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, হরিজন, সুইপার, ঋষি, শব্দকর, কাওড়া, বেদে, প্রতিবন্ধী, হিজড়া, শরণার্থীসহ নানা মানুষ।
আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আছে, যা এ ক্ষেত্রে ভাবা প্রয়োজন। যেমন নারীর ক্ষুধামুক্তি এবং দারিদ্র্যকেও পৃথকভাবে দেখা প্রয়োজন। গৃহস্থালি খাদ্যবণ্টনের রাজনীতিতে নারীকে পুরুষের পরে খাদ্যগ্রহণ করা কিংবা সবার খাবার পর খাবার বাকি থাকলে সেটি গ্রহণ করার সামাজিক যে বোধ, তা নারীর ক্ষুধামুক্তির প্রশ্নে হুমকিমূলক। যার কারণে পুরুষের চেয়ে নারীর অপুষ্টির হার বেশি। এখানে সমাজের বৈষ্যম্যমূলক ও একপেশে পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শই সবচেয়ে বেশি দায়ী।
ঠিক একইভাবে পুরুষের দারিদ্র্যের সঙ্গে নারীর দারিদ্র্যকে একভাবে দেখলে হবে না। এ বিষয়ে আলাদা বিশ্লেষণও জরুরি। এই সংসদে যখন ৬৪ জন নারী প্রতিনিধিত্ব করেন একটি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে, সেখানে নারীর দারিদ্র্যকে ভিন্নভাবে পাঠ করা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। বলা হয়ে থাকে যে জীবন নির্বাহের সুযোগগুলো সীমিত হওয়ায় নারী হলো দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতর। এটি অন্যদিকে পুরুষের ওপর নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাকে প্রকাশ করছে। গৃহস্থালি আয় এবং ব্যয় জরিপ ২০০৫-এর তথ্য অনুসারে ২৯ দশমিক ১ শতাংশ তালাকপ্রাপ্ত এবং বিধবা নারীই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। বাংলাদেশে কৃষিভূমির মাত্র ৪ শতাংশেরও কম মালিকানা আছে নারীদের। এ থেকেই বোঝা যায়, নারীদের অবস্থা কতটুকু দরিদ্রতর। নারীর দরিদ্রতা কাটাতে না পারলে কোনোভাবেই দেশ দারিদ্র্যমুক্ত করা সম্ভব হবে না।
তবে আশার কথা হলো, এই দারিদ্র্য নিরসন দিবস থেকেই ঘোষণা এসেছে, ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে। সে লক্ষ্যেই কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। এই অল্প সময়ের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়া যাবে কি না তা আন্দাজ করা কঠিন। তবে আমরা অন্তত এটুকু আশা করি যে প্রতিটি মানুষের খাদ্যের অধিকারটুকু তার সরকারের আমলেই মানুষ ফিরে পাবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৩৮ বছর। দীর্ঘ ৩৮ বছরেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছে এবং দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করতে হচ্ছে। শুধু দেশেই নয়, বাইরেও বাংলাদেশের ইমেজ উপস্থাপিত হয় ‘দরিদ্র দেশ’ হিসেবেই এবং প্রতিবছরই এই দরিদ্রদের জন্য খাদ্য ঘাটতি দূর করতে খাদ্য সাহায্য আসে বিদেশ থেকে। শুধু সরকারেই নয়, সরকারের বাইরেও বাংলাদেশে ২০ হাজারেরও অধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও এ দেশে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প হাতে নিয়ে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার চেষ্টা করছে। যত দিন ধরে চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটি হিসাব করলে সহজেই বলা যায় যে এত দিনে দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এর চিত্র উল্টো। দরিদ্রের সংখ্যা কমেনি, বরং অনেক মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে এত প্রচেষ্টা? আমরা দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছি না কেন? এই দারিদ্র্যের আসল কারণ কী? মূল সংজ্ঞায়নে আসলে কাদের দরিদ্র বলা হচ্ছে? কতভাবে মানুষ আসলে দরিদ্র হচ্ছে? এসব নানা প্রশ্ন দেখা দেওয়াই সংগত।
জাতীয় দারিদ্র্যসীমা জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখনো ৪০ শতাংশ অথবা ৬০ মিলিয়ন মানুষ দরিদ্র। তার মধ্যে ২৫ শতাংশ মাত্রাতিরিক্ত অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। এর পরের তথ্যটি আরও ভয়াবহ। ১০ শতাংশ মানুষ প্রতিবছর দুই বেলা অথবা এর চেয়ে কম খেয়ে মাসের পর মাস অতিবাহিত করে (সেন এবং হাম ২০০৬, তথ্যসূত্র http://www.chronicpoverty.org/page/chronic-poverty-in-bangladesh)| অর্থাত্ ৬০ মিলিয়ন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কোটির হিসাবে দাঁড়ায় ছয় কোটি। আমরা যদি এটিকে মানুষের অধিকার ভোগের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখি, এই হিসাবটা হলো ১০ শতাংশ মানুষ পুরোপুরিভাবেই প্রধান মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখানে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন, কোনো রাষ্ট্রেই খাদ্যের অধিকার নাগরিকদের জন্য কোনো ধরনের সাহায্য কিংবা সুযোগের বিষয় হতে পারে না। এটি মানুষের প্রথম মৌলিক অধিকার। এটিই সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। কিন্তু কেন মানুষ সেই অধিকারটুকু পাচ্ছে না, সে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা দরকার। মানুষের মৌলিক অধিকারহীনতা কোনো রাষ্ট্রের জন্য সুস্থ লক্ষণ নয় এবং সেখানে গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে।
আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় এসেছে। একটি ক্ষুধা, আরেকটি দারিদ্র্য। একটির সঙ্গে সরাসরি জড়িত মানুষের খাদ্যের মতো মৌলিক অধিকারের মতো কিছু বিষয়, এটি কখনো সাহায্য কিংবা নিরাপত্তা হতে পারে না। এগুলোর পার্থক্য বোঝা জরুরি। বিশ্বব্যাংকের ‘খাদ্য সাহায্য’ (Food Aid) কিংবা ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ (Food Security) প্যাকেজটির সঙ্গে আত্মস্থতা আসলে আমাদের এই অধিকারের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়াকেই বোঝায়। তাই অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের কারণ নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার, খাদ্য গ্রহণের অধিকার এবং খাদ্য সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকারটিই। বাংলাদেশের সব মানুষ এই অধিকারটুকু ভোগ করতে পারছে কি না, না করলে কেন করতে পারছে না, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। এবং তা জানার অধিকার সব মানুষের রয়েছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, খাদ্য সহায়তাকে উত্সাহিত না করে এর পেছনের কারণ জেনে সেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
এ বছরের স্লোগানটি ও শপথটি চমক এবং নানা কারণে নানা ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি করলেও দুঃখজনকভাবে সত্য যে এটিতে কী প্রক্রিয়ায় দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা হবে, ক্ষুধামুক্ত করা হবে, সেই বিষয়ে কোনো ধরনের দিকনির্দেশনা নেই। এই ক্ষুধামুক্তির বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ধরন এবং প্রক্রিয়ার বিষয়টিও অনুপস্থিত। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে জানা যায়, দারিদ্র্য নিরসনে তারা প্রতিটি পরিবারে একজনকে চাকরি দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিও তাদের অঙ্গীকারের অংশ। কিন্তু দারিদ্র্য তৈরির নানা কারণকে কতটা সরকার গুরুত্ব দেবে সে বিষয়টির ওপর নির্ভর করছে ক্ষুধামুক্তি এবং দারিদ্র্য মুক্তি।
নানাভাবে দারিদ্র্য তৈরি হয়। সব দারিদ্র্যকেও একভাবে দেখা যাবে না এবং শুধু অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে এটিকে ব্যাখ্যা করলে হবে না। অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে যুক্ত আছে আরও নানা কারণ। সামাজিক অসমতা এর একটি প্রধানতম কারণ। এই অসমতার উপাদান নানামুখী। মানুষের প্রতি মানুষের মর্যাদাহীনতাও একটি কারণ। দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা, সামাজিকভাবে অস্পৃশ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি, এসব মিলেই বাংলাদেশে তীব্র দারিদ্র্য তৈরি হয়েছে।
দারিদ্র্যের ফলে সবচেয়ে বেশি প্রান্তিকতার শিকার হচ্ছে কৃষি মজুররা, বিধবা নারী, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমর্থন না থাকা বয়স্ক নারী ও পুরুষ (বিশেষ করে যারা চর এলাকায় থাকে), পথশিশু, যাযাবর, নির্মাণশ্রমিক, যৌনকর্মী, অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, হরিজন, সুইপার, ঋষি, শব্দকর, কাওড়া, বেদে, প্রতিবন্ধী, হিজড়া, শরণার্থীসহ নানা মানুষ।
আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আছে, যা এ ক্ষেত্রে ভাবা প্রয়োজন। যেমন নারীর ক্ষুধামুক্তি এবং দারিদ্র্যকেও পৃথকভাবে দেখা প্রয়োজন। গৃহস্থালি খাদ্যবণ্টনের রাজনীতিতে নারীকে পুরুষের পরে খাদ্যগ্রহণ করা কিংবা সবার খাবার পর খাবার বাকি থাকলে সেটি গ্রহণ করার সামাজিক যে বোধ, তা নারীর ক্ষুধামুক্তির প্রশ্নে হুমকিমূলক। যার কারণে পুরুষের চেয়ে নারীর অপুষ্টির হার বেশি। এখানে সমাজের বৈষ্যম্যমূলক ও একপেশে পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শই সবচেয়ে বেশি দায়ী।
ঠিক একইভাবে পুরুষের দারিদ্র্যের সঙ্গে নারীর দারিদ্র্যকে একভাবে দেখলে হবে না। এ বিষয়ে আলাদা বিশ্লেষণও জরুরি। এই সংসদে যখন ৬৪ জন নারী প্রতিনিধিত্ব করেন একটি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে, সেখানে নারীর দারিদ্র্যকে ভিন্নভাবে পাঠ করা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। বলা হয়ে থাকে যে জীবন নির্বাহের সুযোগগুলো সীমিত হওয়ায় নারী হলো দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতর। এটি অন্যদিকে পুরুষের ওপর নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাকে প্রকাশ করছে। গৃহস্থালি আয় এবং ব্যয় জরিপ ২০০৫-এর তথ্য অনুসারে ২৯ দশমিক ১ শতাংশ তালাকপ্রাপ্ত এবং বিধবা নারীই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। বাংলাদেশে কৃষিভূমির মাত্র ৪ শতাংশেরও কম মালিকানা আছে নারীদের। এ থেকেই বোঝা যায়, নারীদের অবস্থা কতটুকু দরিদ্রতর। নারীর দরিদ্রতা কাটাতে না পারলে কোনোভাবেই দেশ দারিদ্র্যমুক্ত করা সম্ভব হবে না।
তবে আশার কথা হলো, এই দারিদ্র্য নিরসন দিবস থেকেই ঘোষণা এসেছে, ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে। সে লক্ষ্যেই কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। এই অল্প সময়ের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়া যাবে কি না তা আন্দাজ করা কঠিন। তবে আমরা অন্তত এটুকু আশা করি যে প্রতিটি মানুষের খাদ্যের অধিকারটুকু তার সরকারের আমলেই মানুষ ফিরে পাবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com
No comments