২ বিচারপতি পদের মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন পদত্যাগই উত্তম by তবারক হোসেইন
খবরটি হলো, গত ৪ঠা আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক দ্বৈত বেঞ্চ দু’টি রিট আবেদন খারিজ করে যে আদেশ দিয়েছিলেন, সেটি আজ প্রত্যাহার করেছেন। বিচারক নিজে পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে গিয়ে বিব্রত বোধ করে ৪ঠা আগস্ট প্রদত্ত আদেশটি প্রত্যাহার করে মামলাটির নথি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়েছেন।
ঘটনাটা আরেকটু খোলাসা করি। গ্রামীণ কল্যাণ একটি সেবামূলক সংস্থা। এটির প্রতিষ্ঠাতা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ২০১২-২০১৭ সালের মধ্যে এই সংস্থাটি কর ফাঁকি দেয়ায় ৬৬৬ কোটি টাকা বকেয়া কর দাবি করে দু’টো নোটিশ পাঠালে গ্রামীণ কল্যাণের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করেন। দু’টো রিট আবেদন প্রাথমিক শুনানি করে হাইকোর্ট বিভাগ রুলনিশি জারি করেন। এর বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আপিল বিভাগে আপিলের অনুমতি প্রার্থনা করে একটি আবেদন করেন। উভয়পক্ষে শুনানি শেষে আপিল বিভাগ মূল বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন দু’টো ফেরত পাঠান। বিচারপতি খুরশিদ আলম সরকার ও বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ রিট আবেদন দীর্ঘ শুনানি শেষে গত ৪ঠা আগস্ট এগুলোর রায় দেয়ার জন্য কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত রায় প্রদান করার জন্য নির্ধারিত ছিল।
দৈনিক কার্যতালিকা অনুযায়ী রায় দেয়ার জন্য নেয়া হলে উক্ত বেঞ্চ উভয়পক্ষে সংক্ষিপ্ত শুনানি করে দু’টো রিট পিটিশনেরই রুল খারিজ করে দেন। গ্রামীণ কল্যাণের বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের যে ৬৬৬ কোটি টাকার করের দাবি বহাল রাখা হয়।
রায় শেষে গ্রামীণ কল্যাণের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ্ আল মামুন সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তারা আপিল বিভাগে আপিল করবেন। হয়তো তারা পূর্ণ রায় পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আজকের সংবাদ মাধ্যমের খবর হলো, ৪ঠা আগস্ট প্রদত্ত রায় লিখতে গিয়ে একজন বিচারপতি নাকি বিব্রত বোধ করেছেন, ফলে ৪ঠা আগস্ট প্রদত্ত রায় দু’টো প্রত্যাহার করার পর নথি দু’টো সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হয়েছে।
এখনও বিচারপতি খুরশীদ আলমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের যে কার্যতালিকা ওয়েবসাইটে রয়েছে তাতে রিট আবেদন দু’টোর বিপরীতে ‘discharged’ লেখা আছে। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে বৃহস্পতিবার নথিগুলো প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
৪ঠা আগস্ট দেশ ছিল আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনার অধীনে, সেদিন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চটি গ্রামীণ কল্যাণের রিট দু’টো খারিজ করে দেন। ৩রা অক্টোবর দেশটির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, এই সময়ে বিচারপতির বিব্রত বোধ কি বার্তা দেয়?
আমরা ছোটবেলা থেকে একটি কথা শুনে আসছি, সেটি হলো, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’, আজ হাকিম (বিচারপতি) নড়েছেন, তাদের হুকুমও নড়েছে। আমি একজন আইনজীবী। ৪ দশকের বেশি সময় ধরে এই আইন অঙ্গনে আছি। আমি কোনো মামলায় প্রকাশ্য আদালতে একটি আদেশ দেয়ার পর পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে গিয়ে কোনো বিচারপতিকে বিব্রত হতে কখনো দেখিনি, কখনো শুনিওনি। এ ব্যাপারে আমাদের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন জ্যৈষ্ঠ বিচারপতির কাছে জানতে চেয়েছিলাম- তিনি তার কর্মজীবনে এমন ঘটনা শুনেছেন কি-না? তার উত্তর ছিল ‘না’।
এমন ঘটনা আমাদের বিচারালয়ের ইতিহাসে কখনোই ঘটেনি।
এ রকম বিব্রত বোধ করার দু’টি কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয়। প্রথমত, ৪ঠা আগস্ট যে রায় দেয়া হয়েছিল সেটি ছিল তৎকালীন সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী। কারণ দেশ-বিদেশে এটি সবারই জানা যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ড. ইউনূসকে হেনস্তা করতে চান, তাই তাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে রায় প্রদান করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, হয়তো বিচারকগণ দেখছেন বর্তমানে ক্ষমতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এজন্য তাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই বিব্রত বোধ করেছেন।
দু’টোর মধ্যে যেকোনো কারণেই হোক, এ থেকে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, হাইকোর্ট বিব্রত বোধ করা বিচারপতি তাদের শপথ ভঙ্গ করেছেন। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগের পর বিচারপতিগণকে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক প্রদত্ত শপথবাক্য পাঠ করতে হয়। এতে তাকে সশ্রদ্ধচিত্তে নিম্ন্নোক্ত বাক্য উচ্চারণ করে শপথ করতে হয়, “আমি আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত আমার পদের কর্তব্য পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।”
যদি ধরে নেয়া যায় যে, বিচারকগণ বিদায়ী সরকারের চাপে আদেশ দিয়েছিলেন, বা যদি ধরা যায় যে, এখন তারা অনুভব করছেন যে, ৪ঠা আগস্টের রায় যথাযথ ছিল না, অথবা যদি বর্তমান প্রধান উপদেষ্টাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এমন বিব্রত বোধ করছেন, এসব ক্ষেত্রেও আমার বিবেচনায় তারা তাদের শপথ ভঙ্গ করেছেন এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাদের অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত।
কোনো একটি সংবাদ মাধ্যমে এ রকম একটি বক্তব্য এসেছে যে, জুনিয়র বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামান নাকি এ মামলায় সরকার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে আগে কাজ করেছেন, তাই তিনি বিব্রতবোধ করেছেন। এ যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, কোনো মামলায় কাজ করলে এবং বিচারক নিযুক্ত হওয়ার পর এ মামলা তার আদালতে এলে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বিব্রত বোধ করার কথা। এমন তো নয় যে, এ মামলাটি অপরিচিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তাই তিনি তা বুঝতে পারেন নি। কারণ সামপ্রতিকালে গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ব্যাংক, ড. ইউনূস কিছুই অপরিচিত কোনো নাম বা প্রতিষ্ঠান নয়। তাই শুনানির শুরুতেই বিব্রত বোধ করার কথা। যদি এটাকে সত্য বলে ধরে নেয়া যায়, তাহলে একথা বলা কি অযৌক্তিক হবে, তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে প্রিয় হবার জন্য এ মামলা দু’টো দীর্ঘদিন শুনেছিলেন এবং আইনজীবী থাকার কথা চেপে গিয়েছিলেন। এখন তাদের প্রদত্ত রায়ের পক্ষে কোনো আইনি যুক্তি দাঁড় করতে পারছেন না বলে অনুজ বিচারপতির বরাতে এ অজুহাত সৃষ্টি করেছেন।
ঘটনা যা-ই হোক, এ আলোচনার প্রেক্ষিতে আমার বিবেচনায় ওই দু’জন বিচারপতি তাদের পদের মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন বিধায় তাদের এ পদ থেকে অব্যাহতি নেয়াই উত্তম ও সম্মানজনক ।
তবারক হোসেইন, সিনিয়র আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
No comments