সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, আমি মনে করি সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা উচিত। কারণ এই আইনের সব সংশোধন করলেও মানুষের মনে সংশয় রয়ে যাবে। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধনের অযোগ্য। এ আইন পুরোপুরি বাতিল করতে হবে।
বেশির ভাগই আইনটি বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন
সভায় আলোচক হিসেবে বিভিন্ন পেশাজীবী এ আইনের অপপ্রয়োগ, ত্রুটি ও অসঙ্গতির বিষয় তুলে ধরেন। আলোচকদের বেশির ভাগ আইনটি বাতিল করে নতুন আইনের বিষয়ে মত দেন। মতামতের আগে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আইনটির বিভিন্ন ধারা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আলোচনার ঐক্যমতের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘এই আইনটা থাকা উচিত নয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি তুলেছি যে, আইনটি সংশোধনের অযোগ্য। এটি বাতিল করা উচিত। তার পিছনে কারণ আছে। এই আইনগুলো কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, মূলত আইন করা হয় জনগনের সুবিধার জন্য। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনটি করা হয়েছে জনগণের কন্ঠরোধ এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হরণের জন্য। শুরু থেকেই সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা আইনটি বাতিলের জন্য দাবি করে আসছি। আজ এই সভা থেকে দ্রুত এই কালো আইন বাতিল চাই।
সভায় ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন সাইবার নিরাপত্তা আইন ও দণ্ডবিধিতে থাকা মানহানির শাস্তির বিধান তুলে দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের মামলা দিয়ে কীভাবে মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে তা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ হওয়া উচিত।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কোবরা তার ওপর ঘটে যাওয়া মানসিক নির্যাতনের বিবরণ দিয়ে বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে গ্রেপ্তার হয়ে আমাকে ১৫ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আমি এখনো ট্রমার মধ্যে আছি। আমার পড়াশুনা বিঘ্নিত হচ্ছে। আমি এ আইন বাতিল চাই।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ এর প্রস্তাবিত সংশোধনী তুলে ধরেন আইন ও বিচার উপদেষ্টার একান্ত সচিব শামসুদ্দিন মাসুদ। তিনি জানান, প্রস্তাবিত সংশোধনীর সংজ্ঞায় ‘মানহানি’র দফাটি সম্পূর্ণ রহিত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশ সংক্রান্ত ১৭ ধারায় ছয় বছর কারাদণ্ড ও ১ কোটি টাকা জরিমানা পরিবর্তে ৫ বছর কারাদণ্ড ও ৫০ লাখ অর্থদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেমে বেআইনি প্রবেশ সংক্রান্ত ১৮ ধারায় তিন বছর কারাদণ্ডের পরিবর্তে দুই বছর কারাদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনের ২১ (১) ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণায় পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান সম্পূর্ণ রহিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনের ২৭ ধারায় সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংঘটন সংক্রান্ত অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের পরিবর্তে অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড ও ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারে ২৯ ধারায় ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধানটি সম্পূর্ণরূপে বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে সংশোধনীতে। আইনের ৪৭ (ক) ধারায় মামলা দায়েরের বিষয়ে বলা হয়েছে, সরাসরি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, তার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়া অন্য কেউ এই আইনে মামলা করতে পারবে না বলে প্রস্তাব করা হয়েছে।
আইন, প্রবাসী কল্যাণ ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে মতামত তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির, ইংরেজি দৈনিক দ্য ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্যতম ভিকটিম খাদিজাতুল কোবরা প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।
No comments