রাজধানীর ৩ স্পটে ৪ দিনে ৫২৩৫ প্রাণঘাতী গুলি by শরিফ রুবেল
মানবজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে, গত ১৮ই জুলাই থেকে ২১শে জুলাই পর্যন্ত ৪ দিনে ঢাকার অন্তত ৪টি স্পটে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি বিপুল পরিমাণ প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র ব্যবহার করে। অধিকাংশই এইম অন ফায়ার লক্ষ্যবস্তু টার্গেট করে গুলি করা হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশের করা ঢাকা মহানগর ও চট্টগ্রাম মহানগরীর ২২টি থানার অন্তত ১০০টি মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে এই তথ্য মিলেছে। ‘লয়্যার ফর এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানও এসব মামলার নথি পর্যালোচনা করেছে।
মামলার এজাহার ঘেঁটে দেখা গেছে, জুলাই মাসের ১৮ তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, কদমতলী, রামপুরা, ধানমণ্ডি ও চট্টগ্রাম চাঁদগাঁও এলাকায় ছাত্র আন্দোলন দ্রুত সময়ে দমাতে স্পেশাল পারপার্স অটোমেটিক শটগান (স্পার্স), ৭.৬২ এমএম চায়না রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, বিডি-৮ অ্যাসল্ট রাইফেল, টরাস ৯ এমএম, ৯.১৯ এমএম সিজে পিস্তল থেকে ১৭ হাজার ২৯ রাউন্ড বুলেট ছুড়েছে। এমনকি ১৬টি শক্তিশালী গ্রেনেডও ছোড়া হয়। প্রাণঘাতী অস্ত্র থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ১৫৬৩ রাউন্ড, মোহাম্মদপুরে ২৯৮ রাউন্ড ও সিসা বুলেট ২৯৮৪ রাউন্ড, উত্তরায় ৩৯০ রাউন্ড, ধানমণ্ডিতে ৩৩৭ রাউন্ড ও শাহবাগে ৪৩ রাউন্ড বুলেট ছোড়া হয়। মানবজমিন অনুসন্ধানে আন্দোলনে কোন স্পটে পুলিশের কোন সদস্য কতো রাউন্ড গুলি ব্যবহার করেছে এবং কি ধরনের অস্ত্র থেকে এসব গুলি ছোড়া হয়েছে তাও বিস্তারিত জানা গেছে। যার নথিপত্র মানবজমিনের হাতে রয়েছে। নিহতের ঘটনাগুলোয় পুলিশ বাদী হয়ে করা বেশির ভাগ মামলায় বিক্ষোভকালে সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। এবং জানমাল রক্ষায় গুলি চালানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এদিকে পুলিশের গুলিতে ১৮ই জুলাই থেকে ২১শে আগস্ট পর্যন্ত ৩৪১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। মারা যাওয়াদের মধ্যে অধিকাংশই এইম ফায়ার বা লক্ষ্যবস্তু করে গুলির শিকার হয়। তবে যেসব স্পটে সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয় তারমধ্যে যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর ও উত্তরা অন্যতম।
অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. নাজমুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, আসলে ৭.৬২ ক্যালিবার চায়না রাইফেল একটি ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী অস্ত্র। এটি ব্যবহারে অনেক সুবিধা। লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত কার্যকরী। এই অস্ত্র সচরাচর ব্যবহার হয় না। বেসামরিক মানুষের ওপর এই অস্ত্র ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না। কোনো দেশই এটা করে না। এর বুলেট একটি আস্তো আঙ্গুলের মতো। ৩০০ মিটারের মধ্যে কাউকে যদি এসএমজি ও চায়না রাইফেল দিয়ে গুলি করা হয়, তার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। বেঁচে গেলেও যে অরগানে এই বুলেট লাগবে তা কেটে ফেলতে হবে। এমনকি দূরবর্তী নিশানা থেকেও যদি এই অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়, গুলি যেখানে লাগবে তা ছিদ্র হয়ে বেরিয়ে যাবে। হাতে লাগলে হাত ছিঁড়ে যাবে। পায়ে লাগলে পা ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এটা এতটাই প্রাণঘাতী যে এই অস্ত্র মানুষের শরীরে বিদ্ধ হয়ে ভেতরে থেকে গেলেও বাঁচার চান্স নেই। কারণ এর তেজস্ক্রিয়া অতিমাত্রায় খারাপ ইফেক্ট ফেলে। পুরো শরীর ছড়িয়ে যায়।
সাবেক একজন সেনা কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, ৭.৬২ ক্যালিবার এমএম চাইনিজ রাইফেলের কার্যকারিতা উচ্চ পর্যায়ের। এটা লোহার পাত ৬ মিলিমিটার, ইটের দেয়াল ১৫ মি:মি, মাটির দেয়াল ৩০ সেন্টিমিটার, কাঠের তক্তা ৪০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার ভেদ করে চলে যেতে পারে। সেখানে মানুষের শরীর তো নরম জিনিস। এর একটি গুলির ওজন ১৬.৪ গ্রাম, বুলেটের ওজন ৭.৯ গ্রাম। চায়না রাইফেল দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৩০/৪০ রাউন্ড ছোড়া যায়। এখানে বিডি-৮ অ্যাসল্ট রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছে। এটা অতি মারাত্মক। এর কার্যকারিতা ৫০০ মিটার পর্যন্ত যেতে পারে। সামরিক বাহিনী এই অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।
প্রাণঘাতী যত অচেনা অস্ত্র ব্যবহার: ছাত্র আন্দোলন দমাতে বিভিন্ন বাহিনী অচেনা নানা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে প্রজেক্টাইল, মাল্টি ইম্প্যাক্ট, রেন্ডম মুভমেন্ট, কাইনেটিভ, ভারী বল কার্তুজ ও হ্যান্ড গ্রেনেড। গত ১৯শে জুলাই মোহাম্মদপুরে এসআই শহিদুল ২০টি ও এসআই মাসুম বিল্লাহ ১১টি প্রজেক্টাটাইল নিক্ষেপ করেন। এ ছাড়া রামপুরায় কনস্টেবল আশিকুর ৪টি, যাত্রাবাড়ীতে কনস্টেবল মারুফ ১টি, সোহেল ৪টি, ইমরান ২টি, শামীম ৫টি, সাদেকুল ৩টি প্রজেক্টাটাইল নিক্ষেপ করেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। ওইদিন মোহাম্মদপুরে এএসআই রাজু আহমেদ ৪ পিস, রামপুরায় কনস্টেবল আব্দুল কুদ্দুস ৫টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এ ছাড়া মাল্টি ইম্প্যাক্ট ৩টি, র?্যান্ডম মুভমেন্ট ৩টি, কাইনেটিভ ৬৮টি, ভারী বল কার্তুজ ৬২টি ও ৪টি ফ্লাস ব্যবহার করা হয়।
এসএমজি, চায়না রাইফেলের তাণ্ডব চলে যাত্রাবাড়ীতে: ঢাকা শহরের আন্দোলনের হটস্পট ছিল যাত্রাবাড়ী। ওই এলাকায় পুলিশের সঙ্গে নজিরবিহীন সংঘর্ষ হয়। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে ১৯শে জুলাই। এরপর ২০ ও ২১শে জুলাইও পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ৪ দিনে ওই এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর এসএমজি থেকে ১৭ রাউন্ড ও চায়না রাইফেল থেকে ১৪৯৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে পুলিশ। এ ছাড়া টরাস পিস্তল থেকে ৬৩ রাউন্ড, ৯.১৯ এমএম সিজে রাইফেল থেকে ৭ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। যারা এসব প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে রয়েছে, চায়না রাইফেল থেকে পুলিশ পরিদর্শক ওহিদুল হক মামুন ২ রাউন্ড, এসআই নাজমুল হুদা ২৫৫ রাউন্ড, এসআই শুভংকর চন্দ্র দাস ৩০ রাউন্ড, এসআই সুজন চন্দ্র ২০ রাউন্ড, এসআই প্রশান্ত বালা ২০ রাউন্ড, এসআই কবির হোসেন ২০ রাউন্ড, এসআই শামীম রেজা ২০ রাউন্ড, এসআই নওশের আলী ২০ রাউন্ড, এসআই আল-আমিন ২০ রাউন্ড, এসআই আমিরুল ইসলাম ২০ রাউন্ড, এসআই সুকদেব বিশ্বাস ২০ রাউন্ড, এসআই রাহাত হোসেন ২০ রাউন্ড, এসআই ফেরদোউস রনি ২০ রাউন্ড, এসআই নুরে আলম ২০ রাউন্ড, এসআই মৃগাংক ২০ রাউন্ড, এসআই রাশেদুল ২০ রাউন্ড, এসআই মির্জা বদরুল ২০ রাউন্ড, এসআই সাজ্জাদ ২০ রাউন্ড, এসআই নির্মল কুমার ২০ রাউন্ড, এসআই তন্ময় মণ্ডল ৩০ রাউন্ড, এএসআই তানভির হোসেন ৩০ রাউন্ড, এসআই মোস্তাকিম পাটোয়ারী ৩০ রাউন্ড, এসআই সাব্বির হোসেন ৩০ রাউন্ড, এসআই আনিছুর জামান ৩০ রাউন্ড, এসআই বজলুর রশিদ ৩০ রাউন্ড, এসআই শাহ আলম ৩০ রাউন্ড, এসআই এহসানুল হক ৩০ রাউন্ড, এসআই নাদিম মুন্সি ৩০ রাউন্ড, এসআই মাহবুব ৩০ রাউন্ড, এসআই ওয়াসিম বিল্লাহ ৩০ রাউন্ড, এসআই মাহবুব ৩০ রাউন্ড, এসআই সুজদ চন্দ্র দে ৩৭ রাউন্ড, এসআই শংকর হীরা ৩০ রাউন্ড, কনস্টেবল শাওন ৩০ রাউন্ড, কনস্টেবল তাফসিদুর ২১ রাউন্ড, মো. ইমন ৫ রাউন্ড, ইছহাক ৪০ রাউন্ড, মোরছালিন ৩৮ রাউন্ড, মো. রবিউল ৪০ রাউন্ড, সাব্বির ২৩ রাউন্ড, নাজমুল ২৫ রাউন্ড, মো. মিরাজ ১২ রাউন্ড, ফয়সাল ২৭ রাউন্ড, মো. নয়ন ১৬ রাউন্ড, রিফাত ৩ রাউন্ড, হৃদয় ১০ রাউন্ড। এ ছাড়া এসআই আবু সায়েম ৯.১৯ সিজে পিস্তল থেকে ৫ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। এএসপি আব্দুল হান্নান টরাস পিস্তল থেকে ৫ রাউন্ড গুলি ছোড়েন।
মোহাম্মদপুরে চায়না রাইফেলে ব্যাপক প্রাণহানি: কোটা আন্দোলনের আরেকটি উত্তেজনাপূর্ণ স্পট ছিল মোহাম্মদপুর। ১৮ থেকে ২১শে জুলাই পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয় সেখানে। আন্দোলন দমাতে পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র ব্যবহার করে। হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছোড়া হয়। এতে ভারী বুলেটে বিদ্ধ হয়ে অন্তত ২৫ জন আন্দোলনকারী নিহত হন। ১৮ থেকে ২১শে জুলাই পর্যন্ত মোহাম্মদপুর আল্লাহ করিম বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে পুলিশ এসএমজি থেকে ১৬৬ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ ছাড়া এমএম ৭.৬২ ক্যালিবার চায়না রাইফেল থেকে ১১৫ রাউন্ড, বিডি-৮ অ্যাসল্ট বা সাব-মেশিনগান থেকে ১৬ রাউন্ড, টরাস পিস্তল থেকে ২ রাউন্ড ও ভারী সিসা বুলেট ২৯৮৪ রাউন্ড ছোড়া হয়। এরমধ্যে বিজিবি’র ল্যান্স কর্পোরাল রাকিবুল ইসলাম এসএমজি বাঁট নং-১৩৭ থেকে ২৯ রাউন্ড, এবি উজ্জ্বল মণ্ডল এসএমজি বাঁট নং-১৬ থেকে ৮ রাউন্ড, ল্যান্স কর্পোরাল সারওয়ার এসএমজি বাঁট নং-১১ থেকে ৭ রাউন্ড, সার্জেন্ট কামরুল ইসলাম এসএমজি বাঁট নং-১৩২ থেকে ৫৯ রাউন্ড, এসআই আবু বক্কর সিদ্দিক এসএমজি বাঁট নং-১৫২ থেকে ১৪ রাউন্ড, কনস্টেবল সুব্রত এসএমজি বাঁট নং-১৩০ থেকে ১০ রাউন্ড, কনস্টেবল রিফাত এসএমজি বাঁট নং-১২০ থেকে ৬ রাউন্ড, কনস্টেবল রনি এসএমজি বাঁট নং-৪৮ থেকে ১৯ রাউন্ড, কনস্টেবল শাকিল এসএমজি বাঁট নং-১৬৬ থেকে ৫ রাউন্ড, কনস্টেবল বোরহান এসএমজি বাঁট নং-৩৪ থেকে ১ রাউন্ড, সৈনিক মেহেদি এসএমজি বাঁট নং-১২২ থেকে ৮ রাউন্ড। এ ছাড়া ৭.৬২ ক্যালিবার চায়না রাইফেল থেকে এসআই তারিকুল ইসলাম ৩ রাউন্ড, এসআই শাহরিয়ার আলম ২০ রাউন্ড, এসআই আরিফুর রহমান ২০ রাউন্ড, এএসআই অঞ্জয় হালদার ২০ রাউন্ড, এএসআই চয়ন সাহা ২০ রাউন্ড, কনস্টেবল খাইরুল ১২ রাউন্ড, কনস্টেবল হৃদয় ৭ রাউন্ড, কনস্টেবল মোক্তারুল ৪ রাউন্ড, কনস্টেবল তিমন ৮ রাউন্ড, কনস্টেবল আলম ৪ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। এই স্পটে প্রাণঘাতী বাংলাদেশি রাইফেল বিডি-৮ ব্যবহার করা হয়। এই রাইফেল দিয়ে কনস্টেবল তরিকুল বাঁট নং-৪৯ থেকে ১ রাউন্ড, কনস্টেবল হাবিবুর বাঁট নং-৪৪ থেকে ২ রাউন্ড, কনস্টেবল কাওসার বাঁট নং-৩৫ থেকে ১ রাউন্ড, কনস্টেবল মোস্তাকিম বাঁট নং-৩৭ থেকে ৫ রাউন্ড, কনস্টেবল শাহরিয়ার বাঁট নং-১২২ থেকে ২ রাউন্ড, ফুয়াদ বাঁট নং-১০৩ থেকে ৪ রাউন্ড, ইনক দাশ বাঁট নং-১৪৫ থেকে ১ রাউন্ড। এ ছাড়া এসআই আব্দুস সালাম টরাস পিস্তলের ১ রাউন্ড ও এএসআই রাজু ৪টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এ ছাড়া এসআই, এএসআই ও কনস্টেবলরা ছাত্রদের দমাতে ২৯৮৪ রাউন্ড প্রাণঘাতী সিসা বুলেট ছোড়ার প্রমাণ মিলেছে।
চায়না রাইফেল ব্যবহার হয় শাহবাগ, সায়েন্সল্যাবে: শাহবাগ এলাকায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর চায়না রাইফেল থেকে ৪৩ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। মূলত সায়েন্সল্যাব ও সিটি কলেজ এলাকায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর চায়না রাইফেল থেকে এসব গুলি ছোড়েন। ওই এলাকায় যারা চায়না রাইফেল থেকে গুলি করেন তাদের মধ্যে কনস্টেবল মেহেদী ১ রাউন্ড, কনস্টেবল লিটন ১০ রাউন্ড, বিজিবি সুবেদার সাদেক আলী ৪ রাউন্ড, বিজিবি’র ল্যান্স নায়েক মনসুর আলী ২ রাউন্ড, সিপাহী শফিকুর রহমান ১২ রাউন্ড, সিপাহী সুব্রত কুমার সরদার ৬ রাউন্ড, সিপাহী আব্দুল্লাহ খান ৪ রাউন্ড, সিপাহী হাসান মিয়া ৩ রাউন্ড, মোহাব্বত হোসেন ৪ রাউন্ড, আবির হোসেন ৪ রাউন্ড, লিটন মিয়া ২ রাউন্ড, ল্যান্স নায়েক ফাইবুল ইসলাম ১ রাউন্ড। এ ছাড়া সেখানে শটগান থেকে বিপুল পরিমাণ সিসা বুলেট ছোড়া হয়।
কদমতলীতে ব্যাপকহারে ৭৬২ রাইফেল ব্যবহার: রায়েরবাগ পুলিশ ব্যারাক এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। কদমতলী থানার অর্ন্তগত ওই এলাকায় পুলিশের গুলিতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওই স্পটে আন্দোলনকারীরা দুই পুলিশ সদস্যকে মেরে ফুটওভার ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখে। পুলিশ সদস্যরা ১৮ই জুলাই থেকে ২১শে জুলাই পর্যন্ত ওই এলাকায় মাত্রাতিরিক্ত চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করে। ৪ দিনে ওই এলাকায় চাইনিজ রাইফেল থেকে ৭১৮ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। এতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
৪ দিনে উত্তরায় ৩৬৮ রাউন্ড প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার: ছাত্র আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্পট ছিল উত্তরা। উত্তরায় ১৮ই জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ৮ ঘণ্টা ধরে পুরো উত্তরা জুড়ে এই সংঘর্ষ চলে। এতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী সড়ক দখলে নেয়। পুলিশের গুলিতে উত্তরার হাসপাতালগুলো অ্যাম্বুলেন্সের দীর্ঘ লাইন লেগে যায়। একদিনেই ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে। গুলিবিদ্ধ হন শ’ শ’ শিক্ষার্থী। ১৯শে জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ আরও ব্যাপকভাবে দমনপীড়ন চালায়। এতে প্রাণঘাতী ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এদিন প্রাণঘাতী চাইনিজ রাইফেল থেকে ৩৬৮ রাউন্ড গুলি ব্যবহার করা হয়। ২ দিনে উত্তরায় যারা এসএমজি ও চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে রয়েছে, এএসআই আলহাজ উদ্দিন এসএমজি ১৭ রাউন্ড। কনস্টেবল কাজী মিঠুন চাইনিজ রাইফেল ৬ রাউন্ড, আনসার সদস্য মোহাম্মদ আলী ১৭ রাউন্ড, এসআই মোফাজ্জল হোসেন ১০ রাউন্ড, এসআই মাঈন উদ্দিন ২৭ রাউন্ড, এসআই মনির হাসান ১৬ রাউন্ড, এসআই মনিরুজ্জামান ২৬ রাউন্ড, এসআই হাসান মুন্সি ৩৭ রাউন্ড, এসআই শাহীন রেজা ১৭ রাউন্ড, এসআই মিকাইল ২৯ রাউন্ড, এসআই রেজওয়ান ফকির ১৯ রাউন্ড, এসআই নাহিদ পারভেজ ৪৫ রাউন্ড, এসআই মাঈন উদ্দিন ১৯ রাউন্ড, এএসআই শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি ৩৮ রাউন্ড, কনস্টেবল ফারুক ১০ রাউন্ড, আ. সহিদ ৯ রাউন্ড, হৃদয় ২০ রাউন্ড। স্পেশাল পারপার্স অটোমেটিক শটগান (স্পার্স) থেকে সিসা বুলেট ছোড়েন কনস্টেবল শাহ আলম ১৩ রাউন্ড, কনস্টেবল আবুল ফজল ৭ রাউন্ড, কনস্টেবল আব্দুল কুদ্দুস ১০ রাউন্ড। ওই দিন ছাত্রদের ওপর আরও ৩৬১ রাউন্ড সিসা বুলেট ব্যবহার করা হয়। ধানমণ্ডি এলাকায় চাইনিজ রাইফেল থেকে ৩০০ রাউন্ড ও এসএমজি থেকে ৩৭ রাউন্ড গুলি ছোড়েন পুলিশ। এতে ফারহান ফাইয়াজ, শুভ, সোহাগ, রনিদের মতো অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
১০০টি মামলা থেকে প্রাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও বুলেটের বিবরণ: শটগানের সিসা কার্তুজ ১২৩৪০ রাউন্ড, চাইনিজ রাইফেল ৭.৬২ এমএম, এসএমজি, টরাস ৯ এমএম ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের প্রাণঘাতী বুলেট ৪৩১৬ রাউন্ড, পিস্তলের গুলি ২৫৬ রাউন্ড, রাবার বুলেট ৮৯৯৪ রাউন্ড, লাইট হ্যান্ড গ্রেনেড, হ্যান্ড গ্রেনেড ও গ্রেনেড ১৬টি, লং ও শর্ট গ্যাস সেল ১৮৪৭ রাউন্ড, টিয়ার গ্যাসশেল ৮৮৬ রাউন্ড, টিয়ার গ্রেনেড ১টি, সাউন্ড গ্রেনেড ৯৮৪ টি, প্রজেক্টাইল ৪৮টি।
শটগান কখন মারণাস্ত্র হয়ে উঠে এর ব্যাখ্যা করে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি নাজমুল হুদা বলেন, স্পেশাল পারপার্স অটোমেটিক শটগান (স্পার্স) এই আন্দোলনে এই অস্ত্রটিও ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা নামে শটগান হলেও আদতে মরণঘাতী অস্ত্র। কারণ এতে এন্ট্রি বুলেট ব্যবহার করা যায়। মেটাল ফরিং বুলেট, যেটা গাড়ি ছিদ্র্র করে বের হয়ে যাবে। তাহলে এই বুলেট যদি কারও শরীরে লাগে, তার কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। এই অস্ত্র নিয়ে রাবার বুলেট, ছররা গুলিও ছোড়া যায়। এজন্যই এর নাম হয়েছে স্পেশাল পারপার্স অটোমেটিক শটগান। একটি কথা বলতে হয়, যখন মব কন্ট্রোল হয়, তখন প্রথমে সতর্ক করতে হবে। কিন্তু পুলিশ জনগণকে কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি। তারা প্রথমেই গুলি শুরু করেছে। একবারে উল্টোদিক থেকে শুরু হয়েছে। যেটা হওয়ার কথা ওয়ার্নিং সেটা শুরু হয়েছে ফায়ারিং দিয়ে। আসলে মানুষ মারার সংকল্প নিয়ে পুলিশকে মাঠে পাঠানো হয়েছিল। তিনি বলেন, ৭৫ মিটারের মধ্যে কাউকে এসএমজি দিয়ে গুলি করা হলে মৃত্যু নির্ঘাত। চাইনিজ রাইফেল ওজন কম, নিশানা ঠিক থাকে এবং নির্বিঘ্ন্নে অনেক সময় ব্যবহার করা যায়।
No comments