জাতিসংঘে আমাদের ৫০ বছরে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী

তেমন অনেক কিছু বলা যায় না, বলা ঠিকও না। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর লন্ডন থেকে তারেক রহমান যা বলেছেন বা বলছেন দেশবাসী তাতে অনেকটাই খুশি। আমিও অভিভূত। কিন্তু তার অনুরোধ নির্দেশ আহ্বান তার দলীয় নেতাকর্মীদের উপর তেমন প্রভাব ফেলছে বলে মনে হয় না। তা না হলে হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে কেন এমন করবেন? এতদিন আওয়ামী লীগ খেয়েছে এখন আমরা খাবো। বিএনপি’র অনেক নেতাকর্মীর এমন জোর জবরদস্তির কারণে আন্দোলন পরবর্তী বিএনপি’র জনপ্রিয়তা যতটা সাবলীল শক্তিশালী ছিল সেটা অনেকটা কমে গেছে। এটা জানি, সমালোচনা কারোরই ভালো লাগে না।

জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির ৫০ বছর উদ্‌যাপন উপলক্ষে বিশ্বখ্যাত নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘের আঙিনায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলাপ- আলোচনা এবং জাতিসংঘে ভাষণ আমার চোখে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এজন্য বিশ্বনন্দিত নাগরিক, বাংলার সম্পদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে দেশবাসী এবং আমার, আমার দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।

স্বাধীনতার পর আমরা যখন জাতিসংঘের সদস্য হই তখন বাংলাদেশের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন সেদিন তার ভাষণ তর্জমা করে শুনাবার বা ট্রান্সলেট করার ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু এখন জাতিসংঘে যে নেতাই ভাষণ দেন না কেন বেশ কয়েকটি ভাষায় সে ভাষণটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভাষান্তরিত হয়ে থাকে। বাঙালির গর্ব, বাংলাদেশের গর্ব অধ্যাপক ইউনূস যখন ‘বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে ভাষণ শুরু করেন আমি তার শেষ শব্দ পর্যন্ত হৃদয়াঙ্গম করার চেষ্টা করেছি। অনেক সময় অনেক শব্দ বলার মধ্যদিয়ে অর্থ পরিবর্তন হয়, শব্দার্থের গভীরতা বাড়ে বা কমে। যৌবনে ৫০ বছর আগে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে যত খুশি হয়েছিলাম জীবনের শেষ প্রান্তে বাংলাদেশ দলের প্রধান হিসেবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ শুনে ততটাই খুশি হয়েছি। বলতে গেলে এই অবক্ষয়ের জামানায় তার চাইতেও হয়তো কিছুটা বেশি খুশি হয়েছি। দেশ চলবে জনগণের সম্মতিতে। কিন্তু গত ১৫-১৬ বছর শেখ হাসিনা যেভাবে নির্বাচনের নামে গণতন্ত্র হত্যা করেছেন ঐ ধরনের গণতন্ত্র দেশের মানুষ খুব একটা চায় না।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদকাল দুই মাসও হয়নি। এ যাবৎকাল সরকার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার কথা বলে যাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন সেখানে আমাদের অনেককে মনে হয় খরচের খাতায় রেখে দিয়েছেন। এটা কোনো গণতন্ত্র নয়। উপদেষ্টাদের শপথ অনুষ্ঠানে গভীর আন্তরিকতা নিয়ে দাওয়াত করা হয়েছিল। তাই গিয়েছিলাম। এতে লক্ষ কোটি মানুষ খুশি হলেও ২-৪ জন নির্বোধ অখুশিও হয়েছে। সারাজীবন কারও খুশি-অখুশি বিবেচনা করে কাজ করিনি। নিজের অন্তরাত্মাকে খুশি করার কামনা-বাসনা নিয়ে কাজ করেছি। বাকি সময়টুকুও তাই করে যাবো। কারও দিকে ঝোল টেনে অথবা কারও দিকে বিদ্বেষপ্রসূত কোনো কাজ করবো না।

বহুদিন পর মানবজমিনের প্রাণ ভোমরা জনাব মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং কথা হলো। কিছু কিছু জিনিস আমি মেনে নিতে পারি না। যেই রাষ্ট্র চালান তারই বা কর্তৃপক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ নিয়ে প্রতি বছর অন্তত দুইবার জাতীয় সম্মেলন করা উচিত। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজকে ডাকা উচিত। সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী- সবাইকে অন্তত বছরে একবার আনুষ্ঠানিকভাবে ডেকে মতামত নেয়া উচিত। বিগত সরকার যেমন তার ১৫-১৬ বছরে জাতীয় কোনো সমস্যা নিয়ে একবারের জন্যও বিরোধী দলের মতামত গ্রহণ বা সাধারণ আলোচনা করেনি। মাননীয় নেত্রী বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে মাঝেমধ্যেই তালিকা করা দালাল সাংবাদিক বা সম্পাদকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতেন। প্রশ্নগুলো মনে হয় আগে থেকেই তৈরি করা থাকতো। যা থেকে প্রধানমন্ত্রী নিজেও লাভবান হতেন না, দেশও হতো না। আলাপের এক পর্যায়ে মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছিলেন, শেখ হাসিনার পুরো আমল জুড়ে একবারের জন্যও সাংবাদিক হিসেবে আমন্ত্রণ পাইনি। এটাই স্বাভাবিক। তিনি যা করেছেন তার ফলও পেয়েছেন। এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার মাথাব্যথা তার কর্মকাণ্ডে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে সেটার প্রতিকার কি করে হবে। সর্বত্র ঘুষ-দুর্নীতিতে দেশটা একেবারে ছেয়ে গেছে। যে লেখক বা সংবাদপত্র তেমন লেজুড়ভিত্তি করতে চায়নি তাদের খরচের খাতায় ফেলতেন। এটা কোনো ভালো কথা নয়। অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি ‘ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।’ বাংলাদেশের পিতা বঙ্গবন্ধু এক সময় ছিলেন সারা জাতির শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতীক, ভালোবাসার আরাধ্য ধন। ১৬ বছর শেখ হাসিনার শাসনামল বঙ্গবন্ধুকে আরও বেশি জাতির আপনজনে পরিণত করার চেষ্টা করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে তাকে একেবারে দলীয় করা হয়েছিল। অমনটা করা মোটেই ভালো হয়নি। যেমন করেছেন তেমন ফল পেয়েছেন। কতোবার বলেছি, সংযত আচরণ করুন, সংযত হয়ে কথা বলুন। না, উনি ওনার জন্মগত স্বভাব কখনো বদলাননি বা বদলাবার চেষ্টা করেননি। এ নিয়ে শেখ রেহানাও ২-৪ বার বলেছে, ভাই আপনি জানেনই তো হাসু আপা অমনই। তাকে বলে কয়ে বুঝানো যায় না। কি বলবো, রাষ্ট্রে ‘অমনই তো’ চলে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় সব সময় মেপেজোখে কথা বলতে হয়। কিন্তু সেদিকে কোনোদিন তিনি পা মাড়াননি। আমার তো তেমন বিদ্যা-বুদ্ধি নেই। আমি রাস্তাঘাটে যা দেখি তা থেকেই শিখি। পাকিস্তান আমলে অনেক সময় দেখতাম পাড়ায় পাড়ায় নাটক-থিয়েটার হতো। নাটক মঞ্চায়নের জন্য মাসের পর মাস রিহার্সেল হতো। যেদিন মঞ্চায়ন হতো সেদিন হয়তো ২-১ হাজার দর্শকশ্রোতা একত্র হতো। তাদের সামনে শিল্পীদের উপস্থাপনের কতো রকমের প্রস্তুতি, কতো যত্ন কথাবার্তা বলার, কতো সাবলীলতা কতোটা উঠানামা হবে দিনের পর দিন শিখানো হতো, দেখানো হতো। কিন্তু আজ জাতীয় নেতারা লক্ষ কোটি মানুষের সামনে কথা বলেন কিন্তু সংযত হন না। একবারের জন্যও ভাবেন না কীভাবে কতোটা গভীরতা নিয়ে, কতোটা দরদ দিয়ে কোন বাক্যটা কীভাবে উচ্চারণ করা উচিত। এবার জাতিসংঘে ভাষণের সময় আমাদের গুণী সন্তান অধ্যাপক ইউনূস যে দরদ দিয়ে প্যালেস্টাইনের কথা তুলে ধরেছেন, ইসরাইলের বর্বরতাকে ব্যাখ্যা করেছেন তাতে আমাদের সকলের অন্তর ছুঁয়ে গেছে। এর আগে অনেকবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু সেখানে অতটা দরদ খুঁজে পাওয়া যায়নি যতটা সেদিন অধ্যাপক ইউনূসের কণ্ঠে পাওয়া গেছে। বাংলা ভাষায় একই শব্দ শুধু উচ্চারণের হেরফেরে হ্যাঁ না হয়ে যায়। কিন্তু অবাক কাণ্ড তেমন কারোরই সাধারণ মানুষ সম্পর্কে খুব একটা গুরুত্ব নেই। এ ব্যাপারে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান সাধারণ মানুষের মর্যাদা হিমালয়সম সুদৃঢ় করবে। যদিও এখনো অনেকের হুঁশ নেই। এখনো কাজ করার সময় অনেক কর্মকর্তা টাকা-পয়সার জন্য হা হয়ে থাকেন। এখনো যদি শিক্ষা না হয় তাহলে অনেকেই ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
দু’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে না বলে পারছি না। একটি হলো- সাগর-রুনি যখন নিহত হয় তখন বাংলাদেশের সবচাইতে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সাহারা খাতুন। তিনি বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে। কেন যেন সে সময় বলেছিলাম, ৪৮ ঘণ্টা তো দূরের কথা ৪৮ সপ্তাহ অথবা ৪৮ মাসেও অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের হাতে সোপর্দ করা যাবে না। কারণ সাগর-রুনি হত্যার সঙ্গে অনেক শক্তিমানরা জড়িত। জানি না, এ হত্যাকাণ্ডটির বিচার ৪৮ মাস তো হয়েই গেল, ৪৮ বছর লাগবে কিনা।

অন্যটি ক’দিন আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫, অবসর ৬৫। এখন দেখছি- সবই হাওয়া থেকে পাওয়া। বাস্তবের কোনো চিহ্ন নেই। কতোবার বলার চেষ্টা করেছি, সময়ের কাজ সময়ে করেন। কিন্তু কেউ সময়ের কাজ সময়ে করে না বা ভাবে না। সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ৩৫ বছর এ খুবই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য দাবি। এর জন্য আবার কমিটি কি? ছাত্র-যুবকদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে টানাটানি, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দরকষাকষি এর কোনোটাই ভালো না। আমি খোলা মনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানকে এসব সমাধানের জোর দাবি জানাচ্ছি।

তেমন অনেক কিছু বলা যায় না, বলা ঠিকও না। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর লন্ডন থেকে তারেক রহমান যা বলেছেন বা বলছেন দেশবাসী তাতে অনেকটাই খুশি। আমিও অভিভূত। কিন্তু তার অনুরোধ নির্দেশ আহ্বান তার দলীয় নেতাকর্মীদের উপর তেমন প্রভাব ফেলছে বলে মনে হয় না। তা না হলে হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে কেন এমন করবেন? এতদিন আওয়ামী লীগ খেয়েছে এখন আমরা খাবো। বিএনপি’র অনেক নেতাকর্মীর এমন জোর জবরদস্তির কারণে আন্দোলন পরবর্তী বিএনপি’র জনপ্রিয়তা যতটা সাবলীল শক্তিশালী ছিল সেটা অনেকটা কমে গেছে। এটা জানি, সমালোচনা কারোরই ভালো লাগে না। সত্য কথা এত কঠিন যা হজম করা খুব একটা সহজ নয়। আওয়ামী লীগ যেমন সব দোষ দিতো বিএনপি-জামায়াতকে, এখন সব দোষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিলে কোনো শুভ ফল হবে না। অতীতে কোনো গণআন্দোলনে এত জীবন বিসর্জন দেয়নি। এই আত্মত্যাগ ব্যর্থ হলে জাতিকে মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাতে হবে। তাই স্বাধীনতা ভোগ করতে কিছুটা দায়িত্ববোধেরও পরিচয় দিতে হবে। রাস্তাঘাটে মানুষের মধ্যে যা দেখছি তাতে তারা খুবই আশাবাদী। তারা তাদের প্রকৃত অধিকার চায়- সম্মান চায় এবং জনতা তাদের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব চায়।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.