ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ হলে জিতবে কে!

ইসরাইল-ইরান সরাসরি যুদ্ধ হলে জিতবে কে! কার কি সামরিক সক্ষমতা! মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইরান কমপক্ষে ১৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর এই আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে। দীর্ঘদিন এই দুটি দেশের মধ্যে ঘোর শত্রুতা। যেকোনো সময় যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। সম্প্রতি সেই আশঙ্কা প্রবল হয়েছে। তা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্বকে। জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারপ্রধান এ বিষয়ে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন। যদি সত্যি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তাহলে কে জিতবে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে আল-জাজিরা। তাদের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সম্প্রতি লেবাননে ইসরাইলের হামলার জবাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে তেহরানের জবাব হিসেবে ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। আইআরজিসি, হামাস ও হিজুবুল্লাহ’র নেতাদের হত্যার জবাবে তারা এই হামলা করেছে। তারা দাবি করেছে তেল আবিবে তিনটি সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে তারা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। ইরানের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া বলেছে, তারা প্রথমবারের মতো ফাতাহ নামের হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এর জবাব দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। বলেছেন, ইরান বড় একটি ভুল করেছে। এর জন্য তাদের মূল্য দিতে হবে। অন্যদিকে ইরানের হামলাকে মোকাবিলা করতে ইসরাইলকে সহায়তা করতে প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যদি সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে এই যুদ্ধ শুধু ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ছারখার করে দিতে পারে। এমনকি একে কেন্দ্র করে শুরু হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

সামরিক শক্তি: কয়েক দশক ধরে ইরান ও ইসরাইল ঘোর শত্রু। তাদের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ চলছে। তাতে সরাসরি যুদ্ধের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন হলে কার কতোটা যুদ্ধের সক্ষমতা তা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। বৃটেনের থিংকট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিসের (আইআইএসএস) প্রকাশিত দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুযায়ী- ইরানের আছে ৬ লাখ ১০ হাজার সক্রিয় সেনাসদস্য। তার মধ্যে ৩ লাখ ৫০ হাজার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। এক লাখ ৯০ হাজার আইআরজিসি’র সদস্য। ১৮ হাজার নৌবাহিনীর সদস্য। ৩৭ হাজার বিমান বাহিনীর সদস্য। ১৫ হাজার আছে বিমান প্রতিরক্ষা বিভাগে। উপরন্তু সাড়ে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা আছে ইরানের। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে ১৮ বছরের উপরে বয়সী ইরানি পুরুষদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। অন্যদিকে ইসরাইলের আছে সক্রিয় এক লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ সেনাসদস্য। তার মধ্যে এক লাখ ২৬ হাজার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। ৯ হাজার ৫০০ নৌবাহিনীর সদস্য। ৩৪ হাজার বিমান বাহিনীর সদস্য। ৪ লাখ ৬৫ হাজার আছে রিজার্ভ সেনা। সেখানেও সুনির্দিষ্ট কিছু ছাড় বাদে ১৮ বছরের বেশি বয়সী নারী ও পুরুষের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক।

সামরিক ব্যয়: ২০২৪ সালের এপ্রিলে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সাল থেকে সামরিক খাতে শতকরা ০.৬ ভাগ খরচ বৃদ্ধি করেছে ইরান। ২০২৩ সালে বর্ধিত হয়ে এই খরচ ছিল ১০৩০ কোটি ডলার। অন্যদিকে ২০২২ সালের পর সামরিক খরচ শতকরা ২৪ ভাগ বৃদ্ধি করেছে ইসরাইল। ২০২৩ সালে এই খরচ ছিল ২৭৫০ কোটি ডলার। গত বছর গাজায় তাদের যুদ্ধ শুরুর কারণে এই খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্থল বাহিনী: দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুযায়ী- ইরানের আছে কমপক্ষে ১০ হাজার ৫১৩টি ব্যাটল ট্যাংক, কমপক্ষে ৬ হাজার ৭৯৮টি আর্টিলারি বন্দুক। এ ছাড়া আছে কমপক্ষে ৬৪০টি সামরিক বাহিনীকে বহনে সক্ষম যান। সেনাবাহিনীর কাছে আছে ৫০টি হেলিকপ্টার। অন্যদিকে আইআরজিসি’র কাছে আছে ৫টি হেলিকপ্টার। অন্যদিকে ইসরাইলের কাছে আছে ৪০০ ব্যাটল ট্যাংক, ৫৩০টি আর্টিলারি গান এবং কমপক্ষে এক হাজার ১৯০টি সামরিক বাহিনীকে বহনে সক্ষম যান।

বিমান বাহিনী: দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুযায়ী- ইরানের আছে কমপক্ষে ৩১২টি যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য যুদ্ধবিমান। আইআরজিসি’র কাছে আছে ২৩টি যুদ্ধবিমান। বিমান বাহিনীর কাছে আছে দুটি হেলিকপ্টার। সেনাবাহিনীর কাছে আছে ৫০টি এবং আইআরজিসি’র আছে ৫টি হেলিকপ্টার। অন্যদিকে ইসরাইলের আছে ৩৪৫টি যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য যুদ্ধবিমান। হামলা চালানোর জন্য ৪৩টি হেলিকপ্টার।

নৌবাহিনী: ওই একই রিপোর্ট অনুযায়ী, ইরানের কাছে আছে কৌশলগত ১৭টি সাবমেরিন। ৬৮টি প্যাট্রোল ও কোস্টাল কমব্যাট্যান্ট। সাতটি করভেট। ১২টি ল্যান্ডিং শিপ। ১১টি ল্যান্ডিং ক্রাফট। ১৮টি লজিস্টিকস ও সরঞ্জাম সরবরাহকারী। অন্যদিকে ইসরাইলের আছে ৫টি সাবমেরিন। ৪৯টি প্যাট্রোল ও কোস্টাল কমব্যাট্যান্ট।

বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: ওই একই রিপোর্ট বলছে, ইসরাইলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্ভরশীল আয়রন ডোম ব্যবস্থার ওপর। ধারণা করা হয়, মঙ্গলবার রাতে ইরান যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তার বেশির ভাগই এই ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। এই ব্যবস্থায় আছে একটি রাডার। তা যেকোনো হামলাকারী বস্তু, তার গতি এবং দিক শনাক্ত করতে সক্ষম। এরপর কন্ট্রোল সেন্টার হিসাব কষে ওই বস্তু বা ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের কোনো শহরের জন্য হুমকি কিনা। যদি দেখা হয়, তা কোনো হুমকি নয়, তবে তা ফাঁকা মাঠে পড়তে দেয়া হয়। যদি হুমকি হয়, তাহলে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। এক্ষেত্রে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এতে থাকে ২০টি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র। ইসরাইলের বিভিন্ন জায়গায় এমন ১০টি আয়রন ডোম ব্যাটারি স্থাপন করা আছে। অন্য যেসব ব্যবস্থা আছে তা মধ্যম ও দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করে। ডেভিড স্লিং ইন্টারসেপ্টর ৪০ কিলোমিটার থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে পারে। অন্যদিকে দ্য অ্যারো সিস্টেম ২৪০০ কিলোমিটার পাল্লার মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে পারে।

ওদিকে ফেব্রুয়ারিতে ইরান স্বল্পপাল্লার নিম্ন উচ্চতার আজারাখশ মোতায়েন করে। এটি হলো ইনফ্রারেড ডিটেকশন সিস্টেম। এতে আছে রাডার, ইলেকট্রো-অপটিক সিস্টেম। এসব ব্যবহার করে কোনো হামলাকে শনাক্ত করে তা নিষ্ক্রিয় করা হয়। যানবাহনে করে এই ব্যবস্থা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়া যায়। তবে ভূমি থেকে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার বিভিন্ন রেঞ্জের ব্যবস্থা আছে ইরানের কাছে। এর মধ্যে আছে কমপক্ষে ৪২টি রাশিয়ায় তৈরি দূরপাল্লার এস-২০০এস, এস-৩০০এস এবং স্থানীয় পর্যায়ের বাভার-৩৭৩। আছে কমপক্ষে ৫৯টি মধ্যম পাল্লার ইউএস এমআইএম-২৩ হক, এইচকিউ-২জে এবং খোরদাদ-১৫। আছে চীনে তৈরি ২৭৯টি স্বল্পপাল্লার সিএইচ-এসএ-৪ এবং ৯কে৩৩১ টোর-এম১।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র: যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) মিসাইল ডিফেন্স প্রজেক্টের মতে, মধ্যম ও স্বল্পপাল্লার কমপক্ষে ১২টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে ইরানের ভাণ্ডারে। অন্যদিকে ইসরাইলের আছে কমপক্ষে চারটি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।

পারমাণবিক সক্ষমতা: যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক আর্মস কন্ট্রোল এসোসিয়েশনের হিসাব মতে, ইসরাইলের অস্ত্রভাণ্ডারে আনুমানিক ৯০টি পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম অস্ত্র আছে। তবে ইরানের এমন অস্ত্র নেই বলে মনে করা হয়। তারা পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে। পশ্চিমাদের অভিযোগ এর মধ্যদিয়ে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। তবে ইরান এ অভিযোগ অস্বীকার করে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.