শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। এ সময় পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন কারখানায় অসন্তোষ চলছে (এসব কারখানার সাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট লোকজনই মালিক)। এতে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। নতুন অর্ডার দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন তারা। এ শিল্প দেশের প্রধান রপ্তানি খাত এবং অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এ খাতকে কোনোভাবেই অস্থিতিশীল হতে দেয়া উচিত নয়। অবিলম্বে এর অবসান হওয়া উচিত।
জানা গেছে, সরকার পতনের পর থেকে সাবেক মন্ত্রী, এমপিসহ একাধিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের। অনেকেই পলাতক রয়েছে। এতে বেতন বন্ধ হয়েছে অনেক কারখানায়।
আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেশের সবচেয়ে সমালোচিত এস আলম গ্রুপ। গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তিনি দেশের বাইরে আছেন। সাদ মুসা গ্রুপের মুহাম্মদ মোহসিন। এ ছাড়া বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও ব্যাংক মালিকদের নেতা নজরুল ইসলাম মজুমদার। এ ছাড়া আরও অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী কর্ণধার পলাতক ও জেলে আছেন।
কারখানা মালিকরা বলছেন, উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আমদানিকারক দেশগুলোতে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে সমস্যায় পড়বেন রপ্তানিকারকরা। শুধু তাই নয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগের কারণে ব্যবসায়ীরা কারখানা বন্ধ করে দেয়ায় শ্রমিকরাও চাকরি হারাতে পারেন। দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা ও অপরাধীদের দমনে যথাযথ পদক্ষেপের অভাব দেশের সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
পোশাক কারখানার মালিকরা জানান, কোনো পক্ষের ইন্ধনে শিল্পে এই অরাজকতা চলছে। যৌথ বাহিনী শিল্প সচল রাখার বিষযে যে সহযোগিতা করছে, তাতে তারা সন্তুষ্ট। কারখানায় অরাজকতা সৃষ্টির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য যৌথ বাহিনীকে অনুরোধ জানান তারা। পোশাক শিল্পে সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করার জন্য যৌথ বাহিনীকে পোশাক শিল্প পরিবারের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বিজিএমইএ এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব।
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর শিল্পাঞ্চলের ‘নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখা’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ন্ত্রণ নিতে না দেয়ার চেষ্টার কারণেই অশান্ত তৈরি পোশাক শিল্পাঞ্চল। বিক্ষোভ করেছেন কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। পোশাক শিল্পাঞ্চল নবীনগর, চন্দ্রা, বাইপাইল, আবদুল্লাপুর, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দীর্ঘ ৩০ কিলোমিটার যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে উত্তরবঙ্গের যাত্রীরা। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হস্তক্ষেপে এসব অঞ্চলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ব্যবসায়ী, মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পরও শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ঝুটসহ কারখানা সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, কিছু কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তৎপরতা, বেতন-ভাতা সংক্রান্ত সমস্যা, বাইরের ইন্ধনসহ বিভিন্ন কারণে পোশাক কারখানাগুলোর অস্থিরতা বন্ধ হচ্ছে না।
এদিকে বর্তমান সরকার মনে করছে গুজব ছড়িয়ে গার্মেন্টসে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। জড়িতদের অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৪শে সেপ্টেম্বর পোশাক শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ানোসহ শ্রমিকদের ১৮টি দাবি মেনে নেয় মালিকপক্ষ। শিল্পাঞ্চলে ফিরে আসে কর্মচাঞ্চল্য। এরপর সব পোশাক কারখানা চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। ফলে গত সপ্তাহে সহিংসতা ও অস্থিরতার তীব্রতা কিছুটা কমলেও এ সপ্তাহে আবারো আন্দোলন শুরু করেছে শ্রমিকরা। আবারো শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হওয়ায় এর পেছনে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠে।
মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে পোশাক খাতের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে কথা বলেন বিএনপি’র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ সময় দেশের তৈরি পোশাক খাতে যে অস্থিরতা চলছে, তাকে ‘পতিত স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী মালিকদের পরিকল্পিত চক্রান্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন রিজভী।
ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতকারকদের একজন উদ্যোক্তা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে বাজারে পণ্য সরবরাহ করা খুবই কঠিন হবে।
কোকোলা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স) মো. মহসিন বলেন, শ্রমিকদের অসন্তোষের কারণে আমাদের উৎপাদন ১০-১২ দিনের জন্য বন্ধ ছিল। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে আমরা সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবো না।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-প্রসেসর্স এসোসিয়েশনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক মো. ইকতাদুল হক বলেন, ৫ই আগস্টের পর শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন অংশে অস্থিরতা দেখা দিলেও আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করেছি। শিল্প ও অর্থনীতির স্বার্থে সরকারের উচিত ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা, তা না হলে রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারে মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলেও জানান তিনি। একজন রপ্তানিকারক দাবি করেন, যদি নতুন করে অস্থিরতা দেখা দেয় তাহলে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পণ্য রপ্তানি করতে সমস্যায় পড়তে হবে। বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা আমাদের ওপর আস্থা হারাবে। তাই কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের এখনই সময়।
একজন কারখানা মালিক বলেন, অনেক কারখানায় সাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট লোকজন মালিক। সেখানে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ফলে বেতন পরিশোধ হয়নি। আবার কিছু কারখানায় ব্যবসায় ভালো যাচ্ছিল না গত এক বছর ধরেই। ২/৩ মাস বকেয়া পড়ে গেছে। এ থেকেই এবারের আন্দোলনের সূত্রপাত।
তিনি বলেন, এতদিন গাজীপুর-আশুলিয়া এলাকায় শ্রমিক বিক্ষোভ বা এ ধরনের পরিস্থিতিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ মূল ভূমিকা রাখতো। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশের পুরো কাঠামোই ভেঙে পড়ায় এক মাস ধরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তবে আশা করছি দ্রুতই তারা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে শুরু করবে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, কিছু কারখানায় বেতন ভাতা সংক্রান্ত সমস্যা আছে, সেটা বিজিএমইএ দেখছে। এর বাইরে নানা কারণ দেখিয়ে কিছু সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে শ্রমিকদের চেয়ে বাইরের লোকজন বেশি সম্পৃক্ত বলে মনে হচ্ছে।
No comments