শিক্ষকদের অনশন চলছেই
কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনারের এক পাশে ঘাসের ওপর অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছেন এক শিক্ষক। আরও
দুই-তিনজন তাঁকে শুশ্রূষা করছেন। একজন অসুস্থ ওই শিক্ষককে স্যালাইন
দিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও কয়েকজন অসুস্থ শিক্ষককে সেখানে আনা হলো।
আরেকজন শিক্ষককে কয়েকজন ধরাধরি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে নিয়ে
গেলেন। বেতন স্কেলের বৈষম্য কমানোর দাবিতে সারা দেশ থেকে আসা সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের অনশন কর্মসূচিতে
গতকাল রোববার এমন চিত্র দেখা গেছে। বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক
মহাজোটের ডাকে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। দ্বিতীয় দিনের মতো গতকাল কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে চলমান এই কর্মসূচিতে কয়েক হাজার শিক্ষক উপস্থিত
ছিলেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত কমপক্ষে ১১ জন শিক্ষককে হাসপাতালে নেওয়া হয়। গত
শনিবার সকাল ১০টায় এই কর্মসূচি শুরু হয়। শীতের রাতেও শিক্ষকেরা শহীদ
মিনারে অবস্থান করছেন। বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সংহতি
জানাচ্ছেন। গতকাল বিকেলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের
সিদ্দিকী শহীদ মিনারে গিয়ে শিক্ষকদের প্রতি সংহতি জানান। আন্দোলনকারী
শিক্ষকেরা ঘোষণা দিয়েছেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অনশন চলবে। তবে
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত অনশনকারী
শিক্ষকেরা ইতিবাচক সাড়া পাননি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গতকাল সচিবালয়ে গিয়ে
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আসিফ-উজ-জামানের সঙ্গে
দেখা করতে চাইলে তাঁর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, সচিব জানিয়ে দিয়েছেন এখন
কথা বলতে পারবেন না। পরে আরেকজন অতিরিক্ত সচিবের কাছে গেলে তিনিও এ বিষয়ে
কথা বলতে রাজি হননি। এর আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু
হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোন করলে তিনি সভায় আছেন বলে
খুদে বার্তা পাঠান। পরে বিকেলে আবার ফোন করলে তিনি আর ফোন ধরেননি। আর
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানকে ফোনে যোগাযোগ করে পাওয়া
যায়নি। তিনি বিকেল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ছিলেন।
সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয় আছে ৬৩ হাজার ৬০১টি। মোট শিক্ষক প্রায় সোয়া তিন লাখ। এর মধ্যে
সহকারী শিক্ষক প্রায় পৌনে তিন লাখ। সহকারী শিক্ষকদের আটটি সংগঠন এই
কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। দুপুরে নেতৃত্ব নিয়ে কয়েকজন শিক্ষকনেতার মধ্যে
বাগ্বিতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। শহীদ মিনারে আন্দোলনরত সহকারী
শিক্ষকেরা বলছেন, তাঁদের দাবি একটাই। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের
বেতন স্কেল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের মাত্র এক ধাপ নিচে রাখতে
হবে। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকদের চেয়ে তিন ধাপ নিচের স্কেলে বেতন পান সহকারী
শিক্ষকেরা। প্রধান শিক্ষকেরা বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেডে (এই গ্রেড শুরুর
মূল বেতন ১২,৫০০ টাকা) বেতন পান। আর সহকারী শিক্ষকেরা ১৪তম গ্রেডে (এই
গ্রেডের শুরুর মূল বেতন ১০,২০০ টাকা) বেতন পান। প্রশিক্ষণ ছাড়াও শিক্ষক
আছেন। তাঁদের বেতন স্কেল আরও এক ধাপ কম। অনশনে যোগ দিয়েছেন রাজশাহীর
দুর্গাপুরের তেবিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আখলাক হোসেন।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে সহকারী শিক্ষকেরা প্রধান শিক্ষকের এক ধাপ
নিচের গ্রেডেই বেতন পেতেন। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে সহকারী শিক্ষকেরা তিন ধাপ
নিচের গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। এটা বৈষম্যমূলক। এ জন্য তাঁরা চান প্রধান
শিক্ষকের মাত্র এক ধাপ নিচের গ্রেডে যেন তাঁদের বেতন স্কেল নির্ধারণ করা
হয়। কয়েকজন শিক্ষক জানিয়েছেন, সহকারী শিক্ষকেরা দীর্ঘদিন ধরেই এই দাবি
জানিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকার তা পূরণ না করায় এখন তাঁরা কঠোর অবস্থানে
গেছেন। কুমিল্লা থেকে এসেছেন সহকারী শিক্ষক পলি আহমেদ। দাবির যৌক্তিকতা
তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে রসায়নে
স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পাস। এখন অধিকাংশ শিক্ষকের যোগ্যতা স্নাতক ও
স্নাতকোত্তর। এই সময়ে কেন এ রকম কঠোর আন্দোলনে নামলেন, এমন প্রশ্নে এক
শিক্ষকনেতা জানালেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন দ্বিতীয় শ্রেণি হওয়ায় সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল আরও এক ধাপ বাড়িয়ে ১০ম
গ্রেড করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু তাঁদের দাবিটি পূরণ হচ্ছে না। এ
জন্য তাঁর ভাষায় দেয়ালে পিঠ গেছে। দুপুরে শহীদ মিনার গিয়ে দেখা গেছে,
বক্তৃতার পাশাপাশি কিছু শিক্ষক গান-কবিতা আবৃত্তি করছেন। এর মধ্যেই অনশনরত
কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আন্দোলনকারী বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক
মহাজোটের নেতা শাহিনুর আল আমীন বলেন, দুপুর পর্যন্ত কমপক্ষে ১১ জন শিক্ষককে
হাসপাতালে নেওয়া হয়। অনশনস্থলেও কয়েকজন অসুস্থ হয়ে আছেন। তিনি বলেন,
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু সরাসরি
ঘোষণা না আসা পর্যন্ত অনশন চলবে। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রাতেও
অনেকে শহীদ মিনারে ছিলেন। এমনই একজন শিক্ষক নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার
একটি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাতে শহীদ মিনারে
ছিলেন। সকালে এক জায়গা থেকে গোসল করে আবার এখানে এসেছেন। তিনি বলেন, দাবি
না মানা পর্যন্ত তাঁরা এখানেই থাকবেন। নেত্রকোনা থেকে আসা শিক্ষক দলের
মধ্যে দুজন প্রধান শিক্ষকও ছিলেন। তাঁরা কেন এসেছেন, জানতে চাইলে তাঁদের
একজন আলেক মিয়া বললেন, সহকারী শিক্ষকেরাও তাঁদের সহকর্মী। তাঁদের দাবিও
যথার্থ। এ জন্য একাত্মতা জানাতে এসেছেন। অনশনে অংশ নেওয়া এক শিক্ষকনেতা রাত
সোয়া নয়টায় প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি
হিসেবে দুই কর্মকর্তা রাতে অনশনস্থলে গিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন প্রত্যাহারের
অনুরোধ জানান। তাঁরা বলেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে। তখন
শিক্ষকেরা বলেন, সরাসরি ঘোষণা দিলেই কেবল তাঁরা অনশন ভাঙবেন। পরে অনশন
চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
No comments