পিছু হটছে সরকার
শেষ পর্যন্ত নতুন ভ্যাট আইন এবং আবগারি শুল্কের বর্ধিত হার বাস্তবায়ন করা থেকে পিছিয়ে আসছে সরকার। পহেলা জুলাই থেকে তা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগে এ নিয়ে জনরোষ সৃষ্টি হতে পারে- এমন শঙ্কা থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের এমপিসহ দেশের ব্যবসায়ী সমাজের দাবির বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনার পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। অর্থমন্ত্রণালয় এবং এনবিআরের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হলে প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি হবে অতিরিক্ত প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাব মেলাতে বুধবার ব্যস্ত সময় পার করেছেন মন্ত্রণালয়ের বাজেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পাশাপাশি পুরনো আইনে বিভিন্ন খাতের ভ্যাট হার নির্ধারণে ব্যস্ত ছিলেন এনবিআরের কর্মকর্তারাও। তবে এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত আসবে আগামী ২৮ জুন জাতীয় সংসদে অর্থবিল পাসের মাধ্যমে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা দেবেন।
জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, জনগণের জন্য যা ভালো হবে, আগামী বাজেটে তা করা হবে। পহেলা জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে যা বলার বলবেন। এর আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশের পর অর্থ মন্ত্রণালয় নতুন করে বাজেটের হিসাব নিকাশের প্রাথমিক কাজ শেষ করেছে। এটি অর্থমন্ত্রীর কাছে জমাও দেয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হলে বাজেটে ভ্যাট থেকে আদায় কমবে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। তা মেটাতে নতুন করে হিসাব করা হয়েছে। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নতুন ভ্যাট আইনে ব্যবসায়ীদের আপত্তিগুলো জানানো হয়েছে। সেখানে আবগারি শুল্ক, করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ানোর বিষয়ে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ী ও জনগণের স্বার্থে এসব বিষয় সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন আমাকে। জানা গেছে, গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঢেকে নতুন ভ্যাট আইন ও বর্ধিত আবগারি শুল্কের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী নিজেও। পাশাপাশি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। ওই নির্দেশের পর মঙ্গলবার অর্থ সচিব এবং এনবিআর চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী। আর বুধবার একই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেন অর্থ সচিব। জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে (২০১৭-২০১৮) মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট থেকে মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৯১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। আর সংশোধিত বাজেটে (২০১৬-২০১৭) তা হচ্ছে ৬৮ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। ফলে প্রস্তাবিত বাজেটে অতিরিক্ত ২২ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বেশি ভ্যাট আদায় করতে হবে। অতিরিক্ত এ অর্থ নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে আদায়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এখন আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তা ধরেই এই অর্থের ঘাটতি পূরণে তিনটি খাত বিবেচনা করা হচ্ছে। এর প্রথমটি হচ্ছে- ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, দ্বিতীয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস এবং সর্বশেষ হচ্ছে করের আওতা সম্প্রসারণ। এছাড়া মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হতে পারে। তবে ২৩ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি সমন্বয়ে ব্যাংকিং খাতের ঋণ বৃদ্ধি এবং এডিপির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে তা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বেশি। কারণ বাজেটে ঘোষিত এডিপির আকার অর্থবছরের শেষে কাটছাঁটের মাধ্যমে কমানো হয়। এ বছর বাজেট পাসের দিন তা কাটছাঁট করে চূড়ান্ত করে ঘোষণা দেয়া হবে। আর সরকার চাইলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে বলে ওই কর্মকর্তা জানান। প্রায় দেড় বছর পর অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী এখন থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিজ নিজ এলাকায় গণসংযোগ চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন ও আবগারি শুল্কের বর্ধিত হার নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে। এছাড়া সংসদেও নিজ দলের সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। ফলে এ অবস্থায় জনরোষ সৃষ্টি হয়ে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে- এমন আশঙ্কা করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকারা। কারণ ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, নিত্যব্যবহার্য বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাবে।
এ ব্যাপারে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন করা অথবা না করা সবকিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে এনবিআরের কোনো কিছু করারই থাকছে না। তবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইঙ্গিত পাওয়ার পর আইন সংশোধনের কাজ করা হচ্ছে। এনবিআরের সূত্রে জানা গেছে, নতুন আইনে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হারের পরিবর্তে ৮-১০টি সেবা খাতের জন্য হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এসব খাতের মধ্যে আছে- আবাসন, জুয়েলারি, রড ও বিদ্যুৎ। হ্রাসকৃত হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে পৃথক ৩টি পদ্ধতি বিবেচনা করা হচ্ছে। এসব হ্রাসকৃত হার হবে ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে- যেসব খাতের হ্রাসকৃত হার ১০ শতাংশ থাকবে, নতুন আইনে সেসব খাত রেয়াত সুবিধা নিতে পারবে। দ্বিতীয় হচ্ছে- ৮-১০টি খাতের জন্যই সমহারে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ এবং সর্বশেষ বা তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে খাতভেদে পৃথকভাবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা, যা বর্তমান আইনেও আছে। সূত্রমতে, এসব বিষয়ে মঙ্গলবার এনবিআর থেকে ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে কোন হারে ভ্যাট আদায় করা হবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এনবিআরের সূত্রে জানা গেছে, ভ্যাট অব্যাহতির তফসিল সংশোধন করে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, প্লাস্টিকের থালা-বাটি, জেনারেটর মতো আরও কিছু নিত্যব্যবহার্য পণ্য। সূত্রমতে, ১৫ শতাংশের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপ করলে কোন সেবা খাতে রাজস্ব আদায় কমবে, তার একটি খসড়া হিসাব সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হলে বাড়তি ভ্যাট আদায় করতে পুরনো আইনের কী কী পরিবর্তন দরকার হতে পারে, তারও চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ওই খসড়ায়। তবে নতুন আইন বাস্তবায়ন না হলে প্রস্তাবিত বাজেট পাসের পর প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ভ্যাটের হার পরিবর্তন করা হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে ২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর নতুন ভ্যাট আইনটি পাস করেন এ সরকারের তৎকালীন সংসদ সদ্যস্যরা। আইনটি পাস করা হলেও প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সময় রেখে তা ২০১৫ সালের ১ জুলাই কার্যকর করার কথা ছিল। পরে তা আরও দুই বছর পিছিয়ে দিয়ে আগামী ১ জুলাই বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত হয়। এখন আবার সেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সরকারের সংসদ সদস্যরাই আইনটি বাস্তবায়নের প্রাক্কালে জাতীয় সংসদে এর সমালোচনা করছেন। আবগারি শুল্ক কমছে : ব্যাপক সমালোচনার মুখে ব্যাংকস্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক কমানোর কাজ শুরু করেছে এনবিআর। অর্থমন্ত্রীও বলেছেন, ‘আবগারি শুল্ক কমানো হবে। এর নামও পরিবর্তন হতে পারে।’ প্রস্তাবিত বাজেটে ১ লাখ টাকা ব্যাংকস্থিতির ওপর বছরে একবারের জন্য ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কাটার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে এটি ছিল ৫০০ টাকা। চূড়ান্ত বাজেটে এটি ৬০০ টাকা করা হতে পারে। একইভাবে অন্য স্তরগুলো কমানো হতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকস্থিতি ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৮০০ টাকা, ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত আড়াই হাজার টাকা, ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ১২ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বের ব্যাংক হিসাবের ক্ষেত্রে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দেয়া হয়।
আয়কর পরিবর্তন : বড় পরিবর্তন আসছে আয়কর খাতেও। ব্যবসায়ীসহ সব মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হতে পারে। একই সঙ্গে শেয়ারবাজারের করমুক্ত লভ্যাংশের সীমাও বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে এ সীমা ২৫ হাজার টাকা। তাছাড়া সারচার্জ ও শেয়ারবাজারের স্বার্থে কর্পোরেট করহারেও ছাড় দেয়া হতে পারে।
No comments