তিন প্রস্তাব নিয়ে খালেদা জিয়ার রুদ্ধদ্বার বৈঠক
পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। ইতিমধ্যে সহায়ক সরকারের তিনটি রূপরেখার খসড়ার কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এ খসড়া নিয়ে সোমবার রাতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বৈঠকে রূপরেখার খসড়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বিএনপির এক নীতিনির্ধারক জানান, বিদ্যমান সংবিধানের কোথাও নির্বাচনকালীন সরকার বলতে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সমঝোতা। সেই সমঝোতাকে প্রাধান্য দিয়েই আমরা রূপরেখা তৈরি করছি। তবে সমঝোতার পাশাপাশি দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলনের বিকল্প চিন্তাও রয়েছে। রোববার এক ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, ‘এ দেশে নির্বাচন হবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে নয়, তাদের (আ’লীগ) ক্ষমতার বাইরে রেখে। ঈদের পরে আমরা সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেব।’ তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে ছাড় দিয়ে এবার নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের রূপরেখার খসড়া তৈরি করছে বিএনপি। বিএনপির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও দলের ‘থিংকট্যাংক’ এ রূপরেখার খসড়া প্রণয়নের কাজ করছেন। এক্ষেত্রে সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরামর্শ নিচ্ছেন তারা। সোমবার তারাবির নামাজের পর রূপরেখা তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে যান। রূপরেখার খসড়া নিয়ে তারা প্রায় ২ ঘণ্টা বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, বৈঠকে খসড়া তিনটির বিস্তারিত চেয়ারপারসনকে অবহিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে না রেখে কিভাবে সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব সেই বিষয়েই বৈঠকে জোর দেয়া হয়। এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। বৈঠকে অন্য দুটি রূপরেখা নিয়েও আলোচনা হয়। তবে বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সবাই আপাতত এ দুটি রূপরেখার খসড়া আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করার অনুরোধ জানান। বিষয়টি আলোচনার টেবিলে রাখার পক্ষে তারা মত দেন। এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া কোনো মন্তব্য না করলেও অনেকটা ইতিবাচক ছিলেন বলে ওই নেতা জানান। সব শেষে খালেদা জিয়া জানান, রূপরেখার খসড়া নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই তা চূড়ান্ত করা হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের আরও পরামর্শও নেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, সম্ভাব্য তিন প্রস্তাবের প্রথমটিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে না রেখে একটি সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ’৯০ সালের অভিজ্ঞতার আলোকে সব দলের সম্মতির ভিত্তিতে কিভাবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব সেদিকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে খসড়ায়।
প্রধানমন্ত্রীকে না রেখে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রস্তাব আছে প্রথম খসড়ায়। দলটির নেতারা মনে করেন, সব দলের সম্মতি থাকলে এ রূপরেখায় নির্বাচন করতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে এ রূপরেখা বর্তমান বাস্তবতায় কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। জানা গেছে, বাকি দুটি রূপরেখাতে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকলেও তার নির্বাহী ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান রেখে নিবন্ধিত বা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে সর্বদলীয় সরকারের আদলে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার প্রস্তাব আছে। সর্বশেষ তৃতীয় রূপরেখায় দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের টেকনোক্র্যাট কোটায় স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার গঠন করার প্রস্তাব রয়েছে। এ রূপরেখায় সরকার প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে না রেখে তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে করার প্রস্তাব রয়েছে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ছুটিতে থাকার কথা রয়েছে এ রূপরেখায়। এখন পর্যন্ত প্রথম প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরের দুটি ঘোষণা নাও হতে পারে। প্রথম প্রস্তাবটি দেয়ার পর ওই রূপরেখার আলোকে প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হবে। সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আওয়ামী লীগকে চিঠি দেয়া হতে পারে। তবে রূপরেখা প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক নেতা জানান, তিনটি প্রস্তাবের প্রথমটিতে তারা অনড় থাকবেন না। দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রস্তাবের ভিত্তিতে যাতে একটি সমঝোতা হয় সেদিকেই তাদের নজর থাকবে। প্রথমটি সরকার প্রত্যাখ্যান করলে স্বভাবত পরের রূপরেখা নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হতে পারে। এমনটা ধরে নিয়েই এসব খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এদিকে সমঝোতার দরজা খোলা রেখে ঈদের পর সহায়ক সরকারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। তিন রূপরেখার কোনোটিই সরকার মেনে না নিলে রাজপথেই চূড়ান্ত ফয়সালার চিন্তাভাবনা দলটির হাইকমান্ডের। সহায়ক সরকারের পক্ষে জনমত তৈরিতে ঈদের পর বিভাগ বা বড় জেলাগুলোতে সমাবেশ করতে পারেন খালেদা জিয়া। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। নির্বাচনকালীন সময়ে যদি একটি নিরপেক্ষ সরকার না থাকে তাহলে কারও পক্ষেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সে কারণেই আমাদের নেত্রী দ্রুতই সহায়ক সরকারের প্রস্তাব দেবেন। ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতে আমরা ক্ষমতাসীন দলকে আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানাব। কিন্তু সরকার যদি আমাদের প্রস্তাবে সাড়া না দেয় তাহলে জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় রাজপথেই সহায়ক সরকারের ফয়সালা হবে। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে না রেখে সংবিধানের আলোকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন যুগান্তরকে বলেন, দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা করে একমত হলে সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা অবশ্যই সম্ভব। যেমনটা ’৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর হয়েছিল। দেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রধান বাধা হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই, তাকে পদে রেখে নির্বাচনকালীন সরকার হলে ওই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হবে না। জানতে চাইলে বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সরকার বা ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থানে রাখার লক্ষ্যে নির্বাচন বা অন্য যে কোনো ইস্যুতে সংবিধানের কথা বলে। সংবিধান ক্ষমতাসীনদের জন্য সুবিধাজনক। তারা সংবিধানের কথা বলবেন এটাই তো স্বাভাবিক। অন্যদিকে বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনে না আসে, তাহলে ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। সেটা ক্ষমতাসীনদের জন্য অসুবিধার বিষয়। তাই উভয় কূল রক্ষার প্রয়াস থেকে সরকারি দলের নেতারা একদিকে বিএনপিকে নির্বাচনে আসার জন্য বলছেন। অন্যদিকে বলছেন, আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। বিগত নির্বাচনগুলোর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত দেশে ১০টি নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে দলীয় সরকারের অধীনে ৬টি নির্বাচন হয়েছে। যার একটিও সুষ্ঠু হয়নি- এটাই ঐতিহাসিক সত্য। এ থেকে আমাদের বুঝতে হবে- সামনের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে কি করতে হবে।
No comments