সুশাসন ও গণতন্ত্র দুটিই প্রশ্নবিদ্ধ
গত ১১ জুন সন্ধ্যায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ দেখছিলাম। ১০ জুন প্রধানমন্ত্রীর কারামুক্তি দিবস নিয়ে প্রতিবেদন দেখানো হচ্ছিল। এ উপলক্ষে তিনি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন, মতবিনিময় করেছেন। পরে জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছেন। সেই বক্তব্যের অনেকটা অংশজুড়েই ছিল বিএনপির প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে মন্দ কথা। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের বা দেশের পদমর্যাদার ক্রম-অনুসারে দ্বিতীয় ব্যক্তি, তথা মহামান্য রাষ্ট্রপতির পরেই তার অবস্থান। ১৬ কোটি মানুষের কর্ণধার। তিনি ধর্মীয় অনুশাসন মানেন বলেই আমরা জানি। তিনি নিশ্চয়ই এও জানেন, অন্যের গিবত করা মারাত্মক পাপ এবং গিবতকারীর জন্য জান্নাতের দরজা রুদ্ধ। অতএব, আমাদের সাবধান হওয়া ভালো। গত কয়েক বছরের মধ্যে বর্তমানে চালের দাম সবচেয়ে বেশি। চালের এ ঊর্ধ্বমুখী মূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য বাংলাদেশ সরকার চাল আমদানিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ চাল আমদানিতে দুর্নীতি ঘটার যে আশঙ্কা রয়েছে, তা থেকে সরকার কতটুকু মুক্ত থাকতে পারবে, এটাই এখন প্রশ্ন। কারণ অতীতে খাদ্য আমদানিতে একটা বাজে অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। খাবার অযোগ্য পচা গম আমদানি করার বিষয়টি জনগণ ভোলেনি। এ ধরনের পরিস্থিতি যে সামনে আর হবে না এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার হবে না, তার নিশ্চয়তা দেয়া কঠিন; কিন্তু যতটুকুই দেয়া যায়, সেটি একমাত্র সরকারই দিতে পারে। সরকার বলছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, তিনি নির্বাচনে যাবেন এবং তিনি চান না, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করুক। তার কথার রেশ ধরে বলতে চাই, গত নির্বাচনে যেহেতু আওয়ামী লীগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল তাই আগামীতে যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য তিনি সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। তার দলের সাধারণ সম্পাদকের উক্তিটিও এখানে প্রণিধানযোগ্য। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপিকে কোনোভাবেই গৌণ ভাবা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না, সিরিয়াসলি নিতে হবে।’ উভয়কেই অভিনন্দন জানাই দুটি সত্য উপলব্ধি প্রকাশ করার জন্য। গত নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হতো না যদি প্রধানমন্ত্রী নিজে সাহসের সঙ্গে তা মোকাবেলা করতেন। পৃথিবীর সবাই কিন্তু বোকা নয়, সবাই চালাকও নয়। সেই পুরনো একটি কথা ‘একজন চালাক ব্যক্তি অনেক ব্যক্তিকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখতে পারে; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সব ব্যক্তিকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখতে পারে না।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি যাই বলুন না কেন, গত নির্বাচনটি যে স্বচ্ছভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি, দেশে-বিদেশে তা জলের মতো পরিষ্কার। গত নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে কোনো প্রকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি; নামকাওয়াস্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা যায়, ওই ১৫৩টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নেতা, সেটি সবাই বলেন। এ দূরদৃষ্টির সবটিই কিন্তু ইতিবাচক হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। নেতিবাচক হিসেবেও হয়। যেমন ২০১১ সালের মে-জুনের কোনো এক সময়ে দেশবাসীর মতামত না নিয়েই আরপিওর ওই ধারাটিকে তিনি সংশোধন করে ফেলেছিলেন, যে ধারাতে ‘না’ ভোটের বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল।
যদি আজ ‘না’ ভোটের বিধানটি থাকত তাহলে ১৫৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরাসরি বিজয়ী হতে পারতেন না। প্রমাণ পাওয়া যেত ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে কতজন প্রার্থী জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী আগে থেকেই জানতেন, এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তাই তিনি ৩ বছর আগেই আরপিওর ওই ধারাতে সংশোধনী এনে ‘না’ ভোটের বিধান বাতিল করে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টির আরেকটি দৃষ্টান্ত ১৯৮৬-এর নির্বাচন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি তার রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন; যেটা ওই সময় জাতির কাছে খুবই অশোভন মনে হয়েছিল। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। সে সময় তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। আবার তিনিই ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেন। অবস্থাদৃষ্টে এ কথা বলতেই হয়, তার প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছেন, প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় সেটিকে তিনি বাতিল করেছেন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর অতীতের ট্র্যাক রেকর্ড প্রশ্নবিদ্ধ, তাই আগামীতে তিনি প্রশ্নের বাইরে থাকতে চাচ্ছেন বলে আমার মনে হয়। তবে সেই চাওয়া কতটুকু আন্তরিক, সেটি সময়ই বলতে পারবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। তিনি সরকারপ্রধান তাই তিনি যেখানে যান সেখানে সংবাদমাধ্যম, টেলিভিশন চ্যানেল তার সঙ্গে থাকে। তাই তার প্রচারণা মুহূর্তের মধ্যেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে বিরোধী শিবির কি সেই সুযোগটি পাচ্ছে? পাচ্ছে না। মিডিয়ার কথা তো বাদই দিলাম, খোলা ময়দানের কোথাও কোনো সমাবেশ করার অনুমতি বর্তমান সরকার দিচ্ছে না। এ সরকার বিরোধী-শিবিরকে জনবিচ্ছিন্ন করার সবরকম চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে করে সামনের নির্বাচনে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে সব কিছুকে তারা নিজের মতো করে নিতে পারে। তাহলে আমরা বর্তমান সরকারকে কোন্ দৃষ্টি থেকে গণতান্ত্রিক বলব? এ সরকারের আচার-আচরণে গণতান্ত্রিক শব্দটি অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। সুতরাং আমরা এ সরকারকে মোটেই গণতান্ত্রিক বলতে পারি না। তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে আমাদের মাঝে একটা শঙ্কা রয়েই গেল। এবং এজন্যই বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের। ২০১৭-১৮ সালের বাজেট ঘোষিত হয়েছে। সবাই অনুমান করেছিল এ বাজেটটি হবে জনতুষ্টিমূলক। কেননা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকার জনগণের কাছে আসার জন্য একটি জনবান্ধব বাজেট পেশ করবে, এমনটিই প্রত্যাশা ছিল জনগণের। কিন্তু সেটি হয়নি। বাজেটে অনেক ‘লুপ হোল’ আছে। চারভাগের তিনভাগ বাজেট মেলানো যাচ্ছে, একভাগ মেলানো যাচ্ছে না। অর্থাৎ ঘাটতি বাজেটের পরিমাণটি প্রায় পূর্ণ বাজেটের চারভাগের একভাগ। সেই ঘাটতিটি কীভাবে পূরণ করা হবে তা অনিশ্চিত। বাজেটে আবগারি শুল্কের বিষয়টি জনমনে একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আবগারি শুল্ক নিয়ে এ সরকারের প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ সর্বত্র বিরাজ করছে। কেননা সাধারণ মানুষ তাদের কষ্টার্জিত আয় থেকে কিছু টাকা ব্যাংকে সঞ্চয় করেন। সেই কষ্টার্জিত টাকা থেকে সরকার যদি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কেটে নিয়ে যায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে? ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে ঘরেই রাখবে। আর এ কারণে দেশে চুরি-ডাকাতি বহুলাংশে বেড়ে যাবে। সমাজে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সঞ্চয় আমানত একেবারেই কমে যাবে। যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী মুহূর্তের মধ্যে এতকিছু বাতিল করতে পারেন, তিনি এ বিষয়টিকে কেন বাতিল করতে পারলেন না? সরকারের ভাবমূর্তি ঠিক রাখার জন্যই এটা করা উচিত ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। বাজেট ও বিনিয়োগ পরিবেশ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিত্তশালীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এর কারণ হচ্ছে অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। ফলে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ সরকার সাড়ে তিন বছর দেশ শাসন করেছে এটা যেমন সত্য, তেমনি রাজনীতিতে ভারসাম্য সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে, এটাও সত্য। তবে এ সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে স্পেশাল ইকোনমিক জোন সৃষ্টি করেছে, এটা বিনিয়োগের জন্য একটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু সেটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বিচার বিভাগ নিয়ে প্রধান বিচারপতি মহোদয় শঙ্কিত। ক্ষুদ্র আমানতকারী যারা ব্যাংকে টাকা রাখতেন তারা সরকারের চাপিয়ে দেয়া আবগারি শুল্ক নিয়ে শঙ্কিত। বড় বড় শিল্পপতি যারা ব্যাংকে টাকা রাখতেন, তারা টাকা পাচার হয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত। যারা ভোটার তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত। যারা কৃষক তারা আগামীর ফসল ঘরে তুলতে পারবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত। তাহলে শঙ্কার বাইরে আছেন কারা? আপাতদৃষ্টিতে এখন শঙ্কার বাইরে আছে বর্তমান সরকার। না, আমরা সরকারের কাছ থেকে এমনটি কখনই প্রত্যাশা করি না। সরকার জনগণের মন থেকে সব ধরনের শঙ্কা দূর করে তাদের স্বস্তি দেবে এটিই সরকারের কাছে প্রত্যাশা; রাজনৈতিক পরিভাষায় এ মুহূর্তের গণপ্রত্যাশা। মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক : কলাম লেখক; চেয়ারম্যান , বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
No comments