পথশিশুরাই চালাচ্ছে পত্রিকা
ভারতের নয়াদিল্লিতে পথশিশুরাই চালায় ‘বালকনামা’ নামের ট্যাবলয়েড। পত্রিকাটির বৈঠকে কথা বলছে এক পথশিশু |
ভারতের
রাজধানী নয়াদিল্লিতে রয়েছে হাজারো পথশিশু। এরা উড়াল সড়কের নিচে, ফুটপাতে
ঘুমায়। এদের নানান সমস্যা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নিয়ে ‘চেতনা’ নামের
বেসরকারি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন একটি পত্রিকা বের করে। ট্যাবলয়েডের নাম
‘বালকনামা’। পত্রিকাটির সংবাদদাতা ও প্রতিবেদকও পথশিশুরা। এই পথশিশুদের
একজন জ্যোতি কুমারী। সে রাজধানীর নির্মম ঘটনাগুলো অন্য অনেকের চেয়ে বেশি
জানে। তার ঘরে অভাব-অনটন লেগেই আছে। অসুস্থ বাবা নেশা করেন। এ কারণে ১৬
বছরের এই কিশোরীর নিয়মিত স্কুলেও যাওয়া হয়নি। পত্রিকা বিষয়ে তার জ্ঞান খুব
বেশি ছিল না। সেই জ্যোতি এখন পথশিশুদের নিয়ে প্রকাশিত ট্যাবলয়েডের
প্রতিবেদক। শহরের ঘরহারা পথশিশুরা কঠিন যেসব সমস্যার মোকাবিলা করে, সেগুলো
নিয়ে সংবাদ ও ফিচার প্রকাশিত হয় এই পত্রিকায়। এএফপির প্রতিবেদনের
পত্রিকাটির বৈঠকের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তারা অনেক সময় বৈঠক করে পথের
ধারে। কারণ, পত্রিকা অফিসও খুব বেশি জুতের নয়। ভাঙাচোরা একটি ভবনে এর
কার্যালয়। জ্যোতি কুমারীসহ কয়েকজন শিশু (যাদের অধিকাংশের বয়স ১৩) একটি
টেবিলের চারপাশে বসে ট্যাবলয়েডের পরবর্তী সংখ্যার পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত।
‘বালকনামা’ নামের ওই পত্রিকাটির হিন্দিতে অর্থ হলো শিশুদের কণ্ঠ (ভয়েস অব
চিলড্রেন)। জ্যোতি সহকর্মীদের বলছে, ‘আমাদের এখন ৭০ জন সাংবাদিক
আছে।...আমরা প্রতিবেদন সংগ্রহের পর যাচাই-বাছাই করে ছাপানোর জন্য চূড়ান্ত
করে ফেলি। এরপর প্রতিবেদনগুলো কোন কোন পাতায় যাবে, তা ঠিক করেই ছাপানোর
জন্য ছাপাখানায় পাঠাই।’ জ্যোতি কুমারী বলে, ‘উড়াল সড়কের নিচে ও ফুটপাতে
থাকা মানুষের জীবনের নানা গল্প, বাল্যবিবাহ, যৌন নিপীড়ন, মাদকের অপব্যবহার ও
পুলিশের নিষ্ঠুরতার বিষয়গুলো আমরা সংবাদপত্রে তুলে ধরি।’ জ্যোতির আশা,
এভাবে ধীরে ধীরে তাদের (উড়াল সড়কের নিচে ও ফুটপাতে বাস করা মানুষ) অবস্থার
পরিবর্তন হবে। হাসতে হাসতে জ্যোতি কুমারী বলে, ‘আমাদের এই এলাকার প্রতিবেশী
মাতাল এক চাচা তার স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে অসদাচরণ করেছিল। আমরা এটা নিয়ে
একটা খবর প্রকাশ করি।’ সে বলছিল, ‘রেলপথ থেকে লাশ বহন করে অন্য জায়গায়
নেওয়া এবং দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা করা মানুষের লাশ সরানোর কাজ পুলিশ
পথশিশুদের দিয়ে করায়।
ভারতের নয়াদিল্লিতে পথশিশুরাই চালায় ‘বালকনামা’ নামের ট্যাবলয়েড। পত্রিকাটির বৈঠকে কথা বলছে এক পথশিশু |
এটা নিয়ে আমাদের একটা প্রতিবেদন বেশ সাড়া ফেলেছিল। পরে কর্তৃপক্ষ এটা বন্ধ
করতে বাধ্য হয়।’ জীবনের তাগিদে আবর্জনা ঘাঁটা পাঁচ ভাইবোনের সংসারের খরচ
জোগাতে জ্যোতি কুমারীকে অনেক দিন আবর্জনা ঘেঁটে নতুন করে কাজে লাগানোর
মতো জিনিস সংগ্রহ করতে হয়েছে। কখনোবা ভিক্ষাও করতে হয়েছে। ২০১০ সালে
দক্ষিণ দিল্লির ব্যস্ত একটি সড়কের পাশে তার পরিবারকে দেখতে পান চেতনার একজন
শিক্ষক। ওই শিক্ষকের উদ্যোগ ও সংগঠনের সহায়তা তাদের ভাগ্য কিছুটা ফেরে।
ওই শিক্ষক প্রসঙ্গে জ্যোতি বলেছে, ‘তিনি যখন আমার মতো দরিদ্র শিশুদের
শিক্ষার সুযোগের কথা বললেন, তখন আমি এতে খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম।’ চেতনা
দিল্লির প্রায় ১০ হাজার পথশিশুর জন্য দূরশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে কাজ করে
থাকে। এই সংগঠনের দাতব্য কাজের অংশ হিসেবে ‘বালকনামা’ চলছে। আর এটিতেই কাজ
করে জ্যোতি। চেতনা জ্যোতিকে সাংবাদিকতার একটি কর্মশালায় ভর্তি করে। সপ্তাহ
খানেকের মধ্যে জ্যোতি কুমারীকে সংবাদ সংগ্রহে পাঠানো হয়। কীভাবে সাক্ষাৎকার
নিতে হয়, তাও শেখানো হয়। একটি পোশাক কারখানার কাজ ছেড়ে চেতনার সঙ্গে কাজ
করতে উদ্বুদ্ধ হওয়া শ্যান্নো এখন পত্রিকাটির পরামর্শক সম্পাদক। তিনি বলেন,
‘কাগজে অনুভূতি ও উদ্বেগ প্রকাশ করে আমাদের সম্পর্কে মানুষের মনের ধারণা
পরিবর্তন করতে পারি।’ ‘সমস্যা সমাধান সময়ের ব্যাপার’ ২০০২ সালে যাত্রা শুরু
করে এই পত্রিকা। তখন আট পৃষ্ঠার এই পত্রিকা ছিল ত্রৈমাসিক। ধীরে ধীরে
পত্রিকাটি পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখন পত্রিকাটি মাসিক হয়েছে। ১০ হাজারের বেশি
কপি প্রকাশিত হয়। চেতনার পরিচালক সঞ্জয় গুপ্ত বলেন, এ ট্যাবলয়েডের এখন
প্রধান সমস্যা হচ্ছে তহবিল জোগাড় করা। তিনি বলেন, ‘আমরা দুই রুপিতে একটি
পত্রিকা বিক্রি করে থাকি। এখনো অনেক মানুষ এটা কিনছেন না।’ সঞ্জয় বলেন,
‘একটি ভাঙাচোরা ভবনে পত্রিকাটির দাপ্তরিক কাজ চলছে। এটা আসলে মনোভাবের
ব্যাপার। মানুষের বোঝা উচিত যে আমাদের এই কাগজ পথশিশুদের গুরুত্বপূর্ণ
ব্যাপারগুলো নিয়ে খবর প্রকাশ করে থাকে। পথশিশুদের নিজেদের গল্প শোনানোর
জন্য এটি একটি গুরুতর প্রচেষ্টামাত্র। এতে সত্যিই পথশিশুদের ক্ষমতায়নের
জন্য কাজ করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন হলো পাঁচ বছরের মধ্যে এই
কাগজকে প্রথম সারির দিকে নিয়ে যাওয়া।’ ‘বালকনামা’র পাঠকদের অধিকাংশই পথশিশু
ও তাদের মা-বাবা। যেহেতু তারা অধিকাংশই পড়তে বা লিখতে পারে না, জ্যোতি
কুমারীর মতো সাংবাদিকেরাই তাদের এসব খবর পড়ে শোনায়। জ্যোতি বলে, ‘তারা অনেক
আগ্রহ নিয়ে এটা শোনো। তারা খুব খুশি এবং গর্বিত হয় আমাদের এ কাজের জন্য।’
জ্যোতি কুমারী চেতনা থেকে তার কাজের জন্য খরচ পায়। সে শিক্ষা শেষ করে
অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে চায়। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতে চায় এবং
সাহায্যের কতে চায় সে। সে বলে, ‘আমরা জানি যে অনেক বড় সংবাদপত্রও আমাদের
সম্পর্কে লিখতে চাইবে না, বিরক্ত হবে। আমরা শুধু আমাদের নিজেদের জন্য একটি
বিশাল জিনিস করার সুযোগ পাব।’
No comments