আইএসের দিন কি শেষ? ফারুক ওয়াসিফ
মধ্যপ্রাচ্য
থেকে সুসংবাদ আসে কমই। তারপরও এসেছে। আস্থা জাগানোর মতো দুটি ঘটনা আছে।
শুধু মধ্যপ্রাচ্য বলা ভুল হবে, বিষয়টা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর
বিষয়ে। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস বা আইসিসের আবির্ভাবের পর বলা হচ্ছিল যে মুসলিম
দেশগুলোতে এরা জনপ্রিয়। সেই ধারণাটা ভেঙে দিয়েছে পিউ রিসার্চ সেন্টারের
একটা জরিপ। পিউয়ের জরিপকে পাশ্চাত্য গণমাধ্যম আস্থার সঙ্গে নেয়। সেই সূত্রে
আমাদের মতো দেশেও। বড় আকারের মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে—এমন দেশগুলোতে
আইসিসের ভাবমূর্তি কেমন, তা জানতে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। এর ফল প্রকাশ
করা হয় গত নভেম্বর মাসে। তখনো ব্রাসেলস, ইস্তাম্বুল, বৈরুত ও জাকার্তায় ওই
সব সন্ত্রাসী হামলা হয়নি, যার দাবিদার হয়েছিল আইএস। আশা করা যায়, তাহলে
আইএসের পয়েন্ট আরও বেশিই কাটা যেত। যা হোক, নভেম্বরের ফলাফলটা অপ্রত্যাশিত
ছিল না। দেখা গেল, ১১টি মুসলিম অধিবাসী দেশে আইসিস ব্যাপক অজনপ্রিয়। এই
দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ নেই। আছে ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া,
পাকিস্তান, লেবানন, জর্ডান, তুরস্ক, বুরকিনা ফাসো, ইসরায়েল, সেনেগাল ও
ফিলিস্তিন। লেবানন আইএসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। দেশটার শতভাগ মানুষ
আইএসবিরোধী। ৯৭ শতাংশ ইসরায়েলি, ৯৪ শতাংশ জর্ডানি, ৮৪ শতাংশ ফিলিস্তিনি
(গাজায় ৯২ শতাংশ এবং পশ্চিম তীরে ৭৯ শতাংশ) আইসিসের বিপক্ষে। ইন্দোনেশিয়া,
তুরস্ক, নাইজেরিয়া, বুরকিনা ফাসো, মালয়েশিয়া ও সেনেগালের প্রতি দশজনের ছয়
কিংবা তারও বেশি মানুষ আইসিসকে অপছন্দ করে। বাদবাকিদের মধ্যে পছন্দকারী ও
দ্বিধান্বিত উভয়ই আছে, যদিও তাদের সংখ্যার তেমন গুরুত্ব নেই। তবে আশ্চর্য
করেছে পাকিস্তান। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬২ শতাংশ পাকিস্তানি আইসিসের বিষয়ে
কোনো মতামতই দেয়নি। আরও লক্ষণীয় যে একমাত্র পাকিস্তানের ২৮ শতাংশ
উত্তরদানকারী আইসিসের পক্ষে। তারপরও তাদের সংখ্যালঘুই বলতে হবে। পিউয়ের
জরিপ মুসলিমবিদ্বেষীদের গালে চপেটাঘাত করেছে। যাঁরা দাবি করেন, অধিকাংশ
মুসলমানই জঙ্গিবাদের সমর্থক, এই জরিপ তাঁদের ভুল প্রমাণ করেছে। বরং দেখা
গেছে, আইসিসকে বিশ্বশান্তির জন্য সমস্যা ভাবেন এমন মানুষের সংখ্যা মুসলিম ও
অমুসলিম দেশে প্রায় একই রকম। এর অর্থ, মানবিকতা ও শান্তিকামিতা দিয়ে
মানুষকে মাপতে গেলে মুসলমান আর অমুসলমানের মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য করা
যায় না। জঙ্গিবাদের প্রধান শিকার যেখানে মুসলমানরাই, সেখানে তাদেরই এর
বিরুদ্ধে থাকার কথা। আইএসের পেছনে কে রয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এক পক্ষের
দাবি, ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনামাফিক সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো
দেশ মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদ ও ভূমির ওপর দখল পেতে পেছন থেকে আইএসকে চালাচ্ছে।
আইএস মূলত এদের কাছেই ইরাক ও সিরিয়ার লুণ্ঠিত তেল বিক্রি করে এবং তার
বিনিময়ে অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম পায়। যা হোক, মদদ যেখান থেকেই পাক, পিউ
রিসার্চ সেন্টারের জরিপ বলছে, সাধারণ মুসলমান জনগোষ্ঠীর সমর্থন থেকে
আইসিসবঞ্চিত। তারপরও কথা থাকে, জঙ্গিবাদী কাজকারবারের জন্য বেশি মানুষের
দরকার পড়ে না। কোনো দেশের জনসংখ্যার অতি সামান্য অংশই উপযুক্ত অস্ত্র ও
প্রশিক্ষণ পেলে বিরাট বিপর্যয় নামিয়ে আনতে পারে। পারে, তবে সেটা সাময়িক
সময়ের জন্য। দীর্ঘ সময়জুড়ে কোনো ভূখণ্ডে সশস্ত্র তৎপরতা চালাতে হলে
সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন লাগবেই। অধিকাংশের সেই সমর্থন যেহেতু
নেই, সেহেতু কেউ কেউ বলা শুরু করেছেন, আইসিসের জানাজা পড়ার দিন ঘনিয়ে
এসেছে। বিশ্বের জন্য এবং বিশেষত মুসলিম দেশগুলোর জন্য তো বটেই, এটা এক
সুসংবাদ। সর্বশেষ খবর হচ্ছে, তেলের খনি ও এলাকা হারানোয় আইএসের আয়ও ৩
ভাগের ১ ভাগ কমে গেছে (প্রথম আলো, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬)। দ্বিতীয় সুসংবাদ
দিয়েছে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশ মরক্কো। আইএসের বিরুদ্ধে তাদের
উদ্যোগটা অনুকরণীয়। ইরাক ও সিরিয়ায় আইসিস যখন সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানদের ওপর
হামলা চালাচ্ছিল, যখন এসব হামলার সুবাদে মুসলিম অসহিষ্ণুতা নিয়ে আলোচনা
চলছিল, তখন মরক্কো এর একটা জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে। মরক্কোর
বাদশাহ ষষ্ঠ মুহাম্মদের উদ্যোগে তিন দিনের এক বৈশ্বিক সম্মেলন আহ্বান করা
হয়। এর উদ্দেশ্য মুসলমান দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার ও রক্ষার দায়
সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং বাস্তব পদক্ষেপ হাতে নেওয়া। ২৫ থেকে ২৭
জানুয়ারি মারাক্কেশ শহরে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে মুসলিম দেশগুলো থেকে প্রায়
৩০০ আলেম, মন্ত্রী, মুফতি, শিক্ষক অংশ নেন। তিন দিনের আলোচনা থেকে তাঁরা
একটা ঘোষণা তৈরি করেন। ওই ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘যেখানে মুসলিম দুনিয়ার
বিভিন্ন অংশের পরিস্থিতি সহিংসতা ও সশস্ত্র তৎপরতাকে সংঘাতের মীমাংসা ও
একচোখা নীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার করা হচ্ছে, যেখানে এমন পরিস্থিতি বৈধ
সরকারের কর্তৃত্ব দুর্বল হয়েছে এবং অপরাধী গোষ্ঠীগুলো ইসলামের নামে
ফতোয়া দিচ্ছে, যা কার্যত ইসলামের মৌলিক নীতি ও লক্ষ্যকে এমনভাবে বিকৃত
করেছে, যার ফলে (ওই সব দেশের) জনগণ ক্ষতির শিকার হচ্ছে; যেখানে এ বছরই হজরত
মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে মদিনার জনগণের সাংবিধানিক চুক্তি মদিনা সনদের ১৪
শততম বার্ষিকী পূরণ হচ্ছে, যে সনদের মাধ্যমে ধর্মবিশ্বাস-নির্বিশেষে সবার
ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে; ...সেহেতু দুনিয়ার সব মুসলমান আলেম ও
বুদ্ধিজীবীকে আমরা ডাক দিই এমন আইন ও নাগরিকত্বের ধারণা নির্মাণের জন্য, যা
বিভিন্ন গোষ্ঠীকে ধারণ করবে।’ এই সম্মেলন থেকে মুসলমান-অধ্যুষিত দেশের সব
ধর্মের মানুষের বিশ্বাস এবং জীবনের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার জন্য কেবল
সাংবিধানিক সংস্কার ও আইন প্রণয়নেরই আহ্বান জানানো হয়নি,
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যতালিকায় সম্প্রীতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের
ব্যবস্থা করার ডাকও দেওয়া হয়েছে। এই সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে
বসবাসকারী অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের সুরক্ষার জন্য মুসলিম উম্মাহকে
উদ্বুদ্ধ করা। মারাক্কেশ সম্মেলনের এই ডাক সরাসরি আইসিসের বিরুদ্ধে মুসলিম
চিন্তক ও আইনপ্রণেতাদের একটা অংশের প্রতিক্রিয়া। আইসিস যেখানে বিভেদ ও
হত্যালীলা চালাচ্ছে, সেখানে তাঁরা বলছেন সহাবস্থান ও পারস্পরিক অধিকারের
কথা। এবং এই কাজে রাজনীতিবিদ, আলেম, শিল্পীসহ সব স্তরের মুসলমানদের
নিয়োজিত হতে বলা হয়েছে মরক্কোর মারাক্কেশ সম্মেলনের ঘোষণায়। সুতরাং,
আইএসই শেষ কথা নয়। একদিকে তাদের বিষয়ে বৈশ্বিক ‘না’, অন্যদিকে ধর্মীয়
স্বাধীনতা ও সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে মৈত্রীর ডাক এই দুর্দিনে কিছুটা হলেও
মুসলিম সুবিবেচনার কথা বলে। এই সূত্রেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একদল মানুষ
গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আইসিস তথা ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক
অ্যান্ড সিরিয়া’ নামধারী সংগঠনকে ইসলামের থেকে বিযুক্ত এমন কোনো নামে
ডাকার। আইসিসের আরবি নাম হলো ‘দা’য়েশ’, যার এক অর্থ ইরাক ও সিরিয়ার ইসলামি
রাষ্ট্র। এদের প্রস্তাব আইসিস না বলে দায়েশ নামে ডাকা। আরবি ভাষায় আরেকটি
শব্দ হলো ‘দায়েছ’, যার আরেক অর্থ ‘অধঃপতিত’। দায়েশের চেয়ে দায়েছ নামটাই
তাদের জন্য বেশি উপযোগী।
No comments