‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে লজ্জাজনক ঘটনা by মনজুর কাদের
পুরস্কার বাতিল করার ঘটনা এর আগে শুনিনি। তবে আমি বলতে চাই, এই ছবির চিত্রনাট্য যখন জমা পড়েছিল তখনই এটা ভালোভাবে দেখার দরকার ছিল অভিনেতা রাজ্জাক ‘পরিচালকের উচিত তাঁর সৃষ্টির প্রতি সৎ থাকা। একেবারে বিনা পারিশ্রমিকে এই ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। ছবিটি নিয়ে অনেক গর্বও করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, সবই বৃথা।’ প্রথম আলোর প্রশ্নের উত্তরে ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে বলছিলেন অভিনেতা ফেরদৌস। বৃহন্নলা ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস। তবে তিনি একা নন। গল্প চুরির অভিযোগে পুরস্কার বাতিল হওয়ার পর ‘বৃহন্নলা-কাণ্ড’ নিয়ে সরব হচ্ছেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট অনেকেই। তাঁরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরল ও লজ্জাজনক! অভিনেতা রাজ্জাক এ ব্যাপারে বলেন, ‘পুরস্কার বাতিল করার ঘটনা এর আগে শুনিনি। তবে আমি বলতে চাই, এই ছবির চিত্রনাট্য যখন জমা পড়েছিল তখনই এটা ভালোভাবে দেখার দরকার ছিল।’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৪-এর জুরিবোর্ডের চেয়ারম্যান বর্তমানে বিটিভির মহাপরিচালক হারুন অর রশীদ বলেন, ‘একজন নির্মাতার নৈতিকতার জায়গা ঠিক থাকা উচিত। নকল যিনি করেন তিনি তো শিল্পী হতে পারেন না। এটা দুঃখজনক। তাঁর শাস্তি হওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, বৃহন্নলার নির্মাতা মুরাদকে ছবিটি নির্মাণের জন্য পাওয়া অনুদানের ২৪ লাখ টাকাও ফেরত দিতে হবে। সরকারি অনুদানের এই ছবিটির প্রযোজনায় ছিল এটিএন বাংলাও। এ প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের তো এত কিছু খেয়াল করা সম্ভব না। মুরাদ আমাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছিলেন, আমরা তা করেছি। কিন্তু তিনি যে একটি চুরি করা গল্প নিয়ে ছবিটি বানিয়েছেন, তা আমাদের জানা ছিল না। গল্প চুরির ঘটনা আমি মনে করি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।’ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘অভিযোগ আসার পর আমরা তদন্ত কমিটি করি। তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদের সভায় পুরস্কার বাতিলের সিদ্ধান্ত নিই।’ কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা কি এবারই প্রথম? এ বিষয়ে জানতে চাই চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াতের কাছে। তিনি বললেন, ‘চূড়ান্ত ঘোষণার পর চলচ্চিত্র পুরস্কার বাতিলের ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে। তবে ১৯৯৫ সালে প্রয়াত নির্মাতা শেখ নিয়ামত আলীর অন্যজীবন ছবির বিরুদ্ধে গল্প নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। বিষয়টি আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছিল।’ বছর বিশেক আগে করা সেই মামলার পরিণতি কী? এ কথা জানতে যোগাযোগ করেছিলাম শেখ নিয়ামত আলীর মেয়ে শর্বরী ফাহমিদার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যত দূর জানি নিম্ন আদালতে রায়টি বাবার পক্ষেই যায়। পরে মামলাটি উচ্চ আদালতে যায়। কিন্তু এরপর আর মামলাটি এগোয়নি।’ চুরি করা গল্প নিয়ে নির্মিত আরও একটি ছবির জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিলেন পরিচালক কাজী হায়াৎ। তিনি জানালেন, ‘নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পিতা-মাতা-সন্তান ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিল একাধিক বিভাগে। ছবিটি ছিল ভারতের আভতার (১৯৮৩) ছবি অবলম্বনে তৈরি। তখন আইনে ছিল, উপমহাদেশের কোনো চলচ্চিত্রের অনুকরণে তৈরি ছবি জাতীয় পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবে না। এর প্রতিবাদে ঝাড়ু-জুতা আর আমার পাওয়া জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারটি নিয়ে আমি আমার বেগুনবাড়ির বাসা থেকে প্রেসক্লাবের সামনে পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম। এই ঘটনা তখন পত্রপত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল।’ কাজী হায়াৎ আরও বলেন, ‘দুর্ভাগ্যক্রমে বৃহন্নলা ছবির অনুদান কমিটিতে আমিও ছিলাম। ছবির গল্প পড়ে আমার মনে হয়েছে এটি মুরাদের নিজের কোনো গল্প না। তখনই আপত্তি জানিয়েছিলাম। এখন বিষয়টি প্রমাণিত হলো। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এটা লজ্জাজনক একটি ঘটনা।’ এই বিষয়ে নির্মাতা মুরাদ পারভেজের সঙ্গে টানা তিন দিন যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া মেলেনি। পরে তাঁকে ফেসবুক ও ভাইবারে খুদে বার্তা পাঠানো হয় । সেই বার্তা ‘সিন’ বা তিনি দেখেছেন সেটা বোঝা গেলেও তিনি কোনো জবাব দেননি। প্রসঙ্গত প্রথম আলোতে প্রকাশিত ২০১২ সালের ৩ মার্চ তারিখের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নকল ছবিকে’। সেই প্রতিবেদনেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জুরি বোর্ডের একজন সদস্য বলেছিলেন, ‘এবার যে ছবিগুলো আমরা দেখেছি সেখানে সত্যিকার অর্থেই মৌলিক ছবির গল্প কম। বেশির ভাগ ছবিই ভারতীয় হিন্দি বা মাদ্রাজি ছবির নকল।’ বৃহন্নলার পুরস্কার বাতিলের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও। বিবিসি বাংলা তাদের ‘বৃহন্নলা নির্মাতার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার’ শিরোনামের প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদানের পর ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।’ ১৮ এপ্রিল প্রকাশিত ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘সিরাজের গল্প টুকে জাতীয় পুরস্কার খোয়াল সিনেমা’। এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়াতেও। তথ্য মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষণা করে এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি। তাতে ওই বছরের শ্রেষ্ঠ সিনেমা, শ্রেষ্ঠ কাহিনি ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ—এই তিন শাখায় পুরস্কার পায় বৃহন্নলা। পুরস্কার ঘোষণার পরই ছবিটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। পুরস্কার বাতিলের পর এখন ২০১৪ সালের সেরা চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছে মাসুদ পথিক পরিচালিত ছবি নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ। এ ছাড়া মেঘমল্লার চলচ্চিত্রের জন্য ‘সেরা কাহিনিকার’-এর পুরস্কার পাচ্ছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (মরণোত্তর) এবং একই সিনেমার জন্য জাহিদুর রহিম অঞ্জন পাচ্ছেন ‘সেরা সংলাপ রচয়িতা’র পুরস্কার।
No comments